জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর।
বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন।
চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।
এক ডক্টর কি মৌত
ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা আইভিএফ। একজন মায়ের শরীরের ডিম্বাশয় থেকে একটি সুস্থ ডিম্বাণু নিয়ে বাইরে ল্যাবরেটরিতে শুক্রাণুর সঙ্গে তার মিলন ঘটিয়ে নিষিক্ত করে তাকে আবার সেই মায়ের গর্ভাশয়ে প্রতিস্থাপনের পদ্ধতিতে শিশুর জন্ম দেওয়া। ডিম্বাণু অন্য নারীর থেকেও নেওয়া যেতে পারে এবং নিষিক্ত ভ্রূণ অন্য নারীর শরীরে রাখা যেতে পারে। এই হল আইভিএফ। কৃত্রিম উপায়ে ভ্রূণ তৈরি। যে নারী কোনো বাস্তব কারণে মা হতে পারছেন না, নিজের বা স্বামীর শারীরিক সক্ষমতার অভাবের কারণে, তাঁকে মাতৃত্বের স্বাদ দেওয়া।
কাজটার স্বীকৃতিতে মেডিসিন বিভাগে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন রবার্ট জি এডওয়ার্ডস। ২০১০ সালে। তাঁকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন প্যাট্রিক স্টেপটো আর জাঁ পার্ডি। তবে প্যাট্রিক আর পার্ডি নোবেল পুরস্কারের ভাগ পান নি। কেননা, মরণোত্তর নোবেল পুরস্কার দেবার কোনো ব্যবস্থা নেই।
এডওয়ার্ডস সাহেবের পরীক্ষা নিরীক্ষায় বিশ্বের প্রথম আইভিএফ শিশু লুইসি ব্রাউন জন্মেছিলেন। সেটা ১৯৭৮ সাল। ওই একই বৎসরে, সাতষট্টি দিন পরে জন্মেছিলেন কানুপ্রিয়া আগরওয়াল, বা দুর্গা। ভারতের এই দুর্গা বিশ্বের দ্বিতীয় আইভিএফ শিশু। দুর্গা জন্মেছিলেন ১৯৭৮ সালের অক্টোবর মাসের তিন তারিখে। ২০১৮ সালে কানুপ্রিয়া চল্লিশ বছর বয়সে পৌঁছেছেন। কিন্তু বিশ্বের এই দ্বিতীয় আইভিএফ শিশুর জন্মের কৃৎকৌশল স্বাধীনভাবে যিনি আবিষ্কার করেছিলেন তিনি দীর্ঘদিন ধরে রয়ে গিয়েছিলেন অবজ্ঞার অন্ধকারে। এই বিজ্ঞান সাধক ছিলেন ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায় ( ১৬.০১.১৯৩১ – ১৯.০৬. ১৯৮১)। প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, গাইনিকলজিস্ট ডাক্তার, নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের লেকচারার, রীডার ও প্রফেসর পদে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৫ অবধি কাজ করার পরেও তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে সরকার যোগ্য স্বীকৃতি দিতে চাননি। অভিমানী বিজ্ঞানী সামাজিকভাবে হেয় হন। তাঁর গবেষণার উচ্চমান হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন, এমন অভিজ্ঞ ব্যক্তির অভাব ছিল। অভাব ছিল রাজনৈতিক সদিচ্ছার। বামফ্রন্ট সরকারের এই দুর্বলতা ও অক্ষমতার কোনো ক্ষমা হয় না।
দুর্গার স্রষ্টা সুভাষ আজকের দিনে আত্মহত্যা করলেও, তাঁকে মনে রাখার হাজার একটা কারণ আছে। বলা দরকার যে, তাঁর মতো একই গবেষণা করে বিজ্ঞানী এডওয়ার্ডস ২০১০ সালে নোবেল পেলেন, অথচ দেশবাসী তাঁকে সেভাবে চিনলই না।
তবে আমার সদ্যোতারুণ্যের দিনে, ১৯৯০ সালে আমি একটি ফিল্ম দেখি। বিখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরীর গল্প অভিমন্যু অবলম্বনে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক তপন সিংহ চিত্রনাট্য রচনা করে হিন্দি ভাষায় একটি ফিল্ম তৈরি করেন। ১২২ মিনিটের ফিল্মটি প্রযোজনা পরিবেশনা করেছিলেন ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন। সিনেম্যাটোগ্রাফিতে ছিলেন সৌমেন্দু রায়। ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন পঙ্কজ কাপুর, শাবানা আজমি, অনিল চ্যাটার্জি, ইরফান, দীপা শাহি, এবং বিজয়েন্দ্র ঘাটগে। বিজ্ঞানী চিকিৎসক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর নয় বৎসর পর ১৯৯০ সালে ফিল্মটি রিলিজ হলেও সঙ্গে সঙ্গে সারা ভারতের সিনেমা দর্শকের কাছে স্বীকৃতি পেয়েছে ছবিটি। ১৯৯০ সালে আটত্রিশতম জাতীয় ফিল্মোৎসবে এক ডক্টর কি মৌত দ্বিতীয় সবসেরা কাহিনীচিত্র হিসেবে সম্মানিত হয়। একই সাথে সবসেরা চলচ্চিত্র পরিচালকের সম্মান পেয়েছেন তপন সিংহ। এতেও শেষ নয়, ডাক্তার দীপঙ্কর রায়ের চরিত্রটি রূপায়ণের জন্য পঙ্কজ কাপুর পেয়েছিলেন স্পেশাল জুরী অ্যাওয়ার্ড। আবার ১৯৯২ সালে রমাপদ চৌধুরীর অভিমন্যু গল্প থেকে এক ডক্টর কি মৌত এর চিত্রনাট্য লেখার সুবাদে তপন সিংহ ফিল্মফেয়ার সম্মান পেয়েছিলেন।
আজ সেই দিন। চল্লিশ বছর আগে এমন একটা ঊনিশে জুন এক প্রতিভাবান ডাক্তার চরম হতাশায় শেষ করে দেন নিজেকে। রাজনৈতিক সদিচ্ছার দৈন্যবশতঃ ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকার বিজ্ঞানীর পাশে দাঁড়াতে না পারলেও পরবর্তীকালে ভারতীয় দর্শকের কাছে সুভাষ মুখোপাধ্যায় পৌঁছে গিয়েছিলেন চমৎকার ফিল্মটির দৌলতে। আগামী দিনের বিজ্ঞানীকে আরো সাহসিকতার সঙ্গে সামাজিক অশিক্ষা ও দুর্বলতাকে উপেক্ষা করে বিজ্ঞানচর্চার কাজ চালিয়ে যেতে হবে।