ক্যাফে কাব্যনাটিকা তে যাজ্ঞসেনী গুপ্ত কৃষ্ণা

জল ও আগুনের সন্ধানে

(আলুথালু বিধ্বস্ত চেহারায় ক্লান্ত পায়ে আসে, বলতে বলতে)
নারীঃ জ্বরের ভেতর ঘুমিয়ে আছি কতদিন।
ভীষণ তেষ্টায় ঘুম ভেঙে যায় ।
ঘোরের ভেতর ভেবেছি চারপাশ জুড়ে
আমাকে ছেয়ে আছে আপনজনেরা, কিংবা কোনো শালপ্রাংশু গাছ ।
অথচ প্রবল শীত আর তেষ্টায় দেখি মাঝরাত –
বিছানার চারপাশে বয়ে যাচ্ছে
নিষ্ঠুর
শৈত্য প্রবাহ আর ধূধূ শূন্যতা।
কেউই তো কোথাও দিশা রাখেনি হিমবাহ কিনারে! এত তেষ্টা, জমাট জল –
তবু এক ফোঁটাও গলা ভেজে না,
জলের ভেতর জলের চলাচল,
আমি অবগাহনে যেতে পারিনি কোনোদিন। ডুব দিয়ে দেখেছি অগাধ তমসা।
(লুটোনো আঁচল, চারদিক অন্ধের মতো হাতড়াতে হাতড়াতে বলে)
টেনে টেনে উঠি, দরজা জানালায় ধাক্কা খাই, বেরোনোর রাস্তা খুঁজে পাই না।
দূর থেকে ভেসে আসে সম্মিলিত আনন্দধ্বনি, কাদের প্রবল আত্মকথন। এই কোলাহল কি যুদ্ধ শেষের? না কি যুদ্ধের পুনঃপ্রস্তুতি?
মধ্যযামের কৃষ্ণপক্ষীয় অন্ধকার যেন। মহলের কোথাও দীপাধার জ্বলছে না কেন? ওহো! সেসব তো কবেই ধুয়ে মুছে গিয়ে জ্বলেছে মানুষের স্বাধীনতার চিরাগ।
এই আঁধারে হাতে পায়ে ধাক্কা লেগে ভেঙে যাচ্ছে টিয়া রঙ,
ভেঙে যাচ্ছে ময়ূর পেখম।
ভেঙে গেল মধুচুষি সজল মেঘ অবহেলার কিনারে।
(চিৎকার করে)
কে আছো,
ভিজে মাটিতে পা রেখে রেখে আসবে এই ধূধূ প্রান্তরে? এই শূন্যতা শূন্যতার বরাভয়ে আমাকে দেবে বৃক্ষতল? কেউ আছো?
(সহসা কেউ সাড়া দেয়। অন্ধকার সামান্য ফিকে হয় যেন।)
আগন্তুকঃ দিদি… দিদি .. চুপ করো তুমি – কেন ডাকছ এমন অন্তরছেদী ডাক?
নারীঃ কোথায় ছিলি, ভাই? আমাকে একা রেখে?আমি সময়ের চক্ষুমতী মেয়ে, অথচ দ্যাখ, সময় আমাকে বেঁধে রেখেছে শতপাকে। বাইরে যেতে চাই, কিছুই স্পষ্ট দেখতে পাই না। অন্ধকারে একা পড়ে থেকে এমন দোরে দোরে ধাক্কা খেয়ে ফিরি।
ব্যর্থ ডাকে গলা শুকিয়ে ওঠে। যেন কেউ নেই আমার যে সাড়া দেবে –
আগন্তুকঃ তোমার সবাই আছে, শুধু তোমার স্বভাবের দোষে –
নারীঃ থামলি কেন? বল, কী আমার স্বভাবের দোষ? সবাইকে আমার ভাবি সেও আমার স্বভাবের দোষ?
আগন্তুকঃ তাই তো একা একা রাত্রি মাপো তুমি। চারপাশে আগুনরঙা সীমানা, সে আলোর কুলকিনারা কেন জানতে চেয়েছ তুমি?
নারীঃ সব জানতে চাওয়া আজ অপরাধ বটে!
আগন্তুকঃ চিরকাল অপরাধ তা। প্রশ্ন করার অপরাধ!
নারীঃ মানি না এ কথা। আমি সব দেখতে চাই, বাইরে যাব। একা পড়ে আছি তৃষ্ণার দেশে। একা কথা কই –
বাঁজা কথারা উল্টোমুখে গোঁত খেয়ে পড়ে ভেঙে যায় অজস্র টুকরোয়।
গেছে যারা ঝকমকে পাথরের লোভে নদীর বুকে সন্ধানীদের মতো, ডেকেছিলাম, ওগো! ঝুটা ফেলে নিজের সোনার মাটিতে ফেরো! তারা দুয়ো দিয়ে চলে গেছে আমাকে ফেলে রেখে অন্ধকার চাকের ভেতর। সেও আমার দোষ?
আগন্তুকঃ শৃঙ্খলা আর শৃঙ্খল পিঠোপিঠি ভাইবোন। শৃঙ্খলা অমৃত দিয়ে সবাইকে ভোলাতে পারে না চিরদিনের জন্য। সে জিনিস শৃঙ্খলের বিষ হয়ে ওঠে একদিন । এ ভুল নয়, দোষ নয়।
নারীঃ বুঝেছি, ভাই। গান্ধারী একদিন স্বেচ্ছায় চোখে কাপড় বেঁধেছিল । আমি চোখের আবরণ খুলে হয়েছি চক্ষুমতী
। শুধু শতাব্দীর ক্লান্তিবশে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চোখ মেলে দেখি কুয়াশা ঘনিয়ে আছে।
আগন্তুকঃ আমি তোমায় নিয়ে যাব বাইরে। দেখবে, সেখানেও একই আঁধার। সূর্যকিরণ ছড়িয়ে আছে, তবু তাল তাল আঁধার।
খোলা আকাশের নীচে তা লজ্জায় কুঁকড়ে আছে। ফুল ফুটে আছে, শস্য ফলে আছে তারই ভেতর।
নারীঃ আঃ! কতদিন আলো আসেনি প্রকোষ্ঠে।
পূর্ণ চাঁদের আলোয় মধুভান্ড ফুলের বাস আসেনি।
আর নদীর ভাটিয়ালিতে ঋতুমতী মাটির আনচান বাজেনি হাওয়ার গানে।
(আগন্তুকের দিকে অন্ধের মতো হাত বাড়িয়ে দেয়। হাত ধরে সে বলে-)
ঃ পা ফেলে রিকেটি পথে, এসো সাবধানে! এই রিকেটি পথে ছাপ পড়লে আঁত ছিঁড়ে টাল খাবে রুগ্নমাটি।
(ধীরে ধীরে তারা বেরিয়ে আসে প্রাচীরের বাইরে। আবছা একটা আলো ছড়িয়ে আছে)
নারীঃ চোখ যেন চিনতে পারছে পুরোনো পৃথিবীকে! কিন্তু এ কোন দেশ! চেনা নয় এই জনপদ। ধোঁয়া উড়ছে পরাজিতের ভিটে যেমন ধুঁইয়ে ধুঁইয়ে গুঁঙিয়ে কাঁদে। কোথায় লোগেছে আগুন এই ভাঙা প্রহরে?
আগন্তুকঃ দেখছ না, ধুঁকে ধুঁকে হেঁটে চলেছে শিশু – বৃদ্ধ – যুবক – ভাঙা তীর্থের যাত্রী ? বাতাসের পিঠে কেটে বসে তাতারের অদৃশ্য চাবুক, আর ঝনঝন করে ওঠে শেকল বাঁধা রক্তাক্ত হাত -!
নারীঃ যেন ভয়াল সরীসৃপের বিষ নিঃশ্বাস! দমবন্ধ লাগছে!
(তারপর হঠাৎ দূরে গাছপালার মাথার উপর দিয়ে তাকিয়ে যেন দেখতে পায়) দূরে আকাশের দিকে উঁচিয়ে দাঁড়ানো ও কার মাথা ? এত গর্বিত স্থাপনা কে দিলো -! পাহাড় জঙ্গল ভেদ করে তাকিয়ে আছে – জনপদের দিকে, অনেক উপর থেকে দৃষ্টি মেলে যেমন দেখে নেয় আকাশবিহারী শ্যেনপক্ষি !
আগন্তুকঃ যেখানে যাচ্ছি সেখানেই তার দৃষ্টি – যেন শলাকা, এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে! সব আড়াল ভেঙে মানুষকে অস্বস্তির ভেতর জাগিয়ে রাখার আয়োজন!
নারীঃ যেন উপনীষদীয় বাণী উগড়ে একটা কুৎসিত পূর্ণচ্ছেদ!… সহ্য করতে পারছি না একমের উদ্ধত অহংকার। যখন রিক্ত ডোল, তখন উচ্চতম স্তম্ভ নির্মাণের উৎসব কেন!
আগন্তুকঃ পাখি নেই আকাশে, দেখছ না? তারাও কষাঘাতে জর্জরিত। জল বাতাস মাটি পরিত্যক্ত বিষময় বন্দর।
নারীঃ ভাই! সহ্য করতে পারছি না এ ক্ষয়। আরও দূরে যে পাহাড়গুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল সবুজের চাদর গায়ে, তারা সব কোথায়? একটা যান্ত্রিক শব্দ, আর নদীর পাড় ভাঙার মতো ভাঙছে যেমন মানুষ ভেঙে পড়ে আঁতে ঘা খেয়ে – কী ওরা?
আগন্তুকঃ চলো, আরও এগিয়ে যাই সামনে।
দৃশ্যান্তর (কয়েকটি উপজাতি মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় সর্বস্ব হারানোর ছাপ।)
একজন বলছেঃ জঙ্গল আমাদের মা। মাকে ওরা বিকোতে পারে বটে, আমরা নই। এতেই আমাদের জীবনধারণ । দেবতার আদি বাসভূমি। এর প্রতিটা কীটের কাছেও আমাদের ঋণ। নিরন্তর ঝরে চলেছে যে ঝোরা সে-ই আমাদের একমাত্র পিপাসাহর। অথচ -(বলতে বলতে কিছু ভেঙে পড়ার শব্দ ওঠে। আর হাহাকার ওঠে সমবেত মানুষগুলির ভেতর)।
দ্বিতীয় ব্যক্তি – ওই – ওই, আবার একটি পাহাড়ের মাথা ভেঙে পড়ল! হায় হায়! বাসা হারিয়ে ডানায় ছটফট করতে করতে উড়ে যাচ্ছে কত পাখি – ওই দ্যাখো, বিপদের বায়ুকোন বরাবর –
প্রথম ব্যক্তিঃ কান পাতো, শোনো, কী করুণ সুরে ভেঙে পড়ছে প্রবল সম্ভাবনাময় ডিম …
দ্বিতীয় ব্যক্তিঃ হায় ভগবান! ডিনামাইটে গুঁড়িয়ে দিক না একসঙ্গে আমাদের সবাইকে! তবু টিকে থাক এই জল,জঙ্গল, মাটি আরও হাজার প্রাণিকে অটুট রেখে!
তৃতীয় ব্যক্তিঃ নিরন্তর মুছে যাওয়া প্লাবনের মুখে, উদয়াচল থেকে সূর্য তার ছায়া খুঁজে খুঁজে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছে অস্তাচলে।
দ্বিতীয় ব্যক্তিঃ শূন্য হাঁড়িতে জল ফোটে আমাদের। চাল নেই। পিপাসার জল শুকিয়ে গেছে। সব ঝোরা নিয়ে পাহাড়গুলোর যে দাহকার্য হলো! আর পুকুর দ’র জল শুষে নিলো সুড়ঙ্গ-প্রেতাত্মা।
( সবাই হইহই করে ওঠে। তেষ্টা – বড়ো তেষ্টা -! বলতে বলতে সবাই আকুল হয়ে ওঠে। এই সময় আসে নারী ও আগন্তুক)
আগন্তুকঃ বাতাসকে কারা ভারী করে তুলছে এমন তীব্র হাহাকারে? – যাতে শুধু নিজেদের সঁপে দেওয়া আছে, প্রতিবাদ নেই, প্রতিরোধের উত্তাপটুকুও নেই!

নারীঃ কারা তোমরা? কেন এই হাহাকার?

প্রথম ব্যক্তিঃ দেখে বুঝতে পারছ না? ইঁদুরের ফাঁপা বিবরের উপরখোলে আমাদের উদ্বাস্তু শিবির-? নিয়তিবাধ্য জীবনে ওই দ্যাখো, সামনে স্তুপাকার কিছু পাথরের গুঁড়োয় ডুবে গেছে আমাদের গেরস্থালী।
নারীঃ কেন এমন মর্মঘাতী আর্তনাদ করছ তোমরা?
( তেড়িয়া হয়ে আসে একজন। বলে-) খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি? সইতে পারছ না এ হাহাকার?

( আর একজন-) মেটাও দেখি আমাদের পিপাসা? মাটিকে ফিরিয়ে দিতে পারো যেখানে পা দুটো সটান পুঁতে দিয়ে গাছ হয়ে যেতে পারি?

আগন্তুকঃ এ আমাদের সম্মিলিত পাপের ফল।
প্রথম ব্যক্তিঃ পাপে তে খিদেতেষ্টা বাগ মানে না!
নারীঃ বাড়ি শুধু আশ্রয় নয়, আত্মা আর সত্তায় জড়াজড়ি ছায়াপথে ওঠা ওংকার ! যেন গোটানো খুলে যাওয়া শীতলপাটি!
কিন্তু এখানেও দেখি তৃষ্ণার হাহাকার? চলো, চলো, নদীর কাছে যাই – ।
( বলতে বলতে তারা এগোয়)
আগন্তুক বলেঃ নদীর পরিত্যক্ত সংবহন পথে শুয়ে আছে আর এক নদী। সে নদী বালির! নদীর গায়ে অজস্র বাঁধন। তার গা কেটে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে! রুগ্ন, শীর্ণ মেয়েটির মতো তবু এগিয়ে চলতে চায় সে, যদি পৌঁছোতে পারে তার ঘরে।
নারীঃ সময়ের গান্ডীবে যদি ছিঁড়ে ফেলা যেত দুঃসময়ের চাদর! আধফোটা আলোয় বিষণ্ণ চরাচর। তার মাঝে কোথাওবা দম্ভের হুল্লোড়, কোথাও অশ্লীল উল্লাস।
আগন্তুকঃ ক্ষয়াটে চপ্পলের শব্দে বয়ে যাওয়া নদীর পাশে পাশে মানচিত্রহীন অভিশাপগ্রস্ত মানুষ ঝুঁকে ধুঁকে চলেছে শরণার্থী শিবিরের দিকে। একটা কলমের সন্ধানী কেউ কেউ। তা দিয়ে লিখে ফেলতে চায় নিজস্ব ঠিকানা।
নারীঃ দুটো আলাদা পৃথিবী এই পৃথিবীতে। মাঝখানে কামট ভরা সেতুহীন গভীর পরিখা। স্যাঁতস্যাঁতে ভূখন্ডটি বিপুল ‘নেই’এর প্রতিধ্বনিতে ভেসে যাচ্ছে। মানুষকে থামিয়ে দিচ্ছে বেয়নেটের হুঙ্কার। সেই শব্দও ছাপিয়ে যাচ্ছে সবুজ ছোপছাপ সেনানির বলাৎকারের জান্তব আর্তনাদ। ছিঁড়ে যাচ্ছে সতীচ্ছদ, ছেঁড়াখোঁড়া যোনির ঘেরে কালভৈরবের নষ্টপতন, আর মাতৃসুড়ঙ্গের অন্ধকারে কুসুম দলামচা।
আগন্তুকঃ পড়ে থাক এই হাহাকার। চলো, সামনে এগিয়ে দেখি, কিংবা পিছনে। দেখে যাওয়াই কাজ।
নারীঃ তার আগে বলো, কোথায় আমাদের মা বাবা ও অন্য আত্মীয়রা? তাদের যে সঙ্গে চাই!
আগন্তুকঃ চলো তবে তাদের খোঁজে।
নারীঃ রাস্তার মোড়ে কুয়াশার জাল ছিঁড়ে ঠিক পথ চিনে নেব, যে পথ গেছে সন্ধানীদের পাড়া। যে পথ জলের ঘেরে প্রকৃত সঙ্ঘের কথা বলে। যে পথে জল আর আগুনের সঠিক ঘের সে পথ ঠিক খুঁজে নেব আমরা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।