মানুষ সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে বুদ্ধির চেয়ে বলের উপর ভরসা রেখেছে বেশি৷ তাকে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে, অন্য জীবজন্তুর সঙ্গেও৷ অথচ সবচেয়ে যুগান্তকারি আবিস্কার করতে মানুষকে বুদ্ধির দ্বারস্থ হতে হয়েছিল৷ পাথরে পাথর ঠুকে জ্বালিয়ে ছিল আলো৷ বুদ্ধির প্রকাশ হলে তো এইভাবেই অন্ধকার সরে যায়৷ তখন না ছিল কোন প্রযুক্তি না ছিল রূপরেখা ৷ শুভু মাত্র বুদ্ধির নির্দশে খাওয়ার বাসনপত্র থেকে, অস্ত্রশস্ত্র, ঘরবাড়ি, গয়না, টাকা কী না বানাতে শিখেছিল !
তবু মানুষের কাছে যে বস্তু সহজলভ্য তার প্রতি আকৃষ্ট হয় খুব তাড়াতাড়ি৷ তার এই বিচিত্র প্রবণতার হাত ধরতে আপাত বলশালী মানুষেরা সবক্ষেত্রে বল প্রয়োগকে অস্ত্র হিসিবে বেছে নিল৷ শারিরীক গঠনের জটিলতায় এবং প্রকৃতিক কারণে তখন থেকেই আপাত বলশালী মানুষেরা কর্তৃত্ব ফলানোর ঠিকেদার হয়ে উঠল৷ এর ফলে তিনটে ঘটনা ঘটল যা মানুষের ইতিহাসের ঐতিহ্যকে অধোগতির দিক ক্রমশ ঠেলে নিয়ে গেলে-
প্রথমত বুদ্ধির মত সূক্ষ্ম এবং তীক্ষ্ণ প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষ উদাসীন হল, ভরসা কমল৷
দ্বিতীয়ত জোর যার মুলুক তার এই প্রবাদ বাক্যেকে জীবনের বেদবাক্য ধরে নিয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি দৈহিক ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষগুলো শাসনের ছড়ি ঘোরাতে নেমে পড়ল ময়দানে৷ সমাজে আসল বৈষম্য৷ দুর্বল সবলের ওপর, মালিক চাকরের ওপর, ধনী দরিদ্রের ওপর এবং পুরুষ নারীর ওপর৷
তৃতীয়ত সূক্ষ্ম চিন্তা ভাবনা, প্রচেষ্টা, বিচার বিবেচনা, বোধের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে সর্বতোভাবে বিশ্বাস করতে শিখল গায়ের জোয়ারীর শর্টকাট রাস্তায়৷
প্রাচীন ভারতে, সাধারণভাবে বলা হয় বৈদিক যুগে নারীর স্থান ছিল খুব উপরে । পিতৃতান্ত্রিক সমাজে কন্যাসন্তানের জন্ম অনভিপ্রেত হলেও তার যত্ন ও লালনপালনে কোনো ত্রুটি থাকত না । তার শিক্ষার দিকে যথেষ্ট নজর দেওয়া হত । ঘোষ, অপালা, বিশ্ববারার মতো নারীরা বৈদিক শ্লোক রচনা করেছিলেন । উপনিষদের যুগে গার্গীর মতো দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটেছিল । তিনি যাজ্ঞবল্ক্যের মতো পণ্ডিতের সঙ্গে বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছিলেন । উচ্চবর্ণের মহিলারা তাঁদের স্বামীর সঙ্গে যাগযজ্ঞে অংশ নিতেন । তাঁরা সম্পত্তির অধিকারিণীও ছিলেন এবং স্বামীর মৃত্যুর পর ইচ্ছা করলে পুনর্বিবাহ করতে পারতেন । কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীর অবস্থা ক্রমে নিম্নাভিমুখী হতে থাকে৷ সমাজে শূদ্র ও নারীদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল । নারীকে বলা হত ‘ভার্ষা’; অর্থাৎ, ভরণীয়া বা যাকে ভরণ করতে হয় । তার স্বাধীনতা বলে কিছু ছিল না । শিশুকালে সে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বয়সকালে বা বৈধব্য জীবনে পুত্রের অধীন । এই সময় থেকেই বস্তুত শুরু হল ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রহেলিকা৷ যখন কেউ একজন আর একজনকে বহন করছে বলে দাবি করে তখনই নিঃশব্দে ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রচার শুরু হয়ে যায়৷
মৈত্রায়নী সংহিতা-য় অনেক বার বলা আছে, নারীশরীর নারীর নিজের নয়, তাই যৌন নিপীড়ন থেকে তার নিজেকে বাঁচানোর সুযোগ নেই। নারীমাত্রই অশুভ প্রতীক গণ্য হতেন, যেমনটা ছিল কুকুর, শকুনির মতো অশুভ পাখি, বেজি। ইদুরের মতো প্রাণী ও শূদ্রের বেলায়। এদের মধ্যে যে কোনও একটির হত্যাজনিত পাপের প্রায়শ্চিত্ত ছিল সমান৷ তৈত্তিরীয় সংহিতা স্পষ্ট ভাষায় লিখেছে, নারী কেবলমাত্র যৌনসম্ভোগের বিষয়৷
জাতক-এর গল্পগুলোতে এমন একটি সমাজের ছবি আঁকা হয়েছে যা মূলত মেয়েদের প্রতি নির্মম। এর বেশির ভাগ গল্পেই আছে শারীরিক নির্যাতনের দৃষ্টাস্ত; কয়েকটিতে মানসিক নিপীড়নের ছবিও আছে। যেমন, একটি তরুণীকে প্রেমে পড়ার অপরাধে অগ্নিপরীক্ষায় বাধ্য করা হয়েছিল। সে যে একটা কৌশলে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে তা একজন ব্রাহ্মণ দেখে ফেলে এবং তাকে ধাক্কা মেরে প্রেমিকের কাছ থেকে সরিয়ে আগুনে ফেলে দেয়।
আমি নারীবাদী নই আর নারীবাদী হওয়া মানে মেয়েদের শক্তিশালী করা নয়, তাঁরা এমনিতেই শক্তিশালী। আমি শুধু সমাজকে দর্পণ দেখাতে চাইছি ? পুরুষদেরকেও এবং নারীদেরকেও৷ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীকে ভোগ্যপণ্য সাব্যস্ত করেছে, প্রজননের যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে, সে কি সেই পরিচয়েই খুশি ? ভেবে দেখুক নারী৷ এই আজন্ম শরীরে জড়িয়ে থাকা ভার্যার, বা বংশ বৃদ্ধির যন্ত্র লেভেলটা এঁটেই কি অশ্রদ্ধা ঘৃণা নিয়ে বাঁচতে চায়, নাকি মৃত্যুর দিনটাতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নারী পুরুষ সকলের চোখ জলে ভিজে আসুক, কোনটা সে চায় ভেবে দেখুক৷ যদিও আজ বহু পুরুষ তার ভাবনাধারাকে মুক্তধারার স্রোতে ভাসিয়েছে, আলোকিত হয়েছে তাদের মন নারী সম্পর্কে৷ তার পেছনে অবশ্য নারীর সফলতা জ্বালানীর মত শক্তি জোগান দিয়েছে৷ পাইলট থেকে সাংবাদিক, শিক্ষক থেকে মন্ত্রী সব ঘুঁটিগুলো ছুঁয়েছে নারী আজ৷ আর যেসব পুরুষ এখনও পৌরুষত্বের পুরাকাহিনী আগলে রেখেছেন মিথ্যে অহংকারে তাদের প্রত্যেকের প্রতি আমার প্রশ্ন, থাকল আপনার স্ত্রীকে শুধুই প্রজননের য়ন্ত্র ভাবতে আপনি ঠিক কতটা গর্ব বোধ করেন ?