• Uncategorized
  • 0

গদ্যের পোডিয়ামে অয়ন ঘোষ

অন্ধের হস্তী দর্শন

কবিতা যে ঠিক কি তা আজ পর্যন্ত কোনো কবি, পাঠক ও সর্বোপরি কোনো সম্পাদক বুঝেছেন বলে মনে হয় না। আমরা বাস করি একটা সংজ্ঞায়িত পৃথিবীতে। কিন্তু কবিতার তো কোনো সংজ্ঞাই নেই। যদি বা থেকেও থাকে সেগুলো সবই অন্ধের হস্তী দর্শনের মতো অবস্থা। যাঁদের লেখা পড়ে বা বিচার ধারা পড়ে একটু হলেও বুঝতে শিখেছি তাঁরা সকলেই দ্বর্থ্যহীন ভাষায় জানিয়েছেন তাঁদের অক্ষমতা। তারপরেও গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। প্রচুর গাছ কাটা পড়েছে এর রূপের ব্যাখ্যা করতে বা ব্যাখ্যা করতে না পেরে পুরো ঘেঁটে দিতে। এখন একই কারণে প্রচুর ফ্রি ডেটা বা virtual ফ্রি স্পেস গলে যাচ্ছে। আমার দাদু গ্রামের মানুষ ছিলেন, কোন কোন বিষয়ে বিরক্ত হলে বলতেন, সামনে দিয়ে সূঁচ গলতে না দিলে কি হবে পিছন দিয়ে হাতি গলে যাচ্ছে। বাংলা কবিতার এখন ঠিক তেমন অবস্থা। এমনিতেই সাহিত্যে চিরকালই একটা দ্বন্দ আছে text আর theory এর মধ্যে। যতদূর জানি চর্যা বা Anglo Saxon যুগে theory এর কনসেপ্ট ছিল না। কবিতা বা কথা কিন্তু হৃদয়ের কথাই বলতে এসেছিল বা যাপনের কথা। আলতামিরার গুহাচিত্র যিনি এঁকেছিলেন তিনি কি theory বুঝে এঁকেছিলেন? না আঁকেননি। তারপর বুদ্ধির গোড়ায় যত জল দিয়েছে মানুষ, তত theory র পলকা ডালে সওয়ার হয়ছে। ক্রমে ক্রমে সাহিত্যবেত্তারা ভুলতে বসেছেন বুদ্ধিবৃত্তির বাইরে একটা হৃদয়বৃত্তির গল্প আছে আর সেইটিই ছিল শুরুর কথা। একশ বার মানছি theory বা ঋদ্ধ সমালোচনা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে, তাকে নতুন করে দেখার দর্শন দিয়েছে। কিন্তু একটা কথা বুকে হাত রেখে বলুন তো text এর আগে কি অন্য কিছু আছে? যখন লেখেন তখন কি theory র বোঝা মাথায় চাপিয়ে লেখেন। তারপর পড়াতে এসে দেখলাম হটাৎ করে theory নিয়ে বেজায় মাতামাতি। ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক সবাই মজা করে বলতে গেলে Mrs. Malaprop হয়ে গেছেন। সারাদিন theory র কচকচি, কচি থেকে বুড়ো সবার মাথায়। সিলেবাসে পারলে সবটাই theory রেখে দেয়। Basic সাহিত্য যেনো পরের ঘরের মেয়ে, রবিবারের মতো দেরি করে আসবে। Wordsworth বা Coleridge এর কবিতা না পড়েই Preface to Lyrical Ballads বা Biographia Literaria নিয়ে বাণী দিচ্ছে লোকজন। তারপর de Saussure, Derrida, Barthes, নিয়ে উদ্বেল সাহিত্য জগত।
ভারী গোলমেলে লাগতে শুরু করলো তখন। এ প্রসঙ্গে ব্রহ্মসূত্র নিয়ে একটা কথা বলি, তাহলে পরিস্থিতির সম্যক ধারণা দিতে পারব। উপনিষদের ভাবগুলোকে একটা পূর্ণ দার্শনিক আকার দেবার প্রয়োজনীয়তা প্রাচীন কালেই হয়েছিল। ব্রহ্মসূত্রের জন্ম এই ভাবেই। সূত্রের আকারে সাজালে স্মরণ শক্তিকে কম খাটতে হয়। সূত্রের উদ্দেশ্য ছিল বিস্তারিত ভাবকে সংক্ষিপ্ততম আকার দেওয়ার। সূত্রের আকার যত সংক্ষিপ্ত হত তার সার্থকতা তত বেশি কারণ তাতে মুখস্ত করার পরিশ্রম কমে যায়। কালক্রমে এই সংক্ষিপ্ত করার আগ্রহ সেকালের পণ্ডিতদের মধ্যে এমন করে পেয়ে বসেছিল যে, সংক্ষেপ – করণটাই তাদের কাছে মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সূত্রের অর্থ হয় কি না – হয়, সে বিষয়ে তারা সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে পড়েছিলেন। একটি সূত্র হতে একটি মাত্র অক্ষরকে বর্জন করতে সক্ষম হলে তারা নাকি পুত্র সন্তান প্রাপ্তির সমান আনন্দ পেতেন। বাংলা কবিতায় এখন ঠিক এমন একটা বিপ্লব চলছে, একটা শব্দের পাশে তার হাজার মাইলের আশেপাশে নেই এমন একটা শব্দকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারলে নোবেল প্রাপ্তির সমান আনন্দ। যুক্তি, কেন Metaphysical রা কি করেননি, Georgian Movement এর সময়, Art for Art’s Sake Movement এ, Movement Poets, Anti- Poetry, Boudelaire, Mallarme Paz এরা কি কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন নি? হ্যাঁ করেছেন, একশ বার করেছেন, কিন্তু পরীক্ষা করবার জন্যও কিন্তু শুধু বুদ্ধি না, মনন লাগে, মন লাগে আর সব থেকে বড় কথা সামঞ্জস্যের জ্ঞান লাগে। শব্দের সাধনা লাগে। না হলে গোটা পরীক্ষাগারে কিন্তু আগুন লেগে একশা হবে। ফেভিকুইক দিয়ে কি সব জোড়া যায়! আপাতত একই গল্প কবিতার ক্ষেত্রে চলছে। কবিতা নিজেকে ঘষে মেজে বৌদ্ধিক করতে গিয়ে ক্রমশ হৃদয়কে অস্বীকার করেছে। একজন পাঠক হিসেবে জানি বাঁক বদল প্রয়োজন নিজের অস্ত্বিত টিকিয়ে রাখার জন্য, নিজের কাছে নিজের কথা নতুন করে বলার জন্য। ওই যে কিছু বাণী আমরা মুখস্ত করে ফেলেছি, “কবিতা সবার জন্য না”, “কবি নিভৃতচারী”, “পাঠকের কাছে তার কোনো দায় নেই, সে নিজের জন্য লেখে”। এগুলো সব ভাবের ঘরে চুরি করা সুলভ কথাবার্তা। তাই যদি হবে তাহলে নিজের লেখা ছাপার অক্ষরে দেখার জন্য প্রাণ এতো কাঁদে কেন বা এখনোকার দিনে সামাজিক মাধ্যমে প্রতি মুহুর্তের আপডেট কেন? তার মানে পাঠক আমরা সবাই চাই কিন্তু তার সাথে এটাও চাই পাঠকের কোনো ইচ্ছে থাকবে না। ছাইপাঁশ যা গেলাবো পাঠক তাই গিলবেন, বাধ্য ছাত্রের মতো। আর যদি না গেলেন সোজাসুজি বলে দেবো, ও কিছু বোঝে না বা কবিতা বোঝার মতো বোধ এখনো তৈরি হয়নি। একজন বিখ্যাত ইংরেজ কবি বলেছিলেন কবিতা best word in best order কিন্তু তার অপব্যাখ্যা যে এই ভাবে হবে তা ভাবেন নি। যদি বাংলা কবিতার কথা বলি অতি আধুনিক বা আভা গাড হতে গিয়ে এক কথায় word juggling এ ভর্তি। এক শব্দ থেকে অন্য শব্দে পৌঁছাতে গিয়ে পাঠক বা কবি নিজেই হোঁচট খেয়ে কোমর ভাঙবে নিশ্চিত। এক ইমেজারি হয়ে অন্য ইমেজেতে এমন দৌড় যে বোল্টও ধরতে পারবে না নিশ্চিত। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে খবরের কাগজের কিছু কিছু শব্দ নিয়ে কাট, কপি, পেস্ট করেছে। যত বেশি কিম্ভুত দর্শন, তার “আহা বাহা উহু” তত বেশি। এই সব পরীক্ষার ঠেলায় কবিতার অবস্থা তোতা কাহিনীর তোতাটির মতো। কবেই সে মরে গেছে তার খেয়াল কেউ রাখেনি। আর পাঠকের অবস্থা তো আর শোচনীয়। কিন্তু কিচ্ছুটি বলতে পারবেন না, বললেই আপনাকে ঘিরে ধরবে এবং বলবে আপনি কিচ্ছু বোঝেন না, নির্বোধ। যিনি একটু আধটু রবিঠাকুর, কিটস, শেলী এমনকি এলিওট, জীবনানন্দ বুঝলেন, তিনি এগুলো বুঝবেন না? বলবে, না বুঝবেন না। এখন বাংলা কবিতা অনেক উঁচুতে তুরীয় অবস্থায় আছে। বুঝতে গেলে সাধনা চাই। ব্যাপারখানা এমন হলো যে কিটসের viewless wings of poesy তে চাপতে গিয়ে Bacchus and his pards এর ঘাড়েই সওয়ার। আবার এমনটা হতে পারে রবি ঠাকুরের সুদূরের পিয়াসী হতে গিয়ে ছাদের কার্নিশও টপকালো না ঘুড়ি। মানে, অমিত কিন্তু কথায় কথায় নিবারণ চক্রবর্তীর নোটবই বার করত, নতুন সম্পাদক তো, একেবারে বাঁধ ভেঙে দিতে চায়, খাড়া লাইনের, ঋজু শব্দের কবিতায়। কিন্তু তাকেও আসল সময় পুরনো বুড়ো কবিরই স্মরণ নিতে হয়েছিলো। নিবারণ চক্রবর্তী মরেছিল শৌখিন জলজ মাছের মতো। কোনো কোনো সম্পাদক তো নিজেকে Criterion এর সম্পাদক বা Pound এর থেকেও ক’মাত্রা উঁচুতে রেখেছেন। উত্তর আধুনিক, উত্তর উত্তর আধুনিক নানারকম শব্দবন্ধে কবিতার কালঘাম ছুটে যাওয়ার অবস্থা। এনাদের সফট টার্গেট দেশীয় বা বাসীয় নামক পত্রিকাগুলি। বাংলা কবিতা যারা চর্চা করে তাঁদের প্রত্যেকেরই সুপ্ত বাসনা থাকে দেশীয় হবার বা নিদেন পক্ষে বাসীয় হবার, সে তাঁরা মানুক বা নাই মানুক। গোপনে দু’চারটি চিঠি ওদের ঠিকানায় যায় -ই যায়।তারপরে “জ্যেষ্ঠপুত্র” সিনেমার সেই বিখ্যাত ডায়ালগ, ওখানে বিক্রি হতে না পারলে গালাগাল। ওটাই সহজ পদ্ধতি এখন শোক ভোলার। তাঁদের কথা অনুযায়ী বাদবাকি সব প্রচারিত ও প্রসারিত কাগজের সম্পাদকরা ঠিকঠাক ভাষায় এক একটি চার অক্ষর, কবিতার ‘ক’ এর আঁকশিটা পর্যন্ত তারা বোঝেন না। নোবেল, বুকার কমিটিতে যারা আছেন তারা আর বড় বড় গাধা। কবিতার যদি কেউ পরিত্রাতা থেকে থাকেন তাহলে ওনারা আছেন এবং ওনাদের পত্রিকাতে যে অদ্ভুত দর্শন বকচ্ছোপ কবিতাগুলো ছাপা হচ্ছে, সেগুলিই একমাত্র কবিতা বাকি সব ছাইভস্ম। ব্যাপার খানা এমন হলো কবিতার স্বর্গের বাগান থেকে কবিদের পতন হয়েছে নরকে, দেবীর রোষে। আর ওনারা হচ্ছেন আধুনিক কবিতার Messiah, পরিত্রানায় সাধুনাম থুড়ি কবিতানাম করতে এই ধরায় আবির্ভূত হয়েছেন। মাননীয় চন্দ্রিল ভট্টাচার্য্যের কথায়, ফেসবুকে এখন চলছে তাৎক্ষণিক বক্তৃতার উৎসব আর হাততালি দেবার জন্য আছে ভাড়া করা লোকজন। এগুলো সেরকমই। এদের, কাকে বলছি, কি বলছি এসবের কোনো ভাবনা নেই। হাওয়া গরম করা কিছু বলে দিলেই হলো। বলিহারি, বলার আগে একটুও কি বুক কাপে না? যাই হোক বাংলা কবিতা ওদের হাতে নির্বাণ লাভ করুক। আমরা সাধারণ পাঠক রইলাম নিস্ফোলের হতাশের দলে। আসুন কিছু পুরনো কবিতাই পড়ি, আরাম পাবেন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।