• Uncategorized
  • 0

|| দৌড় থামেনি, বদলেছে শুধু ট্র্যাক || আকাশ কর্মকার

দৌড় থামেনি, বদলেছে শুধু ট্র্যাক

“Most runners run not because they want to live longer, but because they want to live life to the fullest.”
-Haruki Murakami, What I Talk About When I Talk About Running
              লক্ষ লক্ষ স্পার্মের মধ্য দিয়ে যে দৌড় শুরু হয় তা অনন্ত, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা বিরাজমান। দৃঢ়তা, নিয়মানুবর্তিতা এবং অদম্য লড়াইয়ের হিরোদের কাছে যুগ যুগ ধরে পরাস্ত হয়ে আসছে দারিদ্র্য, অসহায়তা। পাঞ্জাবের গোবিন্দপুরের সন্তানের শৈশবের চিত্রনাট্য জুড়েছিল হিংসা-রক্ত-আঘাত। নিজের চোখের সামনেই সে দেখেছিল তার মা-বাবার হত্যা, ভাই-বোনের রক্তাক্ত নিথর দেহ। তখন থেকেই দৌড়ানো শুরু, যে দৌড় শুরু ছিল আশ্রয়ের খোঁজে, দৌড় ছিল বেঁচে থাকার তাগিদে। এই জীবনের দৌড় তাকে পৌঁছে দিয়েছিল তিহার জেলে, সেখান থেকে রিফিউজি ক্যাম্পে।মিলখা সিং তাঁর আত্মজীবনী ‘‌দ্য রেস অফ মাই লাইফ’‌–এ লিখেছেন, ‘‌তখন আমাদের মতো গ্রামীণ পরিবারে অতীত বা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সময় কারও ছিল না। আসল ব্যাপার ছিল, প্রতিদিন কোনওভাবে বেঁচে থাকাটাই।’ সদ্য স্বাধীন ভারতশিশুর বুকে হয়তো দাপিয়ে বেড়াতে পারত এক পাঞ্জাবী ডাকাত, মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায় নামও উঠতে পারত যদি না সে চতুর্থ বারের প্রচেষ্টায় হয়ে উঠতে পারত একজন ভারতীয় সৈন্য। জীবনের দৌড় খুলে দিল তার সৌভাগ্যের দ্বার। একগ্লাস দুধের জন্যও দৌড়ানো যায়, দৌড়াতে হয়; ছেলেবেলার দুধের অভাবে বেড়ে ওঠা শৈশব আর্মি ট্রেনিং ক্যাম্পে ছয় মাইল দৌড়ে ষষ্ঠ পজিশন অধিকার করে, পুরস্কার স্বরূপ জোটে একগ্লাস দুধ। আর্মি ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে শুরু হওয়া এই দৌড়ের কৃতিত্ব তিনি সম্পূর্ণভাবে দেন তাঁর গুরু গুরুদেব সিংকে। ক্রস কান্ট্রি রেসে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করার পর থেকেই শুরু হয় এক স্বপ্নের দৌড় যা ট্র্যাকের পর ট্র্যাক জুড়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত। অলিম্পিকস্, এশিয়ান গেমস, ন্যাশনাল গেমস, কমনওয়েলথ গেমসে স্প্রিন্টের যাবতীয় সাফল্য আসে এই ভারতীয় মাণিক্যের হাত ধরে। ১৯৬০ রোম অলিম্পিকসে ৪০০ মিটার দৌড়ে ৪৫.৭৩ সেকেন্ড দীর্ঘ চল্লিশ বছরের কাছাকাছি সময় ধরে ভারতীয় রেকর্ড হিসেবে উজ্জ্বল হয়েছিল। পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কথাতে বিশ্বাস রেখেই নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সমস্ত দুঃখ বেদনার স্মৃতিকে সরিয়ে ১৯৬০ সালে পৌঁছেছিলেন পাকিস্তানের মাটিতে প্রখ্যাত আব্দুল খালিকের সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায় যেখানে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল আয়ুব খান তাঁকে ‘ফ্লাইং শিখ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। অর্জুন পুরস্কারকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ভারতের এই স্বনামধন্য অ্যাথলিট নিজস্ব যুক্তির ভিত্তিতে, নিজের জীবদ্দশায় অর্জন করেছিলেন ভারতবর্ষের চতুর্থ সর্বোচ্চ সম্মান পদ্মশ্রী। তিনি আক্ষরিক অর্থেই ভারতমাতার যোগ্য রত্ন ছিলেন বলেই হয়তো আর কখনো ভারতরত্ন প্রাপকের তালিকায় নাম থাকা বা না থাকা নিয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে নি। ৯১ তম বছরে স্ত্রীয়ের পরলোক গমনের মাত্র পাঁচদিনের মাথাতেই ভারতমাতার এই বীর সন্তান ক্যাপ্টেন মিলখা সিং বিদায় জানান পৃথিবীকে, সৌজন্যে মারণরোগ করোনা। নিজের খেলাধূলার জীবনের প্রাপ্ত যাবতীয় মেডেল, জুতো সবই দিয়ে গেছেন দেশের উদ্দেশ্যে যা এখন দিল্লী এবং পাটিয়ালার মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। জীবনের দৌড় কিন্তু কখনো থেমে যাওয়ার নয়; এই দৌড়ের মাধ্যমেই আমরা দেখেছি পৃথিবীর আলো-এগিয়ে চলেছি জীবনের যাত্রাপথে-আবার এভাবেই একদিন মিলিয়ে যাব তারাদের জগতে দৌড়াতে দৌড়াতে। ট্র্যাক এবং ফিল্ড অ্যাথেলিটসের ভারতীয় আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রের কখনো সমাপ্তি ঘটেনি, আগামীতেও ঘটবে না। পি.টি.ঊষা, দ্যুতি শর্মা কিংবা হিমা দাসেরা সেই ব্যাটনকে সাফল্যের সাথে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আজ চারিপাশে এতো আগামীর স্বপ্নের ছড়াছড়ি, দূর হতে বহুদূরে পাড়ি দেওয়া সেই স্বপ্নের বীজবপনকারী কারিগরেও চোখেও সাফল্যের অশ্রু স্বাভাবিক ভাবেই আসবে। নর্মান গিলবার্ট প্রীতচাঁদের নাম কতজন জানে তা বলা কঠিন তবে মিলখা সিং হয়ে উঠেছিলেন ভারতবর্ষের ঘরের নাম যিনি কখনো থামতে জানেন না, পার্থিব দৌড় শেষে পারলৌকিক দৌড়ের সূচনা হল আজ থেকে। দৌড় থামেনি, বদলেছে শুধু ট্র্যাকটাই। কারণ জীবনে অর্জন করার খিদে কখনো সম্পূর্ণ হয় না, তা আবহমান। তাঁরই উক্তি উদ্ধৃতি করে বলতে পারি-
       “You can achieve anything in life. It just depends on how desperate you are to achieve it.”.
-Milkha Singh, The Race of My Life.
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *