• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ২৫)

আমার মেয়েবেলা

মেয়েবেলা লিখতে বসেছি আর ফরাক্কার কথা আসবে না এ কী হয়। ওখানেই তো নিজের মতো করে আমার জীবনের সবটুকু আনন্দ উপভোগ করেছিলাম। ওখানেই আমার মেয়েবেলার স্বর্ণযুগ শুরু হয়েছিল। প্রথম স্কুলে যাওয়া ,,প্রথম বড়ো হওয়া,,প্রেমে পড়া
ওখানেই।

আমাদের ফরাক্কায় তখন একটাই স্কুল। আমরা ব্যারেজের ছেলে মেয়েরা একসঙ্গেই পড়েছি ফরাক্কা ব্যারেজ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে।
সাদা জামা নীল স্কার্ট সাদা মোজা আর কালো জুতো। কোঁকড়ানো চুলে সাদা ফিতে বেঁধে আমি ভাই এর হাত ধরে সকলের সঙ্গে দল বেঁধে হেঁটেই যেতাম স্কুলে।
তখন আমরা দশ নম্বর রাস্তায় থাকতাম। স্কুলটা সেই সময় বেশ দূরেই মনে হত আমার। এক পেট ভাত খেয়ে হাঁটতে বেশ কষ্ট হত। অতটা রাস্তা! আমরা দুজন(ভাই আর আমি) সুখ দুঃখের গল্প করতে করতে আসতে আসতে যেতাম। অন্য দাদা দিদিরা এগিয়ে যেত।
আমরা এই সময় খুব মজা করতাম। একদম নিজের মতো করে যেন বাঁচা। স্কুলের পথে একটা বড়ো ঝিল পড়ত। যেটা আমাদের দুজনেরই যেন প্রাণ ছিল। পাড়ে বসে
হাঁসেদের সাঁতার কাটা দেখতাম। মাঠের মধ্যে গোল গর্তে লুকিয়ে থাকা শামুক দেখতাম। ভাই বলত বুঝলি দিদি ওটা শামুকের বাড়ি। বড়ো ঝিলটায় ছোট ছোট পাথর ছুঁড়ে দেখতাম কার পাথর বেশি দূরে যায়। মাঝে মাঝে আমি ইচ্ছে করেই হেরে যেতাম। কোনও কোনও দিন আবার হারতাম না। ওর হেরে যাওয়া মুখটা দেখে হাসি পেত। ঠোঁট ফুলিয়ে বলত দাঁড়া বড়ো হই দেখবি তোকে হারিয়ে দেব।

হারিয়েই দিয়েছিল। এমন ভাবে হারিয়ে দিয়েছিল যে পাথর ছোঁড়াই ভুলে গেলাম। এখন কোন বড়ো পুকুর বা ঝিলের দিকে তাকাতে ভয় পাই। মনে হয় ও খিলখিল করে হেসে উঠবে। কিংবা পাথর কুড়িয়ে এনে বলবে এই দেখ্ এটা তোর ছোঁড়া পাথর আর এটা আমার।
ভাই খুব ধীরে ধীরে হাঁটত। হাতে একটা ছোট্ট বল থাকত। কোন সময় একটা পাতলা কঞ্চি। একটা পাথর বলের মতো করে মারতে মারতে নিয়ে যেত। আমি বলতাম চল্ না। স্কুল থেকে এসে ক্রিকেট খেলবি। ঝিলের ধারে ঝুঁকে মাছ দেখতে গেলে আমি কিন্তু তখন কিছুতেই ওর হাতটা ছাড়তাম না। ভয় করত যদি জলে পড়ে যায়!
এইভাবেই দুজনে মিলে গুটি গুটি পায়ে একসময় স্কুলে ঠিক পৌঁছেই যেতাম। যেদিন ঐ ঝিলটায় বেশিক্ষণ থাকতাম সেদিন স্কুলে পৌঁছাতাম বেশ দেরিতে। প্রেয়ার করা হতো না। দেরিতে পৌঁছানোর জন্য ফার্স্ট পিরিয়েডে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। কিন্তু তাতে আমার কোনও রকম আক্ষেপ ছিল না। প্রথমত কথা বলার জন্য আমার প্রতি পিরিয়ডেই নাম উঠত মনিটারের খাতায়। আর সেই জন্য ফার্স্ট পিরিয়েডে শাস্তি স্বরূপ দাঁড়িয়েই থাকতাম।
আর দ্বিতীয় কারণ ছিল আমার ভাই এর সঙ্গে দুর্দান্ত একটা সময় কাটানোর ভালোলাগা। সেটা আমি খুব একটা মিস করতে চাইতাম না।এখন ভাবি ভাগ্যিস মিস করিনি!! যতটুকু সময় পেয়েছিলাম স্মৃতি চারণ করতে করতে তো ওকে ছাড়াই জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই কাটিয়ে দিলাম,,,,,তবে ও যতদিন ছিল আমিও যেন ছিলাম,,,,,বেঁচে ছিলাম,,,,,,,যেটা এই বয়েসে এসে বেশ টের পাই।

স্কুলে যাওয়ার সময়টা আমরা দারুণ কাটাতাম। রিক্রিয়েশন ক্লাবের সামনের দিকে একটা বড়ো রাস্তা পার করে কিছুটা ফাঁকা মাঠ পড়ত। তারপর কিছুটা এগিয়েই একটা বড়ো ঢিপি মতো ছিল। আমরা বলতাম পাহাড়। তখন আমরা অরিজিনাল পাহাড় তো দেখিনি । ভূগোল বই এ যতটুকু ছবি দেখেছি সেই আইডিয়ায় ঐ ঢিপিটাকে আমরা পাহাড়ই বলতাম। আমরা ছোট বেলায় মামারবাড়ি আর ঠাকুমার বাড়ি ছাড়া কোত্থাও কোনও দিন বেড়াতে যাই নি। আমাদের চারজনের একসঙ্গে প্রথম এবং শেষ বেড়াতে যাওয়া ছিল পুরী,,,,, আমি যখন টুয়েলভ এ পড়ি।
তো যাইহোক ঐ পাহাড়ের নিচেই ঐ বড়ো ঝিলটা ছিল। কী সুন্দর টলটলে জল! মাঝখানটায় গোলাপি রঙের পদ্মফুল ফুটে থাকত। চারপাশে গাছের ছায়ায় কোন কোন সময় ঝিলের জলটা কেমন কালো দেখাত। তখন একা বসে থাকতে আমার খুব ভয় করত। ভাই থাকলে অসুবিধা হতো না। আমরা বই এর ভারি ব্যাগটা পাশে রেখে ঝিলের ধারে বসতাম। সুখ দুঃখের গল্প হতো আমাদের। যেদিন যার মন খারাপ থাকত অপরজন মনের সেই নরম জায়গায় নানা রকম হাসির মলম লাগানোর চেষ্টা করত।
কত গল্প হতো আমাদের! একটা করে ছোট্ট ঢিল ছুঁড়ে দেখতাম জলের মধ্যে কটা গোল হত। গোলগুলো গুণতাম। কার কটা গোল। আবার কার ঢিল কত বেশি দূর গেল,,, আধো আধো গলায় বলত,, বুঝলি দিদি ঐ জলের মধ্যে কী আছে একদিন আমায় দেখতে হবে। সাঁতারটা শিখতে হবে। ডুব সাঁতার দিয়ে চলে যাব জলের তলায় কত মাছ আছে জানিস? সাপও আছে। তুই যেন জলে নামিস না তোর তো সাপে ভয়,,,
আমি তোর জন্য জলের তলা থেকে মাছ ধরে আনব। পদ্মফুলও এনে দেব। তুই ঠাকুরকে দিস। আচ্ছা দিদি জলের তলায় ওদের থাকতে কষ্ট হয় না কেন রে?

আমি কেমন আনমনা হয়ে যেতাম। কত কিছু ভাবতাম! উদাসীন আমি
বলতাম ,”আচ্ছা যদি ঐ বড়ো মাছটা হতাম! তাহলে কী ভাল হতো বলতো?
ভাই বলত, “ভাল হতো? তোকে কেটে সবাই ভাজা করে খেত।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতাম,” চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আর একটু বস না দিদি। দেখ ঐ দিকের জলটা কেমন কাল। আমাদের দিকের জলটা তো এমন নয়। কেন রে?
ছোট থেকেই ওর যে কত প্রশ্ন ছিল! আমি কোন সময় চুপ করে থাকতাম,,,কোন সময় রাগ করে বলতাম চুপ করবি? সব সময় শুধু বকবক,,,,
আসলে সবের উত্তর তো আমার জানা ছিল না,,,,,,,,
আমি আর সন্টু (ভাই) একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম ,,,,অনেক দূর,,,,,জলের অনেক গভীরে দেখার চেষ্টা করতাম,,,,,
কত হাঁস আসত ঐ ঝিলটায়! ভাই বলত দেখ দি ,,,, হাঁস গুলো কেমন হেলতে দুলতে গুটি গুটি পায়ে টুকুস করে জলে নেমে পড়ল। পা নাচিয়ে নাচিয়ে কেমন সাঁতার কাটছে। আমরা কেন পারি না রে?
বলতাম,,আমরা সাঁতার জানি না তাই পারি না। সাঁতার শিখলেই পারব।
“কিন্তু এখন আমার যে জলে নামতেই ভয় করে তাহলে কী করে শিখব?”,,,, আমি বলতাম,”আরে বাবা আর একটু বড়ো হ তবে তো পারবি?”
“বাবার মতো বড়ো,, দিদি? নাকি মিঠুদাদা,, পল দাদার মতো বড়ো?”(ওরা আমাদের পাশের কোয়ার্টার এ থাকত ),,,,,,
“হ্যাঁ হ্যাঁ ওদের মতো বড়ো হলেই পারবি। এখন চল স্কুলে এবার ঢুকতে দেবে না। মা মেরে শেষ করে রাখবে,,,,,,,,

কত রকমের পাখি এসে বসত ঝিলের পারে,,,,,ভাই ওদের ধরতে ছুট লাগাত। আমিও ছুটতাম ওকে সামলাতে। মা স্কুলে যাওয়ার সময় বলে দিত ভাইকে দেখিস।
আমি ওর থেকে বছর দুয়েকের বড়ো ছিলাম। কিন্তু ভাইকে সামলাতে একটুও অসুবিধা হতো না। খুব খেয়াল রাখতাম ওর। কিন্তু এত খেয়াল রেখেও কী ওকে রাখতে পারলাম! চলে গেল তো,,,চলেই গেল আমার হাত ছাড়িয়ে,,,আমাকে একা ফেলে রেখে,,,,

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।