অদিতি মহসিন —— যার কন্ঠের কাছে আমি বারবার ফিরে আসি। যেন আমার কতদিনের চেনা মানুষ। তার কন্ঠের হাত ধরে এই বর্ষার বৃষ্টিতে একেবারে ভিজে চান করে যাই। মনে হয় মানুষটা আমার কতদিনের চেনা। আজকের এই বৃষ্টিদিনের মতোই একদিন প্রথম তার গান শুনি —— “আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে”। গান শুনতে শুনতে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলাম। “এসেছে এসেছে, এই কথা বলে প্রাণ, এসেছে এসেছে উঠিতেছে এই গান —— / নয়নে এসেছে, হৃদয়ে এসেছে ধেয়ে” —– আনন্দে প্রাণ নেচে উঠেছিল এবং সেই আনন্দ এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যে বৃষ্টিদিনে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিলাম। আসলে অদিতির গলায় কোথায় যেন একটা দুঃখ লুকিয়ে আছে, যা আমাকে এই বৃষ্টিদিনের মুহূর্তগুলোতে বড় একা করে দেয়। তার গান শুনে মনে হয় এ মেয়ে আমাদের ছোটোবেলার খেলনাপাতি সংসারের সই। তার কন্ঠের চলাচল মনে করিয়ে দেয় সে যেন ফেলে আসা দিনের কোনো জীবনসূত্র অন্বেষণে ব্যস্ত। এখনই ডাক দিলে মুহূর্তে ঘাড় ঘুরিয়ে কোনো চেনা নামে আমাকে ডেকে উঠবে।
আজ সকাল থেকেই এক আকাশ মেঘ। কখনও ঝিরঝির করে একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। কখনও আবার কিছুক্ষণের জন্যে থেমে রয়েছে। কিন্তু মুহূর্তের জন্যেও আকাশ থেকে সরছে না মেঘ। এমন দিনগুলোতে আমার মতো চিরকালের একা একজন মানুষ আরও একা হয়ে যায়। আগে যাও একটু কথা বলতাম এখন সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে । আর এইরকম মেঘলা দিনগুলোতে বই পড়তে লিখতে কিছুই ভালো লাগে না। অন্যসময় হলে এইদিনগুলোতে ট্রেনে চেপে কোনো স্টেশনে বসে থাকতাম। একা একা ঘন্টার পর ঘন্টা। কি ভালো যে লাগে তা কাউকে বলে বোঝাতে পারব না।
একা একা নিজের সঙ্গে কথা বলি। মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কোনো বন্ধুর কথা। যার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল হয়ত তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। আমার কাছে যার আজ কোনো খবর নেই। জানি না সে এখন কোথায় থাকে। মনে পড়ে যায় সেই কলেজ বান্ধবীর কথা, যার সঙ্গে গল্প করতে করতে একের পর এক ট্রেন ছেড়ে দিতাম। বাড়ির কথা ভুলেই যেতাম। তখন তো সেই আমার পৃথিবী। সেও আমার সঙ্গে একমনে গল্প করে যেত। মনে হতো না তারও কোনো বাড়ি আছে। তারপর সেই টানগুলো কোথায় যে হারিয়ে যায়! জানি না সে এখন কোথায় থাকে। এক এক সময় সেই সব বন্ধু বান্ধবীদের খুব দেখতে ইচ্ছা করে। কিন্তু উপায় নেই। এইসব বৃষ্টিদিনে নির্জন স্টেশনে আমি তাদের কাছে চলে যাই।
আজ জানলার ধারে বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে আবার অদিতি মহসিন শুনলাম —— “আবার এসেছে আষাঢ়…”। এইরকম বৃষ্টিদিনে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কার কাছেই বা যেতে পারি। “এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি / নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে” ——- গান শেষ হতে দেখি দু’চোখ কখন ভিজে গেছে।