সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ২৭)

আমার মেয়েবেলা
ভাইয়ের কথা
খুব চোখে চোখে রাখতাম ভাই কে। যতই হোক বড়ো দিদি আমি! আমার তো একটা দায়িত্ব আছে,,,,,তবে দিদির থেকে বন্ধুই ছিলাম বেশি।
আমার খেলার সঙ্গী বলতে ভাই। কত যে খেলা করেছি ওর সঙ্গে। কত রকমের খেলা। এখন ভাবলে হাসি পায়। আমি ওর সঙ্গেই প্রথম বল খেলেছিলাম, ঘুড়ি উড়িয়েছিলাম, টায়ার চালিয়ে ছিলাম লাঠি দিয়ে, গুলি খেলেছিলাম, মার্বেলও। ব্যাটমিন্টন, ভলিবল,ক্রিকেট এবং অবশ্যই সাইকেল,,,,
একটা সাইকেল নিয়ে কাড়াকাড়ি হত, তাই বাবা দুজনের জন্য আলাদা আলাদা সাইকেল কিনে দিয়েছিল।
ওর সঙ্গে কোনদিন ঝগড়া হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না। খুব সুন্দর একটা বোঝাপড়া ছিল আমাদের মধ্যে। দিদি বলত ঠিকই কিন্তু ছিলাম একেবারে বন্ধুর মতো। যেদিন এক্কাদোক্কা খেলতে চাইতাম ভাই সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যেত। ও ভীষন এডজাস্টেবল ছিল। কারো সঙ্গে কখনো মনোমালিন্য হয়েছে বলে শুনি নি। হয়ে থাকলেও আমার কানে অন্তত আসে নি। সবার সঙ্গেই খুব ভালো সম্পর্ক ছিল ওর।
যা বলছিলাম ছোট থেকেই আমি ওর খুব খেয়াল রাখতাম।
একবার ও খুব জোর বেঁচে গিয়েছিল আমারই জন্য,,,,,,,,,
গামলার মতো ওভাল শেপের একটা বেতের দোলনায় মা শোবার ঘরে ভাইকে ঘুম পাড়িয়ে রান্না করছিল রান্নাঘরে। আমি সেই দোলনা হাত বাড়িয়েও ধরতে পারব না। আমি ঘরে একা একাই খেলা করছিলাম। হঠাৎ দেখি ভাই ঘুম থেকে উঠে বসে আমাকে ডাকছে। হাসছে,,আমার দিকে হাত বাড়াচ্ছে,,,,,ও জেগে উঠেছে দেখে আমিও আনন্দে কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তখনও আমি ফরাক্কায়,,,,,,,ঠাকুমার বাড়ি যাই নি,,,,,ওখানকার স্কুলেও ভর্তি হয়নি । বেশ মনে আছে আমার,,,
কিন্তু জানিনা এতদিনের কথা কেন মনে আছে। মনে না থাকলেই হয়তো ভাল হতো আমি কিছুটা স্বস্তি পেতাম। কিছুটা শান্তিও…….
তো যা বলছিলাম
আমিও কথা বলছি ওর সঙ্গে । তবে আস্তে আস্তে। মা শুনতে পেলে বকবে। বলবে তুই ভাইকে তুলে দিলি আমি কি করে এবার রান্না করব?
তাই ভয়ে ভয়ে আস্তে আস্তে কথা বলছি,,,
দোলনার ঠিক মাঝে দাঁড়িয়ে টুকিটুকি খেলছি।
হাসিহাসি মুখে ভাই আমাকে খোঁজার চেষ্টা করছে। একবার এদিকে ঘুরছে,আর একবার ওদিকে।
আমি মুখ বাড়ালেই ও খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে আর আমার বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরার চেষ্টা করছে ।
আমিও পা উঁচু করে হাত বাড়াচ্ছি। কিন্তু ভাইকে কিছুতেই ছুঁতে পারছি না।
ভগবান হয়তো অলক্ষ্যে হেসে ছিলেন তাইতো ও আমার হাতটা ধরতেই পারেনি কোনদিন। যখন আমার ভাইকে সব থেকে বেশি দরকার ছিল,,,বড্ড দরকার ছিল,, তখনই ও সব মায়া কাটিয়ে চলে গিয়েছিল একেবারের মতো ,,,ঐ না ফেরার দেশে,,,,আমি আকাশের সব থেকে বড় জ্বলজ্বলে তারার দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিলে কান্না গিলতাম আর কত যে কথা বলতাম পাগলের মতো,,, অবশ্য আজ ও করি। তবে আগের থেকে কম।
যা বলছিলাম,,,
আমি পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ভাইকে ছুঁতে পারছিলাম না। ওর ছোট্ট ছোট্ট আঙুলগুলো আমার আঙুলগুলোকে
কিছুতেই ছুঁতে পারছিল না বলে আমি তখন লাফিয়ে ছুঁচ্ছিলাম আমার ভাই এর আঙুল গুলো।
ভাই আমার লাফানো দেখে আনন্দে আরও ঝুঁকে পড়ে হাসছে।আর ওর মুখ থেকে বেড়োনো লালা আমার মুখের ভেতরে,,,,, চোখে মুখে পড়ছে। আমি জামা দিয়ে মুছছি আর প্রাণপণে হাতটা বাড়াচ্ছি,,ভালবাসা বোধহয় এমনই হয়,,,যেখানে কোনও ঘেন্না থাকে না।
এভাবে কিছুক্ষণ পর খেলা করতে করতে খেয়াল করলাম ভাই অনেকটা ঝুঁকে পড়েছে।
আমি ধরতে না পারলে ভাই এবার পড়ে যাবে। কত লাগবে ভাইয়ের! আমি তখন খুব জোরে মা কে ডাকতে শুরু করলাম। “মাআআআআআআ
তাড়াতাড়ি এস ভাই পড়ে যাচ্ছে,,,,
মা শুনতে পাচ্ছিল না । জোরে রেডিও চলছিল। মা খুব গান শুনতে ভালবাসত। সকাল হলেই রেডিও টা চালিয়ে দিত । উপায় না দেখে আমি খুব জোরে চিৎকার করে উঠলাম। সেখান থেকে সরে আসতেও তো পারছিলাম না। দোলনার তলায় পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ভাইকে ধরার চেষ্টা করছি আর চিৎকার করছি।
###
সে যাত্রায় ভাই বেঁচে গিয়েছিল। ভাই যখন পড়ে যাচ্ছিল মা এসে ধরে ফেলেছিল। মা না ধরলে ভাইয়ের মাথাটা মাটিতে পড়ে থেঁতলে যেত। উফ্ সেই দৃশ্য আজও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই।
আমি হাঁউমাঁউ করে কাঁদছি ভাই কে পড়ে যেতে দেখে। অথচ আমি কিচ্ছু করতে পারছি না। মা আসছেই না,,, আমার কথা শুনতেই পাচ্ছে না কী যে অসহায় অবস্থা হয়েছিল আমার সেদিন! বহুদিন আমি চমকে চমকে উঠতাম এই ভেবে যে ভাই পড়ে যাচ্ছে,,,, ভাই মরে যাচ্ছে,,,,,
ভাইকে কিন্তু আমি বাঁচাতে পারি নি। ভাই সেই চলেই গিয়েছিল একেবারের মতো,,,
এই ঘটনার পর আমাকে ঠাকুমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মা একা দুজনকে সামলাতে পারছে না এই অজুহাতে।