মহিম বলল,‘ডাক্তারবাবু আমার খুব টেনশন হচ্ছে। টেনশনটা কিছুতেই কাটছে না। বিশ্বাস করুন আমি মোটেও মিথ্যা বলছি না। আমি তো নেতাদের মতো বলতে পারব না যে বউকে নিয়ে আমার টেনশন তাকে চিনি না। আর তাছাড়া আমার কোনো কালো টাকা নেই যে শুধু শুধু পকেটের পয়সা খরচ করে আপনাকে দেখাতে আসব।’
‘আমি কি একবারও আপনাকে বলেছি যে আপনি মিথ্যা বলছেন? আপনি তো ভালো মানুষ। আমার চারশো টাকা ভিজিট শুনেও আপনি আরও একশো টাকা বেশি দিলেন। আমিও বলেছি ওই টাকাতেই আপনার যতক্ষণ না রোগ সারবে আপনি ততবার আমাকে দেখাতে আসতে পারবেন। আমি আপনার কাছে আর ভিজিট চাইব না।’ কথাটা বলে ডাক্তারবাবু হাসলেন। বললেন,‘আমি আপনার রোগ নিশ্চয়ই সারিয়ে দেব।’
মহিম বলল,‘আমি বুঝতে পারছি না আমার টেনশন কি করে কাটবে। বাড়িতে যতবারই আমি আমার বউকে দেখছি ততই যেন টেনশন বেড়ে যাচ্ছে। সে তো ডাক্তারের কাছে আসতে চাইছে না। তার সবরকম চিকিৎসার উপরেই ঘেন্না ধরে গেছে।’
‘এইজন্য তো আমি আপনাকে ওষুধ লিখে দিয়েছি। কিনে খেয়েছেন?’
‘খাব না! আপনি ডাক্তার, মানে দেবতা। আপনার কথা না শুনলে হয়? খেলেও টেনশন আমার পিছু ছাড়ছে না।’
ডাক্তারবাবু চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘মনে হচ্ছে আপনার অ্যালোপ্যাথিতে কাজ হবে না। হোমিওপ্যাথিটা একবার অ্যাপ্লাই করতে হবে।’
‘আপনি হোমিওপ্যাথিও জানেন?’ মহিম অবাক হয়ে বলল।
‘আমি কি জানি এটা বড়ো কথা নয়। এসব নিয়ে আপনি একবারও জানতে চাইবেন না। তাতে আপনার টেনশন আরও বেড়ে যাবে। আমি যা জিজ্ঞাসা করছি তার উত্তর দিন।’
‘বলুন কি জানতে চান।’
‘আপনার ঠাকুরদা কি নাকে নস্যি নিয়ে হাঁচি দিতেন?’
‘আমি ঠাকুরদা যে কি তা বু্ঝবার আগেই তিনি মারা যান। তবে শুনেছি তিনি নস্যি নিতেন।’
‘নস্যি নেওয়ার পরে মোট কটা হাঁচি দিতেন, তা বলতে পারবেন?’
‘আমি বলতে পারব না।’ মহিম বলল,’ এই নিয়ে ছোটোবেলা থেকে কেউ কিছু আমাকে বলেনি।’
‘আপনার ঠাকুরমা। তিনি হাঁচি দিতেন।’
‘হ্যাঁ দিতেন।’ মহিম বলল।
‘তবে!’ ডাক্তারবাবু মাথা দুলিয়ে রহস্যজনক ভাবে হাসলেন। বললেন, ‘দিতেই হবে। আমার কখনো ভুল হতে পারে? আমি ঠিক ধরেছি। আচ্ছা তিনি একবারে মোট কটা হাঁচি দিতেন?’
‘তা গুনবার সুযোগ পাইনি। ঠাকুরমা হাঁচি দিতে খুব লজ্জা পেত। কেউ যাতে না শুনতে পায় তাই হাঁচি চাপতে গিয়ে কুঁই করে নাক দিয়ে একটা শব্দ হত। তাই শুনে হাসি চাপতে না পেরে আমরা ভাইবোনেরা ছুটে পালাতাম।’
‘কেন? পালাতেন কেন? আপনার কি ওই হাঁচি শুনে খুব টেনশন হত?’
‘তখন ছোটোবেলার টেনশন ফেনশন নিয়ে অত মাথা ঘামাতাম না।’
‘তাহলে পালাতেন কেন?’
‘ভাবতাম আমাদের হাসতে দেখলে ঠাকুরমা নিশ্চয়ই খুব দুঃখ পেত। তাহলে হয়ত আমাদের আর নারকোলের নাড়ু দিত না। এইজন্যেই পালাতাম।’
ডাক্তারবাবু মহিমের দিকে হতাশ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বললেন,‘না এই কথায় টেনশনের সিমাটম খুব একটা কিছু বোঝা গেল না। তবু আপনাকে আমি একটা ওষুধ দিচ্ছি। লিকুইড। এটা এককাপ জলে ঢেলে সেটার তিন ভাগের দু’ভাগ ফেলে দেবেন। দুপুরে খাওয়ার আগে বাকিটা খাবেন। দেখবেন আপনার আর টেনশন থাকবে না।’
ডাক্তারবাবুর চেম্বার থেকে বেলা বারোটায় বাড়ি ফিরল মহিম। করোনা সকালের জামা প্যান্ট পরিস্কার করে স্নান করে নিল।
দেখল যমুনা ঘরে থম মেরে বসে উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে। দেখে তার দুঃখ হল। দু’দিন আগেও খুব চনমনে ছিল। আনন্দে ছিল। করোনারোধে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে শুনে সেখানে লাফাতে লাফাতে গিয়েছিল।
তখন মহিম বলেছিল, ‘না বুঝে শুনে যেখানে সেখানে যেও না।অপেক্ষা কর আমি দেখছি কোথায় দেওয়া যায়।’
‘তুমি যেদিন খোঁজ আনবে সেদিন করোনার থাবায় আর আমি বেঁচে থাকব না।’ এই বলে একাই গট গট করে বেরিয়ে গিয়েছিল।
ভ্যাকসিন দিয়ে এসে কি আনন্দ। এরসঙ্গে উপরি পাওনা ছিল ওর প্রিয় নায়িকাকে দেখতে পাওয়া। যমুনাকে খুব খুশি খুশি লাগছিল। নায়িকার পরেই ও টিকা নিয়েছে। এই কথা সে মহিমকে দশবার বলেছে।
মহিম এখনকার নায়িকাদের মুখ মনে রাখতে পারে না।
যমুনা বলেছিল, ‘ওই যে গো আমরা দু’জনে বসে একটা সিরিয়াল দেখতাম না, গ্রামের ওপারে এইরকম কি একটা নাম ছিল তার নায়িকা।’
মহিম কিছু না বুঝতে পেরেও মাথা নেড়েছিল। বলেছিল, ‘আচ্ছা আচ্ছা।’
তারপর যমুনা সারাদিন ফোন করে বাপের বাড়ির গুষ্টির সবাইকে জানিয়েছে। ডায়েরি খুলে নম্বর দেখে দেখে সবাইকে ফোন করে বলেছে নায়িকার সঙ্গে তাঁর ভ্যাকসিন নেওয়ার কথা।
সেদিন চায়ে চুমুক দিয়ে টিভির খবর দেখে চক্ষু চড়কগাছ। যে ভ্যাকসিন সেদিন ঘটা করে নেওয়া হয়েছে তা নাকি আসল নয়। তার বদলে যা দেওয়া হয়েছে তাতে কিডনির বারোটা বাজতে পারে। হয়ত এমনও হতে পারে যে আজীবন কানে শুনতে পাবে না। লিভারটাও ভালো নাও থাকতে পারে। এই সব শুনতে শুনতে যমুনা বলেছিল, ‘জান তো মনে হচ্ছে আমার শরীর কাঁপছে। দুটো কানের ভিতর কেমন যেন ভোঁ ভোঁ করছে। আমি কি তাহলে কিছুই শুনতে পাব না? ইস কত সিরিয়াল। আমি ডাবিং করা বহিরাগত সিনেমা সিরিয়ালের একটা ডায়লগও শুনতে পাব না?’ কান্না কান্না মুখ করে বসেছিল যমুনা। সেই থেকে যমুনাকে নিয়ে টেনশন মহিমের।
নিজের টেনশন কমাতে হোমিওপ্যাথি ওষুধ নিয়ে কাপের জলে ঢালছিল মহিম।
তাই দেখে যমুনা চিৎকার করে বলল,‘আমি কিন্তু কোনো ওষুধ খাব না। সব ওষুধে ভেজাল আছে।’
মহিম বলল,‘এই ওষুধ তোমার জন্য নয়। ওটা আমার।’
তোমার! সে তো তুমি নিজের জন্য আনবেই। স্বার্থপর কোথাকার। এদিকে আমি মরছি হাজার টেনশনের জ্বালায়। সেদিকে খেয়াল নেই।’
তোমাকে নিয়েই তো আমার টেনশন। তুমি গেলে কেন ওখানে? কিছু না বুঝে ভ্যাকসিন নিতে।’
দেখলাম হাসি হাসি মুখের ছবির পোস্টার লটকানো আছে, তাই তো গেলাম। যাব না। তোমার জন্যই তো সব হল।’
‘আমার জন্য?’
‘তুমি বলেছিলে কেন যে ভোট দেওয়া আমার গণতান্ত্রিক অধিকার। তাই নিজের লোককেই তো ভোট দিয়েছি। ছবিটা দেখেই তো গেলাম। আমি যখন ভোট দিয়েছি ভাবলাম বিনেপয়সায় তোমাকে আমাকে ভ্যাকসিন দেবে। তাই তো গেলাম। নিজের ঘরের ইয়ে মনে করে। এখন তো দেখছি ভোটের পরে সবটাতেই পালটি খাচ্ছে।’ একটানা কথা বলে যমুনা চিৎকার করে উঠল। বলল, ‘দেখ আমারও না ওই নায়িকার মতো পেটের ভেতর ঘুটুর ঘুটর করছে।’ কথাটা বলেই অনেক কষ্টে যমুনা হাসল। বলল, ‘একসঙ্গে ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য শরীরে প্রতিক্রিয়া যদি একইরকম হয় তবে নায়িকার সঙ্গে আমার কত মিল বল। আচ্ছা কোনো সাংবাদিক কি ক্যামেরাম্যান নিয়ে আমার কাছে আসবে না? তবে আমি সিরিয়ালে অভিনয়ের ইচ্ছেটা এই সুযোগে জানাতাম।’
যমুনার কথা শুনে হোমিওপ্যাথি ওষুধ পুরোটাই ঘোত করে খেয়ে নিল মহিম। টেনশনে গান গেয়ে উঠল, যমুনাকে কি বলেছিল ভ্যাকসিন নিতে কেউ? ভ্যাকসিন নিতে একাই গেল, সাথে ছিল না ফেউ।
যমুনা বলল,‘জান আমার খুব টেনশন হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার মাথা থেকে পা অবধি গোটাটাই একটা বড়ো টেনশন। আমার জন্য তোমার তো কোনো গা নেই।‘
মহিম বলল, ‘গা থাকবে না কেন? তুমিই তো আমার কাছে মূল টেনশন। এখন তো রাজ্য বা রাষ্ট্র কেউই কোনো দায় নেবে না। আমি আসছি।’ মহিম তিন লাফে দরজার বাইরে গিয়ে, হাজির হল ডাক্তারের চেম্বারে।
‘আবার আপনি! কি হল টেনশন করছেন কেন?’
‘আমার তো টেনশন কমেছে না। মনে হচ্ছে আরও বেড়েছে।’
‘তবে তো আপনাকে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ও যোগ এই দু’টির মধ্য দিয়ে যেতে হবে।’
‘সেই ডাক্তার আমি এখন কোথায় পাব?’ মহিম কাতর হয়ে বলল।
‘কোথায় পাবেন মানে! আমি তো আছি।’ ডাক্তারবাবু বললেন।
‘আপনি এইসবও করেন? এত চিকিৎসা করবার জন্য আপনার কোন রেজিস্ট্রেশন নম্বর আছে? না বিনা ডিগ্রিতেই ভোগা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।’
মহিমের কথা শুনে ডাক্তারবাবু একটু গম্ভীর হলেন। বললেন,‘আগে বলুন তো দেখি, আমি ডাক্তার না আপনি ডাক্তার?’
মহিম বলল,‘আপনি।’
‘তবে! আমার কথা চুপ করে শুনুন। আমি আপনাকে একটা তেল দিচ্ছি। একটু উৎকট গন্ধ হবে।ওটা মাথায় মেখে শীর্ষাসন করবেন। এটা করার সময় লুঙ্গি পরা চলবে না। এটা মাথায় রাখবেন।’
‘কোনটা? লুঙ্গিটা?’
‘আঃ। না। আমি যা বললাম সেই কথাটা। আসন করা হলে আবার তেলটা মাথায় মাখবেন। হয়ত একটু ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল হতে পারে। তবে দেখবেন টেনশন একেবারে হাওয়া।’
‘ভুয়ো ভ্যাকসিন দেওয়ার ত্রাসে বউ আমাকে বাড়িতে দেখলেই সহ্য করতে পারছে না। রাতে ঘুম আসছে না আমার। একেই বউ এখন যে অবস্থার মধ্যে আছে সেটাই আমার কাছে বড়ো টেনশন।তার উপর ওই উৎকট গন্ধের তেলে শীর্ষাসন! আমি পারব না ডাক্তারবাবু।’
‘পারতে আপনাকে হবেই। দেখবেন কেমন ফুরফুরে মেজাজে থাকেন। ঘুম আসবেই।’
‘ঘুম আসবে? কখন?’
‘যখন টেনশনকে নিয়ে বিছানায় শোবেন না। তখন।’
মহিম বলল,‘ডাক্তারবাবু টেনশনকে কি তবে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেব?’