• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে সমীরণ সরকার (পর্ব – ৯)

সুমনা ও জাদু পালক

পুরনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে সুমনা। বাবার কথা খুব মনে পড়ে যায় তার।কতদিন বাবার মুখে গল্প শোনা হয় না। মাকে তো গল্প বলতে বললেই চোখে আঁচল চাপা দেয়। মায়ের হয়তো মনে পড়ে যায় বাবার কথা। বেশি জোরাজুরি করলে যে কোন অজুহাত দেখিয়ে মা রান্নাঘরে ঢুকে যায় ।সুমনা জানে মা পালিয়ে গেল একলা একলা কেঁদে বুকটা হালকা করার জন্য।
বাবা টা কোথায় হারিয়ে গেল? কিভাবে হারিয়ে গেল? কেন হারিয়ে গেল?
সরকার বাড়ির বড়কর্তার বড় ছেলে কাজল দাদাবাবু শহরে মাষ্টারি করে। মা তো তার কাছে গেছিল একদিন বড় গিন্নিমার কথায়।
কাজল দাদাবাবু বলেছিল,ঝঝ্ঝ থানায় ডায়েরী করতে হবে, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে হবে, আরো কত কি। আর এ সমস্ত করতে গেলে নাকি বাবার একটা ফটো চাই। বাবার তো আলাদা কোন ফটো ঘরে ছিল না। একবার বাবা তাদের নিয়ে পৌষ সংক্রান্তির জয়দেবের মেলাতে ঘুরতে নিয়ে গেছিল। সেবারে মেলায় ঘুরে খুব আনন্দ হয়েছিল সুমনার। তা সেবারে একটা ছোট্ট তাঁবু খাটানো ঘরের সামনে নানা রকমের ফটো টাঙ্গানো দেখে সুমনা মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “ওটা কি মা?”
মা উত্তর দেওয়ার আগেই বাবা বলেছিল, ওটাকে স্টুডিও বলে।
—- কি হয় ওখানে?
—- ফটো তোলা হয়।
—– ওই বাইরে যেমন ঝুলছে, ওরকম ফটো?
—- হ্যাঁ।
—— সবার ফটো তোলে?
—– হ্যাঁ ,যে বলবে, তার ফটো তুলে দেবে।
—– আমাদের একটা ফটো তোলো না বাবা।
মা বাধা দিয়ে বলেছিল, না না, কোন দরকার নেই ।কে জানে,অনেক টাকা পয়সা নেবে বোধ হয় ফটো তুলতে।
বাবা বলেছিল, দাঁড়াও ,একটু শুধিয়ে আসি ।মেয়েটা যখন আবদার করেছে..……!
তাঁবুর দরজার পাশে টেবিল পেতে ,একটা হাতল ভাঙ্গা কাঠের চেয়ারে বসে, লাল রঙের জামা গায়ে একটা লোক নাগাড়ে চিৎকার করে যাচ্ছিল, “আসুন আসুন, সস্তায় ফটো তুলে যান। দু’ ঘন্টার মধ্যেই হাতে গরম ফটো ডেলিভারি পেয়ে যাবেন। ঝাঁ-চকচকে ফটো । নিজের ফটো নিজেই দেখে চোখ ফেরাতে পারবেন না। মেলা দেখা শেষ করে ফটো হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।………..!
অনেকেই ঘিরে আছে লোকটাকে। বাবা এগিয়ে গিয়ে লোকটার সঙ্গে কি যেন বলা-কওয়া করল। লোকটা বাবাকে নিয়ে তাঁবুর দরজার পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ পরে ওই লোকটার সঙ্গেই বাবা বেরিয়ে এল তাঁবুর ভিতর থেকে।
মায়ের কাছে এসে হাসি হাসি মুখে বাবা বলল, “চলো ফটো তুলে আসি”
—— তা হ্যাঁগো , ফেরার সময় বাসে ট্রেনে টিকিট কাটতে টাকা লাগবে ,আজ সারাদিনের থাকা-খাওয়ার খরচ আছে, সব হিসেব করে টাকা-পয়সা দেখে নিয়েছো তো?
হাঃ হাঃকরে হেসে ওঠে বাবা বলেছিল , “জয়দেব মেলায় একবার পৌঁছে গেলে থাকা খাওয়ার জন্য কোনো চিন্তা করতে হয় না‌গো! কোনো-না-কোনো আখড়ায় থাকার জায়গা আর দুবেলা খিচুড়ি প্রসাদ ঠিক জুটে যাবে।”
বাবার পিছু পিছু তাঁবুর ভেতরে ঢুকেছিল মা আর সুমনা। তাঁবুর ভেতরটা খুব সুন্দর করে সাজানো ছিল। ছোট-বড় কত রকমের ফটো ঝুলছিল তাঁবুর গায়ে ।সুমনাকে মাঝখানে রেখে মা ও বাবাকে দু’পাশে বসিয়ে ফটো তোলা হয়েছিল।পরদিন বাড়ি ফেরার সময় ওখান থেকেই ফটো নিয়েছিল বাবা। একটা বড় ফটো আর তিনটে ছোট । বড় ফটোটা শহর থেকে বাবা বাঁধিয়ে এনে দেয়ালে টাঙিয়ে দিয়েছিল। ছোট ফটোগুলো ছিল মায়ের টিনের বাক্সে। সেই বাক্স থেকে খুঁজে পেতে একটা লাল হয়ে যাওয়া ফটো কাজল দাদাবাবু কে পরেরদিন দিয়েছিল মা ।সেই ফটো থেকে বাবার ফটোটা আলাদা করে নাকি থানায় জমা দিয়ে ডায়েরি করেছিল কাজল দাদাবাবু। খবরের কাগজে ফটো ছাপিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে নাকি অনেক টাকা লাগবে বলে শেষ পর্যন্ত সেটা আর দেওয়া হয়নি ।
থানায় ডায়েরি করার কয়েকদিন পরে একদিন একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন তাদের বাড়িতে। মাকে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি। মায়ের সঙ্গে কোনো ঝগড়া ঝামেলা হয়েছিল কিনা বাবার, গ্রামে বা বাজারে কোথাও টাকা পয়সা ধার আছে কিনা— এমনি আরও কত কি। মা ধীরে সব কথার জবাব দিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরেই চলে গেছিলেন ওই ভদ্রলোক। তা তারপর থেকে তো বহুদিন কেটে গেছে ।এখনো তো কোন খোঁজ পাওয়া গেল না ‌বাবার।
রাধামাধব মন্দিরের দেওয়ালের গায়ে অনেক ছোট ছোট পুতুল লাগানো আছে।’রাম রাবণের যুদ্ধ’, ‘ হনুমানের গন্ধমাদন পাহাড় নিয়ে আসা’ ‘ভীষ্মের শরশয্যা’, ‘মাছের চোখ দেখে অর্জুনের লক্ষ্যভেদ করা,’ ‘ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল কেটে গুরু দ্রোণাচার্য কে গুরুদক্ষিণা দেওয়া ‘এমনি কত কাহিনীর পুতুল লাগানো আছে সেখানে। এমনি অনেক পুতুল তো জয়দবের মেলায় গিয়ে ‘রাধাবিনোদ মন্দিরে’ ও দেখেছে সুমনা ।বাবাকে জিজ্ঞাসা করায় বলেছিল, ওগুলোকে টেরাকোটা না কি যেন বলে। সুমনা যখনই রাধামাধব মন্দিরে আসে ঘুরে ঘুরে ওই পুতুলগুলো দেখে। ওর মনে হয়, ওই পুতুল গুলো যেন কিছু বলবে তাকে।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।