• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে সমীরণ সরকার (পর্ব – ১১)

সুমনা ও জাদু পালক

(তিন)

আয়না নদীর দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে সুমনা। খুব কান্না পাচ্ছে তার ।ছি ছি ছি !শুধু শুধু তার জন্য বাদল দাদুকে মিছিমিছি অত কথা শুনতে হল। কিন্তু এখন কি করবে সে ?সে না হয় ফল প্রসাদ গুলো খেয়ে নিয়েছে। আজ আর কিছু না খেলেও চলে যাবে তার। কিন্তু মাকে কি খেতে দেবে? তাছাড়া ক্ষ্যাপা কালীর থানে ওইযে আধ বুড়ো দুঃখী মানুষটা প্রসাদ পাবে বলে আশা করে বসে আছে ,সে হয়তো ভাবতে পারে সুমনা প্রসাদ পেয়ে সোজা বাড়ি চলে গেছে ।তার কথা মনে রাখেনি সুমনা। ওকে গিয়ে আসল কথাটা কি জানিয়ে আসবে সুমনা? কিন্তু তাতে তো অশোক কাকার খিদে টা মিটবে না, বরঞ্চ দুঃখ পাবে।তারচেয়ে বরং আশায় আশায় বসে থাকুক অশোক কাকা ।তারপরে হয়তো বা কেউ কিছু খেতে দেবে কাকাকে।
কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে? মা যে কবে আবার সুস্থ হবে ,কবে মন্দিরে কাজ করতে যেতে পারবে, কবে যে আবার তারা পেট পুরে খেতে পাবে ,কে জানে !
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সুমনার মনে পড়ে যায় মায়ের বলা কথা। মা যে সব সময় বলে ,খুব বিপদে পড়লে ঠাকুরকে ডাকবি, দেখবি, মনে খুব জোর পাবি। মন খুলে ঠাকুরকে সব কথা বলবি ,দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে এক সময় ।এখানে তো শিব ঠাকুর আছে। তাহলে শিব ঠাকুর কে কি সব কথা খুলে বলবে সে? মা বলেছে, শিব ঠাকুর নাকি খুব অল্পেই খুশি হন। তিনটে বেলপাতা আর গঙ্গাজল পেলেই তুষ্ট হন আশুতোষ ।গঙ্গাজল তো এখানে নেই, কিন্তু আয়না নদীর জল আছে। মা বলেছে ,এই আয়না নদী নাকি গঙ্গার সঙ্গে মিশেছে ।তাহলে তো আয়না নদীর জল পেলেও খুশি হবে শিব ঠাকুর। চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ায় সুমনা। নদীর পাড়ে আকন্দ গাছ থেকে একটা বড়সড় পাতা ছিঁড়ে নেয়, কয়েকটা আকন্দ ফুল ও তুলে নেয়। প্রথমে নদীর জল ঘেঁসে গজিয়ে ওঠা লম্বা লম্বা শক্ত ঘাস তুলে নেয় ।ঘাসের ডগা টা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে লম্বা ডাঁটটা দিয়ে আকন্দ ফুল গেঁথে মালা তৈরি করে ।তারপর নদীর পাড়ে শুকনো বন তুলসীর গাছ থেকে সরু কাঠি ভেঙে টুকরো টুকরো করে আকন্দ পাতা দিয়ে ঠোলা তৈরি করে সুমনা। পাতা দিয়ে এই ঠোলা তৈরি করতে সে শিখেছে ফুলমণি মাসির কাছ থেকে। তাদের গ্রাম থেকে মাইল দুয়েক দূরে ফুলমণি মাসিদের গ্রাম, বনপলাশী ।ফুলমণি মাসি বাঁশের ঝুড়িতে করে কখনো কাদা জাম ,কখনো করমচা, কখনো ছোট ছোট কুল ,কখনো বা অন্য কোন ফল গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করে ।
ওর ঝুড়িতে থাকে শাল পাতার তৈরি ছোট ছোট ঠোলা ।ওই ঠোলা ভর্তি করে সে জাম, কুল, করমচা ইত্যাদি বিক্রি করে।
সুমনা আকন্দ পাতা দিয়ে ঠিক ফুলমণি মাসির মত পাতার ঠোলা তৈরি করে ।তারপর সেই ঠোলাতে আয়না নদীর জল ভরে নেয়। ভাঙ্গা শিবমন্দিরে ঢুকে শিব লিঙ্গের মাথায় আয়না নদীর জল ঢেলে পরিষ্কার করে ধুলোবালি ।আকন্দ ফুলের মালা পরিয়ে দেয় শিবলিঙ্গের গলায় ।তারপর হাত জোড় করে বলে ,ঠাকুর, ও শিব ঠাকুর, তুমি তো সব দেখতে পাচ্ছো ।মায়ের জ্বর টা একটু সারিয়ে দাও না গো। মা ভালো না হলে আমরা কি খাবো? শিব ঠাকুর,ও শিব ঠাকুর, কিছু একটা করো। অশোক কাকা আমার জন্য বসে আছে ক্ষ্যাপা কালির থানে। কিন্তু আমিতো প্রসাদ পাইনি যে ওকে কিছু দেবো। লোকটা বড় আশা নিয়ে বসে আছে গো। ওকে কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে দাও না গো ঠাকুর।বলতে বলতে সুমনার চোখ থেকে টপটপ করে জল ঝরে পড়ে শিব লিঙ্গের মাথায়। চোখ মুছতে মুছতে বাইরে এসে বটগাছের নিচে বসে সুমনা । কিছুক্ষণের মধ্যেই এক এক করে হাজির হয় অনেকগুলো পাখি ।নানা রঙের, নানা ধরনের পাখি। তারা সুমনাকে ঘিরে ডাকতে থাকে ।সুমনা ওদের মুখের দিকে তাকায় ।আবারো খুব কান্না পায় তার। কাঁদতে কাঁদতে সুমনা বলে ,ওরে ,আজকে তোদের জন্য কিচ্ছু আনতে পারিনি আমি ।আমাদের ঘরে কিচ্ছু নেই। আমার মাও তো কিছু খায়নি কাল থেকে ।পাখিগুলো কি বুঝলো কে জানে। ওরা যেভাবে এসেছিল এক এক করে ,সেভাবে ফিরে গেল ।বসে বসে আকাশ-পাতাল ভেবেই চলেছে সুমনা। হঠাৎ ঝুপ করে ওর সামনে একটা পাখি এসে বসলো । আরে এতো সেই পাখিটা, সকালবেলায় বাগানে যেটাকে দেখেছিল ।সেই নীল রঙের পাখিটা।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।