উত্তরের পাহাড় তো অবশ্যই সুন্দর। কিন্তু কমতি যায় না দক্ষিণের পাহাড় ও। চোখ জড়ানো সবুজে সমৃদ্ধ দক্ষিণের পাহাড়। তারমধ্যে পুরুলিয়া পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে অন্যতম। আরও জনপ্রিয় হলো পুরুলিয়া হিলটপ। লোক মুখে বলতেই এই জায়গা ঘরে ফেরে। সবুজে ঝর্ণায় এক সুন্দর মনরোম পরিবেশ। এছাড়াও এখানে বিখ্যাত হলো ছৌ-নাচ। বেশির ভাগ মানুষই পুরুলিয়া যান ছৌ-নাচ উপভোগ করার লোভে। আমরা শুধু ছৌ-নাচ নয় পাহাড়ের লোভ ও ছিল দারুন। চারপাশের এই সুন্দর পাহাড়ের ওঠা-নামা আর অরণ্যের বিস্তার দেখতে দেখতে শেষ মেষ ৫টা নাগাদ পৌঁছালাম পুরুলিয়া হিলটপ বাসস্ট্যান্ড এ। জায়গা ছোট খাটো কিছু জনবসতি নিয়ে গড়ে উঠেছে। খুব বেশি জমজমাট না হলেও বেশ নজর কারা পরিবেশ। চারিপাশের কোলাহল থেমে একটা মন শান্ত করা পরিবেশ। সেই শেষ বিকেলে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সূর্য্য অস্ত তখনো যেন অপূর্ব।
ওখানে সব থাকার হোটেলের নিচেই খাওয়ার ও ব্যবস্থা আছে। চাইলে সব আয়োজন ই সম্ভব। আমরা বাসস্ট্যান্ড এর কাছাকাছি ই একটা হোটেল নিলাম। নানারকম রেঞ্জ এর হোটেল পাওয়া যায়। দৈনিক ৫০০, ৬০০, ৭০০, ১০০০ যার যেরকম সুবিধা।
তবে কেউ যদি খুব ভালো জায়গায় থাকতে চান তার জন্য আছে কিছু সরকারি লজ্। নীহারিকা, মালবিকা, আর বৈভবী এই হলো সরকারি লজ্ এর নাম। চাইলে সেটা কলকাতা থেকেও বুক করে যাওয়া যায়।
বাকি সব স্থানীয় হোটেল এর তুলনায় এগুলো অনেক ভালো ও উন্নত মানের। ভাড়া টা অনেকটাই বেশি। বেশির ভাগেরই সাধ্যের বাইরে।
তবে আমার যেই হোটেলে ছিলাম তার নাম হোটেল পরিবার, মোটামুটি বেশ ভালোই। আমরা কলকাতা থেকে কিছুই বুক করে যাই নি। ওখানে গিয়ে খুঁজে নেওয়াই যায়। তবে যদি একদম সিজিনাল সময়ে যাওয়া হয় সেক্ষেত্রে হোটেল পেতে সমস্যা হতে পারে। সেই সময় গেলে আগে কলকাতা থেকে হোটেল রিজার্ভ করে রেখে যাওয়াই উপযুক্ত।
যাই হোক হোটেল পরিবার এর নিচেই খাবার হোটেল ও ছিল। মোটামুটি পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন। সবরকম খাবারেরই ব্যবস্থা আছে।
এখানে একটা দারুন জিনিষ ছিল বন ফায়ার। আগে থেকে হোটেলে টাকা দিয়ে বলে রাখলে ওরা ব্যবস্থা করে দেয়। এই বন ফায়ার হলো মাঝ খানে কাঠ পাতা দিয়ে জড় করে আগুন জ্বালায় এবং তার ওপর মুরগির রোস্ট। বেশ রোমাঞ্চ পূর্ণ অভিজ্ঞতা। আর শীতকাল হলে চারিপাশের পরিবেশ এর সাথে দারুন মানান সই।
তাই আমরাও এই অভিজ্ঞতা উপভোগ করার জন্য হোটেলে সেই ব্যবস্থা করতে বলে দিয়েছিলাম। এটা মোটামুটি বিকেল নাগাদ করে হোটেল কর্মকর্তাদের বলতে হয়। তাহলে ওদের এরেঞ্জ করতে সুবিধা হয়।
আমার এর পর হোটেলে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে তারপর কি করবো সেই ভাবার সন্ধানে এক দারুন তথ্য পাই।
যেহেতু পুরুলিয়ার বিখ্যাতই হলো ছৌ-নাচ তাই ওখানকার সব হোটেলেই এই ছৌ-নাচ দেখার বন্দোবস্ত আছে। মোটামুটি ৩০০০-৪০০০ টাকার একটি প্যাকেজের বিনিময়ে তারা এই ছৌ-নাচ এরেঞ্জ করে। ওখানকার বেশ সংখ্যক লোকের পেশাই হলো ছৌ-নাচ গোষ্ঠী। তাই এটি বেশি আগে বলতে হয় না। মোটামুটি কিছু সময় আগে হোটেল কর্তৃপক্ষ কে জানালে তারা এই দৃশ্য উপভোগ করার ব্যবস্থা করে দেয়।
এখানে বলে রাখা ভালো, যদি হোটেলে আরও কিছু ফ্যামিলি পাওয়া যায় তবে সেক্ষেত্রে টাকা শেয়ার করলে অনেকটা কম খরচায় হয়। আর হোটেল থেকেও বেশ কয়েকটি পরিবারের মিলিত উদ্যোগে ওরা ছৌ-নাচ দেখার বন্দোবস্ত করে।
আমরাও রেস্ট নিয়ে চাঙ্গা হয়ে বেরোলাম ছৌ-নাচ দেখার উত্তেজনা নিয়ে। পাহাড়ের ওপরে সেরকম আলো এবং মঞ্চ এর আশা করা বৃথা। তাই কেউ যদি ভেবে থাকেন যে টিভি এর মত ছৌ-নাচ অনুষ্ঠিত হবে সেইক্ষেত্রে তারা ভুল প্রমাণিত হবেন।
শিল্পীর শিল্প সত্ত্বা তাই বলে কোন অংশে কম নয়। তবে ওই কথায় বলে না জাঁকজমক যত বেশি ঝোঁক তত বেশি। সেরকম আরকি। তবে আমরা বেশ মহানন্দেই উপভোগ করেছিলাম ছৌ-নাচ। একটি ছোট মাঠের ওপর অনুষ্টিত হয়েছিল এই নৃত্য। আর সাথে ছিল দুদিকের দুটি বড় বড় হেলজেন লাইট। অপূর্ব সুন্দর তাদের নৃত্য পরিবেশনা। প্রত্যেকটা নৃত্যের মধ্যে ফুটিয়ে তোলা কিছু সুন্দর পৌরাণিক তথ্য। মুখোশের আড়ালে একেক সব বিশাল প্রতিভা। এক কথায় সত্যি অনবদ্য। সেই ছৌ-নাচ পরিলক্ষিত করার এক দু ঘন্টা মন আর চোখ আমাদের আটকে ছিল সেই সব কলাকুশলীদের প্রতি। ছৌ-নাচ শেষে আমরা তাদের সাথে নিজেদের ফ্রেম বন্দি করেছিলাম।
অবশেষে ছৌ-নাচ দেখে ফিরলাম হোটেলে। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ৮:০০টা। শীতের কনকনে পরিবেশে বেশ উত্তেজনা ময় পরিবেশ। এক সুন্দর আবহাওয়া। হোটেল কর্তৃপক্ষ জানালো বন ফায়ার এর সবরকম এরেঞ্জমেন্ট কমপ্লিট। আমরাও আর দেরি না করে উপস্থিত হলাম সেখানে। একটা জায়গায় মধ্যে আগুন জ্বলছে আর তার চারিদিকে গোল করে চেয়ার পাতা রয়েছে। কিছুক্ষন পর হোটেলের একটি ছেলে এসে মাংস এর ব্যবস্থা করলো এবং সেখানে রোস্ট এর ব্যবস্থা করলো। এরকম একটি পরিবেশে সূরা পান যে আরও আকর্ষণীয়। আমাদের জন্য সেই ব্যবস্থাও বলা হয়েছিল। মোটামুটি এক-ঘন্টা চলেছিল বন্ধুদের হাসি মজা ও সূরা পান। এমন শীতের রাতে বেশিক্ষন আর খোলা হাওয়ায় বসা যাচ্ছিল না। তাই আমরা রাত দশটার মধ্যে ডিনার শেষ করে হোটেলে ফিরে এলাম।
হোটেলে ফ্রেশ হয়ে সেদিন আর বেশি কিছু খোশগল্প চলে নি আমাদের। এমনিতেই এতক্ষনের জার্নি, তাই বেশ টায়ার্ড ছিলাম সকলেই।
তারপর আবার পরের দিন ছিল পুরুলিয়া ঘোরার উদ্দেশ্য। গাড়ি অনেক সকাল সকাল আসার কথা। এখানে বলে রাখি ওই হোটেলে বললেই ওরা গাড়ির ব্যবস্থাও করে দেয়। ছোট গাড়ি হলে দু-দিনের জন্য ৩৫০০ টাকা আর বড় গাড়ি হলে ৪০০০ টাকা। আমাদের লোকসংখ্যা অনুযায়ী আমার বড় গাড়িই নিয়েছিলাম।
তাই সেই উত্তেজনা নিয়ে সকলেই তাড়াতাড়ি নিদ্রা যাপন করেছিলাম।