• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৭১)

সোনা ধানের সিঁড়ি

১০৭

বাবা মারা যান ১৯৯৫ সালে। তখন গায়ক সুমন চট্টোপাধ্যায় আমার ভেতরে ষোলো আনা ঢুকে পড়েছেন। উঠতে বসতে চলতে ফিরতে —– সবসময় সুমন আওড়াতাম। সেইসময় তার যেকোনো গান আমার ঠোঁটের গোড়ায়। সেই মুহূর্তগুলোর কথা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না যখন আমার মাথার ওপর থেকে ছাদ উড়ে গেছে। বাবা তো আমার কাছে শুধু বাবার মতো নয়, অত বড় বন্ধু আমি জীবনে আর কখনও পাব না। আমার জীবনের সবকিছু যেন হারিয়ে গেছে। কিছুতেই নিজেকে জীবনের বৃত্তে ফেরাতে পারছি না। তখন যে মানুষটা আমাকে আলো দিয়েছিল তিনি হলেন গায়ক সুমন। তার গানের হাত ধরেই একমাত্র জীবনের ছন্দে ফিরে এসেছি। “হাল ছেড়ো না বন্ধু বরং কন্ঠ ছাড়ো জোরে” —– এই সেই গান যার হাত ধরে আমি আবার স্বপ্ন দেখতে শিখি। সেই জায়গাটা “আমারও তো বয়স হচ্ছে রাতবিরেতে কাশি/ কাশির দমক থামলে কিন্তু বাঁচাতে ভালোবাসি” —— শুনতে শুনতে আমি চোখের সামনে ওই অন্ধকারেও আলো দেখতে পেতাম। “বাঁচতে ভালোবাসি” —– এই দুটো শব্দে সেই বয়সে এতো জোর অনুভব করেছি যে মনে হতো গানের মানুষটা ইচ্ছা করলে হিমালয় পর্বতকেও যেন নড়িয়ে দিতে পারে। এমন জীবনের গান আমি আগে কোনোদিন শুনি নি। “বন্ধু তোমার ভালোবাসার স্বপ্নটাকে রেখো / বেঁচে নেবার স্বপ্নটাকে জাপটে ধরে থেকো / দিনবদলের স্বপ্নটাকে হারিয়ে ফেলো না / পাল্টে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেলো না” —— এইভাবে জীবনের কথা কে বলতে পেরেছে বাংলা গানে গানে? আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে আমি অন্তত শুনি নি।
জানলা খুলেই তাকে দেখতে পেয়েছি। রাস্তায় যেতে যেতে ফুটপাতে তাকে দেখেছি। এমন কত কতবার তাকে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দেখেছি চুপচাপ নিজের মনে বসে থাকতে। কিন্তু গানে গানে তাকে আমাদের জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলা সে তো শুধু সুমনই করতে পেরেছে —— “একমুখ দাড়ি গোঁফ / অনেক কালের কালো ছোপ ছোপ/ জটপড়া চুলে তার উকুনের পরিপাটি সংসার / পিচুটি চোখের কোনে দৃষ্টি বিস্মরণে মগ্ন / বাবু হয়ে ফুটপাতে একা একা দিনরাত রঙ্গে পাগল” —— আমাদের সকলের চোখের সামনে এ যেন এক নতুন মূল্যায়ন। আমাদের চোখ খুলে দেওয়া। “পাগল” সেই সময়ে মানুষের মুখে মুখে ঘুরতো।
সুমন যেন আমার আত্মার আত্মীয়। নয়ের দশকে ওইসময় প্রতিদিন মানুষটাকে নিয়ে কুৎসা ব্যঙ্গ কতই না হয়েছে। তখন রোজই তিনি কাগজের শিরোনামে। গ্রাম বাংলার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার গানকে বন্ধ করে দেবার কতই না চক্রান্ত। কারা করেছে সেসব আজকের দিনে নাই বা বললাম। তবে বাঙালির তো চিরকালের এই স্বভাব কোনো মানুষের সৃষ্টি বাদ দিয়ে তার ব্যক্তিগত জীবনের জানলায় উঁকি দেওয়া। সুমনের অন্ধ ভক্ত বলে বন্ধুরা আমাকে কত কি না বিরূপ মন্তব্য করত। কাউকে ছেড়ে কথা বলতাম না। সুমনের বিরুদ্ধে কিছু বললে সে আর আমার বন্ধু নয়। আজও মানুষটাকে মনের একই জায়গায় রেখে দিয়েছি। একচুলও তার অবস্থান বদল হয় নি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।