সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে ইন্দ্রাণী ঘোষ (অন্তিম পর্ব)

আরশি কথা

গাড়ীতে উঠে ঝোরা ও মেই লিং জানলার দুপাশে বসল. মাঝখানে অপূর্ব. ছেলেটার উপর দুজনেরই কেমন মায়া পড়ে গেছে. অপূর্বকে কাছে কাছে রাখতে পারলে দুজনেই কেমন স্বস্তি বোধ করে. “ব্ল্যাক প্রিন্স কে কোথায় রেখে এলে অপূর্ব? ‘
‘ নেপালে, আমাদের কটেজে. আমাদের চেনাশোনা লোকজন আছে ওখানে. অনেক ছোটবেলায় চোরাশিকারিরা ওর মাকে মেরে ফেলেছিল, তিনটে শাবককে উদ্ধার করে আমাদের কটেজে নিয়ে আসেন বাবা,’.’ তাই নাকি ‘ ঝোরা আর মেই লিং এর বিস্ময় কাটে না.’ ভিষণ সুইট ছিল ওরা, তিনটে কালো পশমের বলের মত ‘. আমি আর মামমাম ওদের ফিডিং বটলে দুধ খাওয়াতে গেলাম. ওরা তো বটল টানতেই জানে না. তারপর আঙুলের উপর ফোঁটা ফোঁটা দুধ ফেলে ওদের খাওয়াতেন মামমাম.. ওরা সবটুকু চেটে চেটে খেয়ে নিত. একটু বড় হতে ফরেষ্ট রেঞ্জার ওদের জঙ্গলে নিয়ে গেলেন. ব্ল্যাক প্রিন্স কিন্তু আমাদের কটেজ খুঁজে ঠিক চলে এল. তারপর থেকে আমাদের কটেজেই রয়ে গেল. মামমাম চলে গেলেন বিদেশে, আমি হষ্টেলে. কারুর ক্ষতি করে না ব্ল্যাক প্রিন্স. বাবা ওর খাবারের জোগান দেবার ব্যবস্থা রেখেছেন. ‘
‘ তুমি তো এখন দিল্লী যাবে অপূর্ব? তোমার মা এখন কোথায়? ‘মেই লিং জিজ্ঞেস করেন.
‘ হ্যা দিল্লী যাব, তারপর কয়েকটা কাজ সেরে আবার কটেজে ফিরব. ‘
‘ তোমার মা আসবেন না? ‘
এক আকাশ দু:খ ভরা চোখ নিয়ে মেই লিং আর ঝোরার দিকে তাকায় অপূর্ব, তারপর ঠোঁটের কোনে হাসি টেনে বলে,’ না: মামমাম আর কোনদিন আসবে না, আমার মায়ের নাম ড: মঞ্জরী বসু, উনি চিরকাল ওনার মেইডেন টাইটেল ইউস করেছেন. ‘

গাড়ীর ভিতরে বজ্রপাত হলেও ঝোরা আর মেই লিং এত চমকে যেত না.

ঝোরা আর মেই লিং এই সত্য জানার পর কি করে যে বাগডোগরাতে নেমেছিল, কি ভাবে বাড়ী পৌছেছিল আর কিছুই মনে নেই. দুজনেই শুধু ভেবে গেছে ওইটুকু ছেলে বুকে কত যন্ত্রণা চেপে মা কে উদ্ধার করতে ঝঁাপিয়ে পড়েছিল. আর যে ব্ল্যাকপ্যান্থার শাবককে মঞ্জরী জীবনে ফিরতে সাহায্য করেছিলেন তাঁকে বিষ দিতে গিয়েছিলেন. এ কেমন প্রজ্ঞা? কেমন দিপ্তী যা মঞ্জরীকে এমন উচ্চাকাঙ্খী, নিষ্ঠুর করে তুলেছিল? এই প্রশ্নের উত্তর ঝোরা আর মেই লিং খুঁজে পায় নি.
অপূর্ব সেদিন যাবার আগে মেই লিং আর ঝোরাকে দুটো কার্ড দিয়ে যায়, বলে ‘ ডকু রিলিজের দিন থাকতে পারব না, আপনারা ভালো থাকবেন’.

ডকুমেন্টারির রিলিজের অনুষ্ঠানের দিন, মঞ্জরীর কন্ডোলেন্স সবেতেই ঝোরা আর মেই লিং উপ্সথিত থেকেছেন. শুধু মঞ্জরীর পরিবারের কাউকে কোনদিন দেখতে পায় নি ওরা. মিডিয়াকে আর্কিওলজিকাল সার্ভের পক্ষ থেকে জানানো হয় মঞ্জরীর পরিবারে কেউ নেই. ওনার যাবতীয় পারলৌকিক ক্রিয়া কর্ম বৌদ্ধ মঠে হবে. আর মঞ্জরী উইল করে ওনার গবেষণার সমস্ত সত্ব, স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াকে দিয়ে গেছেন. কাগজে এবং অনান্য সংবাদ মাধ্যমকে জানানো হয় মঞ্জরীর মৃত্যুর কারন মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ. ব্যাপারটিকে নিয়ে ডি. আই. জি অমিতাভ ভট্টাচার্য্য একদম কোন অতিরঞ্জন করতে দেন নি মিডিয়াকে.

ডকুমেন্টারির রিলিজের অনেকদিন পর মেই লিং আর ঝোরা ছাদে বসেছিল চায়ের কাপ হাতে. আকাশে অনেক উপর দিয়ে একটা প্লেন উড়ে যাচ্ছিল. মেই লিং ঝোরাকে জিজ্ঞেস করেন ‘আজ কত তারিখ?’ ‘আজ সেভেন্থ,’ ঝোরা বলে.
‘আজ অপূর্বর দিল্লী যাবার কথা,’
দুজনেই আকাশের দিকে তাকায়, হাত জোড় করে বলে ‘ছেলেটা ভালো থাকুক, উন্নতি করুক.’ দুজনের কানেই মঞ্জরীর আক্ষেপ বাজে ‘আমার তো আর সংসার করা হল না’. হয়তো মঞ্জরী ফিরতে চেয়েছিলেন ফেরা হল না. হায় রে মানুষের মন, চাওয়া পাওয়ার কি যে জটিল হিসেব.
আকাশের বুক থেকে চোখ নামিয়ে চুপ করে বসে থাকে ঝোরা আর মেই লিং. সুর্য্য অস্তরাগ মাখায় অপূর্বর প্লেনের যাত্রাপথ ধরে.

সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।