অনেকদিন ধরে মেয়ে আবদার জুড়েছে একটা গল্প লিখে দিতে হবে। আবদারটা আসলে মেয়ের নয়। ওর বন্ধুর বাবার। আমার লেখালিখির ব্যাপারটা ভদ্রলোকের কানে পৌঁছে দিয়েছিল মিমি।
মিমি মানে আমার দশ বছরের বাক্ পটিয়সী কন্যা। কতবার বলেছি নরমে- গরমে,কথার গাড়িটা একটু আস্তে ছোটা। কে কার কথা শোনে? কথার তোড়ে কখন যে কি বেফাঁস বলে ফেলে সেটাই চিন্তার। এইরকমই একদিন কথার গাড়ি ছোটাতে গিয়ে মধুর কানে কথাটা তুলে দিয়েছিল মিমি। সেই কথা আবার দু’কোট রঙ চড়িয়ে বাবার কানে তুলেছিল মধু।
সেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসতে দেখে বেশ অবাকই হলাম। ফোন ধরে ‘ হ্যালো’ বলতেই ওপার থেকে ভেসে এল – নমস্কার দাদা। আপনার মতো গুণী মানুষের সাক্ষাৎ যে এতো সহজে পেয়ে যাব ভাবতেই পারিনি।
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম – আপনি ভুল নাম্বার ডায়াল করেছেন।
– আরে না না দাদা, আপনাকেই বলছি। আপনি এত বড় একজন লেখক। কত নামী-দামী পত্রিকায় আপনার লেখা ছাপা হয়।
– না,না সেরকম কিছুই নয়। অবসর সময়ে যেটুকু সময় পাই লিখি একটু আধটু। ওটা আমার পেশা নয়। কিন্তু আপনার পরিচয়টা?
– দেখেছেন কান্ড! নিজের পরিচয়টাই দিতে ভুলে গেছি। আমি মধুর বাবা। মধু মানে মিমির স্কুলের বেস্ট ফ্রেন্ড মধুরিমা মন্ডল। মল্লিক বাজারেই থাকি। আপনি তো স্কুলে বড় একটা আসেন না। ব্যস্ত মানুষ বুঝতেই পারি। তবে আপনার স্ত্রীর সাথে পরিচয় আছে।
মনে মনে ভাবছি কথা বলার প্রতিযোগিতা হলে কে জিতবে? মিমি না এই ভদ্রলোক?
বললাম – হ্যাঁ-হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি। বলুন কি ব্যাপার?
– আসলে আমি ছোটোখাটো একটা পত্রিকা চালাই।নিজেই সম্পাদক। আপনার লেখা পেলে খুব খুশি হব।
– ঠিক আছে। নতুন কিছু লিখলে আমি আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব। এই মুহূর্তে আমার কাছে কোন অপ্রকাশিত লেখা নেই।
– খুব খুশি হলাম দাদা।
সেই থেকে ভদ্রলোক মাঝেমাঝেই লেখার জন্য তদ্বির করেন। নিজে তো ফোন করেনই, মধুকে দিয়েও তাগাদা দেন। জানেন ভায়া মিমি হয়ে বললে কাজটা অনেক তাড়াতাড়ি হবে।
ভদ্রলোকের ভাবনায় ভুল নেই। মিমি এঁটুলি পোকার মতো লেখার জন্য আমার পিছনে পড়ে আছে। বেস্ট ফ্রেন্ডের কাছে নাহলে ওর প্রেস্টিজ চলে যাবে। তবে আমিই বা এত লেখা পাই কোত্থেকে? অফিসের কাজ সামলে আর গল্প লেখার মানসিকতা থাকে না। তার উপর মন মেজাজটা একদমই ভালো নেই।
অনেক আশা নিয়ে একটা মাসিক পত্রিকা বার করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। আমার এক বন্ধু সন্দীপের অনুরোধেই আসরে নামা। সন্দীপ বলেছিল, সম্পাদকের দায়িত্বটা আমাকেই নিতে হবে। আর বাকী কাজগুলো ও সামলাবে। বিজ্ঞাপন যোগাড় করার কাজটা সন্দীপই করবে। বাড়তি যদি কোন টাকা খরচ হয় তাহলে সে টাকা ও-ই দেবে। ওর কথা মতো কাজে নেমে পড়লাম। বেশ কিছুদিন এদিক ওদিক ছোটাছুটি করলাম। পরিচিত মহল থেকে লেখা পত্তরও যোগাড় হল। অফিস কামাই করে বেশ কিছু বিজ্ঞাপনও যোগাড় করে আনলাম। অফিসের কাজ সেরে প্রুফ রিডিং, এডিটিং এর কাজ চলল সারা রাত ধরে।
সব কাজ যখন শেষের মুখে, প্রথম সংখ্যা বার হবার দিনক্ষণও ঠিক, সেই সময় সন্দীপ এসে বলল, আরো কিছু বিজ্ঞাপন না পেলে পত্রিকা বার করার খরচ উঠবে না। আশায় আশায় বসে রইলাম। দিন গেল, মাস গেল কিন্তু পত্রিকা আর প্রকাশ হল না। সব আশা প্রায় ছেড়েই দিলাম।
সেই থেকে মনটা একদম ভেঙে গেছে। কোন কাজে মন বসাতে পারি না; লেখালেখি তো দূরের কথা। লিখব যে নতুন কোন প্লট আর মাথায় আসে না।
সেদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে চোখ দুটো বন্ধ করে এই সবই ভাবছিলাম। এমন সময় গিন্নী ঢুকল রাজ্য জয় করে। বাপের বাড়ি থেকে এক ঘন্টা ট্রেন জার্নি করে ফিরলেন তিনি। ঘরে ঢুকেই মেজাজ সপ্তমে- ঘর দোরটা একটু গুছিয়ে রাখতে পারো না? বিছানার অবস্থা কি করে রেখেছো দ্যাখো!
হাতে ম্যাগাজিনের মত কিছু একটা আছে। সেটাই এখন তাঁর হাত পাখার কাজ করছে। মাথার ওপর ঘুরতে থাকা ফুল স্পীডের পাখাও গিন্নীকে শীতল করার পক্ষে যথেষ্ট নয়।
বিছানার ওপর ধপ করে বসেই আমার দিকে ভুরু জোড়া তুলে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল – মেয়েটাকে একটু পড়তে বসিয়েছ না সারাক্ষণ শুধু আদিখ্যেতাই করে গেছ ওর সাথে?
আমার সোহাগ চাঁদ মেয়েটা এতক্ষণ এই ঘরেই ছিল। মা বাড়িতে না থাকলে ওর সোহাগের মাত্রাটা বাড়ে। গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় এমন আব্দার করে যে না দিয়েও পারা যায় না। আজকের আব্দারের তালিকায় দুটো জিনিস ছিল। এক – টক জল দিয়ে ঝাল ফুচকা আনানো আর দুই- এক ঘন্টার জন্য কার্টুন চ্যানেল দেখার অনুমতি দেওয়া। এই দুটো আব্দারই আবার গিন্নীর দু’চোখের বিষ।
আমি আমতা আমতা করে বললাম – সারা সন্ধ্যেই তো পড়েছে একটানা। এ ঘরে আসেইনি একবারও।
গিন্নী ধরাম করে টিভির সুইচটা বন্ধ করে দিল। আমার মুখটা একপ্রস্থ ঝলসে দিয়ে বলল- আজকাল তুমিও কার্টুন চ্যানেল দেখা শুরু করেছ বুঝি?
যেটুকু বোঝানোর সেটা ওই চাহনিতেই স্পষ্ট করে দিয়ে পাশের ঘরে চলল- মেয়ের পড়া কত দূর এগিয়েছে সেটা সরজমিনে তদন্ত করতে।
হাতের ম্যাগাজিনটা বিছানাতেই পড়ে রইল। সেদিকে তাকাতেই চোখটা একটা জায়গায় স্থির হয়ে গেল। হাতে তুলে নিলাম পত্রিকাটা। ‘সেঁউতি’ নামটা আমিই ঠিক করেছিলাম আমাদের পত্রিকার জন্য। একই নাম এই পত্রিকাটারও। ধুস! আবার একটা নতুন নাম ভাবতে হবে আমাকে। নতুন কোন পত্রিকা দেখলেই আমি উল্টে পাল্টে দেখি ; কোন নতুন ধারনা পাওয়া যায় এই আশায়। সব কাজের দায়িত্ব তো সন্দীপ আমাকেই দিয়ে রেখেছে।
পাতা ওল্টালাম। ভিতরের পাতায় বেশ বড় করে একটা বিজ্ঞাপন আছে। ভারী আশ্চর্য লাগছে। এই কোম্পানীর সাথে তো আমি নিজে গিয়ে কথা বলেছিলাম। ওরা আমাদের প্রস্তাবে রাজীও ছিল। এখন আমরাই পত্রিকা প্রকাশ করতে পারিনি। তাই হয়তো এরা এই পত্রিকার সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে। পরের পাতা ওল্টালাম। লেখা আছে, সন্দীপ দত্ত কর্তৃক ৬, বনমালী সরকার স্ট্রীট, কলকাতা-২ থেকে প্রকাশিত। এই ঠিকানাতে বসেই তো আমরা কজন পত্রিকার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, অথচ পত্রিকাটি যে প্রকাশিত হয়েছে সেটা সন্দীপ আমাকে একবারও জানালো না। নাকি সারপ্রাইজ দেবে বলে বেমালুম চেপে গেছে ব্যাপারটা?
চমকের আরো অনেক উপাদান মজুত রয়েছে। সব কিছু একদম ঠিকঠাক আছে। যেমনটি আমি বলে দিয়েছিলাম ঠিক সেই রকম। এতটুকু হেরফের হয়নি কোন। বদল শুধু, একটা জায়গাতেই আছে ; সেটা সম্পাদকের নামের জায়গাটায়। দেখছি, দেখছি, দু’চোখের সমস্ত দৃষ্টি ঢেলে দেখছি। সম্পাদকের নামের তালিকায় আমার বদলে অন্য একজন বিদগ্ধ ব্যক্তির নাম শোভা পাচ্ছে।
মেয়েটা অনেকক্ষণ ধরে ফোঁপাচ্ছিল। খেয়াল করিনি। পিঠে গুম করে একটা কিল পড়েছে ওর। হোমওয়ার্কের খাতায় ‘সান্ত্বনা ‘ বানান ভুল লিখেছে। মা রান্না ঘরে যেতেই আমার কাছে এসেছে সান্ত্বনা খুঁজতে। অথচ আমি কি সান্ত্বনা দেব নিজেই জানি না। মেয়েটার চোখের কোল দুটো ভিজে আছে আর আমার কাঁদবার ইচ্ছে হলেও কাঁদতে পারছি না। শুধু মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে আমিও কোন এক অদৃশ্য সান্ত্বনা খুঁজে বেড়াচ্ছি।
মিমির মাথায় আলতো করে বিলি কেটে বললাম – কাল সকালে একটা গল্প তোকে দিয়ে দেব স্কুলে গিয়ে মধুকে দিয়ে দিস।
মিমি আমাকে ছেড়ে স্থির হয়ে বসল ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না যে আমি ওকে গল্প লিখে দেব।
– তুমি যে বললে তোমার মাথায় কোন প্লট আসছে না?
– আসছিল না সোনা। এখনি একটা দারুণ প্লট মাথায় এসে গেল। আজ রাতে বসেই শেষ করে ফেলব গল্পটা।