• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক টুকরো হাসিতে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – তেত্রিশ

টুকরো হাসি – তেত্রিশ

নিশ্চয়ই নেতা হবে

সুরমা বলল, ‘তোমার মনে আছে আমাদের ছেলে ছোটবেলায় কত সব কাণ্ড করেছিল?’
‘কত কাণ্ডই তো আছে তোমার গুনধর ছেলের। কোনটা বলছ?’
‘ওইটা তো আমার খুব মনে পড়ে। জনির ওই খেলা আমি কোনোদিন ভ্ললব না।’
‘জনি কে?’
‘আশ্চর্য! জনিকে চেন না? গোটা মহল্লার লোকজন ওকে জানে। জনি হচ্ছে আমাদের ছেলে গো।’
‘ওর আবার এই নাম কে দিল? ওর মামা?’
‘মামা দিলেই বা অন্যায় কি হত? এটা ওর মামাকে দিতে হয়নি। ও এখন বড়ো হয়েছে। আমাদের ছেলে নিজেই নিজের নাম রেখেছে। ছোটোবেলার তোমার বাবা তো কি একটা বিটকেল নাম রেখেছিল! জনার্দন। ওই নাম কি আর আজকাল চলে? এখন নাম কত আধুনিক হয়েছে। তোমার ছেলে অবশ্য ঠাকুরদাকে একেবারে হতচ্ছেদ্দা করেনি। নামটা একটু পালটে জনি রেখেছে। কত আধুনিক।’
‘ওটুকু না রাখলেও চলত। আমার বাবা তো আর দেখতে আসবে না। মরে বেঁচে গেছে।’
‘ওভাবে বলছ কেন? তোমার নামটাও তো আমি বিয়ের পরে কত সুন্দর করে রাখতে চেয়েছিলাম। পারলাম না। তোমার ওই বিটকেল রাঘব নাম থেকে সুন্দর একটা নাম কিছুতেই বের করা গেল না। আমার বড়দিকে একবার বলেছিলাম, দিদি ওকে রঘু নামে ডাকি? দিদি শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে বাতের ব্যথা নিয়েও আমাকে তেড়ে এল। জানলাম দিদির বাড়িতে যে দুধ দিতে আসে তার নাম রঘু। সেই কথা শুনে আমার কেমন খাটাল খাটাল গন্ধ ভেসে এল নাকে। নামটা আর রাখা হল না।’
‘রাখলেই পারতে । আমাকে তো সারাজীবন দুধের যোগান দিয়ে যেতে হবে।’
‘দেখ খাইয়ে কথা শোনাবে না। বিয়ের সময় অং বং করে জড়িয়ে মড়িয়ে কী বলেছিলে সেসব মনে আছে?’
‘মনে থাকবে কি করে? তোমার বাবার ঠিক করা সস্তার পুরুতঠাকুর হটর মটর করে কি বলেছিল তা মনে রাখার উপায় আছে? আমি কি সব বুঝতে পেরেছি?’
‘যখন মন্ত্র বলছিলে তখন এমন ভাব দেখাচ্ছিলে মনে হচ্ছিল একেবারে সংস্কৃতে পণ্ডিত।’
‘ওই ডামাডোলের আসরে আমি কি তখন সব শুনেছি না বুঝেছি। শুধু মুখে বিড়বিড় করেছি।’
‘সে যা শোনো আর না বলো ওসব মন্ত্রের মধ্যে একটা কথা ছিল সেটা আমার বড়দি বলেছে। সেটা হচ্ছে তোমার আমার হৃদয় এক সুতোয় বাধা হয়ে গেল। আর বউভাতের দিন সকালের কথা মনে নেই? বলেছিলে না আমার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব এখন থেকে তোমার। বললেই শুধু হবে? এড়াতে পারবে না, খরচা আছে।’
রাঘব চায়ের কাপ রেখে উঠল। বলল, ‘আমি উঠছি কাজ আছে।’
‘জনির কথাটা শুনলে না? আশ্চর্য! নিজের ছেলের কথা লোকে সব মন দিয়ে শোনে। তুমি একটা কি গো? কি রকম বাবা?’
রাঘব বসল। ‘কি বলবে বল।’
‘তোমার মনে আছে তুমি জনিকে যতই খেলনা খেলনা কিনে দিতে ও তো কিছুতেই তা নিয়ে খেলত না।’
‘তো কি হয়েছে? আমি কি খারাপ খেলনা কিনে দিতাম?’
‘এই দেখ কেমন উলটো বোঝে। আমার মনে পড়ল ও রান্নাঘর থেকে যত চামচে আছে সব নিয়ে এসে তাই দিয়ে খেলত। তুমি তো চামচে কিনে দিলে না। আমি তখন ওকে দু’ডজন চামচে কিনে দিয়েছিলাম। কি খুশি হয়ে ও চামচে নিয়ে খেলত তা ভাবতে পারবে না।’
এ কথার কি উত্তর দেবে রাঘব। সে শুধু বলল, ‘ওগুলি চামচে নয় । চামচ।’
‘ও একটা বললেই হল। জান স্কুলে একদিন কি করেছিল আমাদের জনি।’
‘কি?’
‘স্কুলে ভূগোলের শিক্ষক আসেনি তাই বদলে ক্লাসে অন্য একজন পড়াতে এসেছিল। তা পছন্দ না হওয়ায় জনি কয়েকজন ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাস থেকে ওয়াকআউট করে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। আমাকে তো প্রথমে বলেনি। অনেক পরে কথায় কথায় ওর কাছ থেকে জানতে পারলাম। তুমি ভাবতে পারছ আমাদের ছেলে স্কুলে থাকতেই আমাদের ছাড়া সিনেমা দেখতে শিখে গিয়েছিল।’ কথাটা বলে হিহি করে হাসল সুরমা।
সেদিকে তাকিয়ে রাঘব বলল, ‘এরমধ্যে তুমি হাসির কি দেখলে?’
‘আছে আছে আরও আছে। সেইসব ভেবেই তো হাসি পাচ্ছে। জনির বন্ধু বুলটাই মিত্তিরদের বাগান থেকে রেগুলার ফল চুরি করত। সেগুলো বিক্রি করে পয়সার ভাগ দিত জনিকে। ও চমকে ধমকে আদায় করত। একদিন বুলটাই দারোয়ানের হাতে ধরা পড়ল। দারোয়ান এসে জনিকে বলল, তুমি কি জান বুলটাই কতদিন ধরে কি কি ফল চুরি করেছে? আমাদের জনি সঙ্গে সঙ্গে যেন আকাশ থেকে পড়ল। বলল, বুলটাই কে?’ রাঘবের দিকে তাকাল সুরমা। হাসল। বলল, ‘জনির কি দারুন বুদ্ধি বল? সময় মতো বুলটাইকে চিনতেই পারল না! কেমন চোখ উলটে দিল!’
রাঘব বলল, ‘আমি উঠছি। তোমার কথা শুনতে একটুও ভালো লাগছে না।’
সুরমা বলল, ‘নিজের ছেলের কথা শুনতে তোমার ভালো তো লাগবেই না। তোমার মুখে খালি অমুকের ছেলে ফার্স্টক্লাস পেয়েছে। হ্যানো হয়েছে, ত্যানো হয়েছে। এইসব হয়ে কি হয়েছে? কেউ কি চাকরি পেয়েছে? সবাই তো রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর চাকরি চেয়ে রাস্তায় না খেয়ে শুয়ে আছে। যত্তসব। ভেবেছ আমি শুধু সিরিয়ালই দেখি। খবরও দেখি মশাই। সেগুলিও তো সিরিয়ালের চাইতে কম কিছু না। ও বাদ দাও। তারপরে যা বলছিলাম, বুলটাইয়ের কী হল জান? ওর বাবা ওকে এমন জায়গায় পাঠিয়ে দিল যে ওই দারোয়ান আর জীবনে বুলটাইকে খুঁজে পাবে না। বাগানের মালিক এসে ধরবে দারোয়ানকে।’
‘ভালো মজা হল তো! বললাম কাজ আছে। আমার এইসব ভ্যাজর ভ্যাজর শুনতে ভালো লাগছে না।’
‘শোনো অত কাজ দেখিও না। এটা শুনে তারপর যাও।’
‘আরও আছে?’
‘ওমা! আছে না? জনির এত কথা সাংবাদিকরা বলেও শেষ করতে পারবে না। সেবার যখন তোমার বোনের ছেলে ঘোতন এল।’
রাঘব সুরমাকে থামিয়ে বলল, ‘কেন সে তোমার ননদের ছেলে না? তা বলতে পার না?’
‘ওসব পাতি সেন্টু দিও না তো। ভাল্লাগে না। আসল কথা শোনো। আমাদের জনি ওর কাছ থেকে টাকা চেয়ে পায়নি বলে ঘোতনকে রেগে বহিরাগত বলে এমন মার মারল যে, সে পালিয়ে বাড়ি চলে গেল। তোমার বোন ভগ্নিপতি যখন আমাদের কাছে নালিশ জানাতে এল, তখন জনি কি বলেছিলে মনে আছে?’
‘না আমার ওসব মনে নেই। মনে রাখতে চাইনি।’
‘ভালো কথা তোমার মনে থাকবে কেন। মাথাটায় তো ঘিলু বলে কিছু নেই। জনি বলেছিল, আমি ওকে কেন মারব? কেন বাড়ি থেকে তাড়াব? ঘোতন তোমাদের ভুল বলেছে। আমার কালচারে ওসব নেই। কেউ এরকম করে নাকি? একজন কেন আরেকজনকে মারবে? তাড়িয়ে দেবে। কেমন ভালোমানুষের মতো নাটক করে বলেছিল জনি। তখন থেকেই কি চালাক যে হতে শুরু করেহিল ভাবলে গর্ব হয়।’
‘আহা! কী গর্ব! এমন ছেলেকে নিয়ে।’
‘গর্ব হবে না কেন? তোমার মনে আছে ওরা জনির কথা শুনে ঘোতনকেই খুব বকল।’
রাঘব কোন কথা না বলে উঠতে গিয়েও পারল না। সুরমা বলল, ‘তোমার এত তাড়া কিসের বল তো?’ এই বলে হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল। বলল, ‘তোমার দোলের সময়ের সেই কথাগুলো মনে আছে? বাজে রং নিয়ে খেলা চলবে না। খবরে এরকম বলেছিল। তোমার মনে নেই জনি তখন কি করেছিল। ট্যাবল নামের একটা ছেলেকে দিয়ে যত রাজ্যের ব্যাটারি জোগাড় করে সেগুলি আর বিচুটি পাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করে হালকা গন্ধ পাউডার মিশিয়ে সুন্দর প্যাকেটে করেছিল। ছেলেটাকে দিয়ে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করিয়েছিল ফুল দিয়ে তৈরি আবির বলে। ছেলেটার সঙ্গে আমাদের জনির একটা ছবি তোলা ছিল। ছেলেটাকে পুলিশ ধরেছিল। ঘটনাটা তুমি মনে করতে চাইছ না বুঝতে পারছি।’ সুরমা একটু থেমে দম নিয়ে বলল, ‘সবটাই খারাপ ভাবে না নিয়ে বরং সেই ভালো দিকটা ভাব। পুলিশ এসে যখন জনিকে জিজ্ঞাসা করল ওই ছেলেটার সঙ্গে তোমার ছবি কেন। জনি তখন কেমন কেতা করে বলেছিল, আমার সঙ্গে হাজার হাজার লোক ছবি তুলতে চায়। কখন যে কে পাশে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলেছে কে জানে! অত খেয়াল রাখা যায় না। যারা তদন্ত করতে এসেছিল তাদের তো তখন একগাল মাছি।’
রাঘব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। বলল, ‘তুমি শুধু শুধু আমাকে এইসব শোনাচ্ছ কেন? ফালতু কথায় আটকে রেখেছ। আমার তো শুনতে ভালো লাগছে না।’
‘তা লাগবে কেন? নিজের ছেলের উন্নতির জন্য কোনো ভাবনাই তো তোমার নেই।’
‘তোমার আছে?’
‘আলবত আছে। ওর আরও যা কার্যকলাপ সব তোমাকে বললে তোমার তাক লেগে যাবে। ও সবাইকে বলেছে এখন পি এইচ ডি করছে। এই কথা বলার জন্য সবাই ওকে এখন থেকেই কত খাতির করে।’
‘জনার্দন পি এইচ ডি?’ রাঘব কেমন শঙ্কিত হয়ে তাকাল সুরমার দিকে।
‘আমাকে তো ভালো করে সব বলতেই দিচ্ছ না।’
‘আমার শুনে আর কাজ নেই। এবার দয়া করে রেহাই দাও।’
‘শুনলে বুঝতে পারতে ও তোমার মতো সমান্য চাকরি করবার জন্য জন্মায়নি। দেখবে ওর হাতে একদিন অনেক ক্ষমতা থাকবে। ও প্রচুর টাকা পয়সা রোজগার করবার জন্য জন্মেছে। টাকা নেওয়ার সময় দু’হাতে না কুলিয়ে উঠতে পারলে তোয়ালেতে করে জড়িয়ে নেবে।’
রাঘব বলল, ‘ওরে বাবা! তুমি তোমার ছেলেকে নিয়ে এত কিছু বুঝে গেছ?’
‘আমাকে সব বাধ্য বুঝতে হয়। আমি ওর মা। আমার একটা দায়িত্ব আছে। তোমার মতো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরব নাকি?’
‘খুব ভালো বোঝাই বুঝেছ তুমি।’ রাঘব হতাশ হয়ে বলল।
‘বুঝলে মশাই এটা মাথায় রেখ আমি তোমার চাইতে বেশি বুঝি। আমার বাপের বাড়ির লোক সব জানে।আমার বোঝায় কোনো ভুল নেই।’
‘কি দেখে এত বুঝলে?’
‘তাহলে এতক্ষণ কি বলছিলাম? আমার জনির সব কাণ্ডগুলি দেখেই বোঝা যায় ও অনেক বড়ো হবে। দেখবে নিশ্চয়ই নেতা হবে।’
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *