বলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা
তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর
তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে
নেমে গেছে
শুকনো রক্তের রেখা
চোখ দুটি চেয়ে আছে
সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ থেকে ছুটে আসে
অন্য গোলার্ধে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।
(চে গুয়েভারার প্রতি- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
‘জঘন্য বিপদ জানার পরেও আমায় বিপ্লবের রহস্য বলতে দাও, বিপ্লব সবসময়ই গভীর আবেগ আর ভালোবাসা দ্বারা পরিচালিত হয়, সত্যিকার আবেগ আর ভালোবাসা ছাড়া বিপ্লব অসম্ভব।–চে গুয়েভারা
এক আমৃত্যু বিপ্লবীর নাম আর্নেস্তো চে গুয়েভারা৷ স্পেনিশ, বাস্ক ও আইরিশ বংশোদ্ভূত বাবা-মায়ের সন্তান তিনি৷জ জানা যায় নিবন্ধন অনুযায়ী ১৯২৮ সালের ১৪ জুন তিনি জন্মালেও, তার প্রকৃত জন্ম তারিখ ১৯২৮ সালের ১৪ই মে। জন্মদিন নিয়ে এক মাসের হেরফের কী কারণে তা অবশ্য জানা যায় না। জন্মের পর এই বিপ্লবীর নাম রাখা হয়েছিল ‘আর্নেস্তো’। তার পুরো নাম আর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সারনা। কিন্তু এ নামে তাকে কেউ চেনে না! তিনি পরিচিত ‘চে’ নামে। এই শব্দটির অর্থ বন্ধু।
চে পেশায় ডা্ক্তার ছিলেন৷ মারিয়া এন্টোনিয়ার বাড়িতে চে’র সঙ্গে পরিচয় হয় কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর। সেটা ছিল ১৯৫৫ সালের জুন মাস৷ ক্যাস্ত্রো গেরিলা দলের নেতৃত্বে ছিলেন৷ সেই গেরিলা দলে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন চে। এই প্রথম একজন বিদেশী সেই দলে যোগ দিল৷ কৃষি বিভাগের সর্বোচ্চ নির্বাহী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অথবা শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে তিনি কিউবার নবগঠিত বিপ্লবী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন। ১৯৫৯ সালে তাকে কিউবার নাগরিকত্ব প্রদান কর হয়৷
চে, ফিদেল কাস্ত্রোকে এক সময় লেখে ” বিপ্লবে বিজয়ের আনন্দ আছে আবার তেমনি মৃত্যুর বেদনাও আছে” এবং সেই সময় ১৯৬৫ সালে ১লা এপ্রিল চে গুয়েভারা কিউবার শিল্পমন্ত্রীর পদ, মেজরের পদ, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ এবং কিউবার নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন৷
এরপর শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চে বলিভিয়াকে বেছে নেন। আসলে একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার পরিবারে বেড়ে উঠবার কারণে খুব অল্প বয়সেই রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন চে। সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠা চে-র পরিবারে ছিল তিন হাজারেরও বেশি বই, যা চে-কে করে তোলে সমাজ সচেতন। সে সময় তিনি কার্ল মার্কস, উইলিয়াম ফকনার, এমিলিও সরগারির বইয়ের পাশাপাশি আলবার্ট ক্যামাস, ভ্লাদিমির লেনিন, রবার্ট ফ্রস্টের বইও পড়েছেন। শুধা তাই নয় ছাত্রজীবনে চে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করতেন। যা তাকে অসহায় মানুষের দুঃখ-কষ্ট অনুধাবন করার সুযোগ এনে দেয়। চে বুঝতে পারেন একমাএ বিপ্লব ছাড়া ধনী গরিবের এই ব্যবধান ধ্বংস করার আর কোনো উপায় নেই।
১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসে উরুগুয়ের ব্যবসায়ী এ্যাডোলফো মেনা গনজালেস নাম ধারণ করে ছন্মবেশে তিনি বলিভিয়া পৌঁছান।বলিভিয়ায় চে গুয়েভারার গেরিলা সংগ্রামে সরকার ভীতি হয়ে পড়ে। তারা চে গুয়েভারাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ৫০ হাজার ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে। বলিভিয়ার সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে একটা বিচ্ছিন্ন গেরিলা আক্রমণের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ধরা পড়েন চে গুয়েভারা, সালটা ছিল ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর৷
বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট রেনে বেরিয়েন্তোস চে’কে হত্যা করার আদেশ দিলেন। আটকে রাখা হয় একটা স্কুল্ ঘরে৷ ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর, বলিভিয়ার লা হিগুয়েরাত শহরে বলিভিয়ার সেনাবাহিনী তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। মৃত্যুদণ্ডের আদেশ কার্যকর নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। নিরস্ত্র চে’কে গুলি করে হত্যা করতে রাজি হচ্ছিল না সাধারণ সৈনিকরা। অবশেষে হত্যা করার জন্য বেছে নেওয়া হলো মদ্যপ সৈনিক মারিও তেরানকে। কাঁপা কাঁপা হাতে টলত টলতে , বুকে নয়টি গুলি করে বেসামাল সৈনিক শেষ করে দিল চিরচেনা এক বিপ্লবীকে।
মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর চে’র হাত এবং চুল কেটে ফেলা হয় এবং তাকে গণকবরে পুতে রাখা হয়। ১৯৯৭ সালের জুনের শেষ দিকে প্রায় ১০ হাজার বর্গমিটার এলাকায় কিউবা ও আর্জেন্টিনার বিশেষজ্ঞরা সম্মিলিতভাবে চে’র মৃতদেহ উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছিল৷ ১৯৯৭ সালের ২৮ জুন একটি গণকবর থেকে ৭টি কংকাল উদ্ধার করা হয় এবং হাসপাতালে পরীক্ষা করার পর দুটি হাত ছাড়া কঙ্কালটি চে’র বলে চিহ্নিত করা হয়।
বিপ্লবের ফেরিওয়ালা চে গুয়েভারার অস্ত্রের পাশাপাশি সঙ্গে সব সময় থাকত একটি ব্যাগ। ব্যাগের মধ্যে থাকত একটি সবুজ কবিতার খাতা। তিনি নিজে কবিতা লিখতেন। শুধু তাই নয়, চে গুয়েভারা কিউবান ভাষায় ৭০টি প্রবন্ধ লিখেছেন। এর মধ্যে প্রায় ২৫টি লিখেছেন ছন্মনামে। তিনি লিখে দিয়েছেন ৫টি বইয়ের ভূমিকা। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন প্রায় ২৫০। তার লেখালেখি নিয়ে ৯ খণ্ডের রচনাবলী রয়েছে।
২০০৮ সালের ৪ ডিসেম্বর একটি চলচ্চিত্র উৎসবে চে পার্ট-ওয়ান চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী হয়। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে চে পার্ট-টু মুক্তি পায়। আর চে’র ‘মটর সাইকেল ডায়েরি’ না বললে বিরাট একটা ফাঁক থেকে যায় । পরে এই শিরোনামে একটি চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছে।
এক নায়কতন্ত্র, পুঁজিবাদ ও নিপীড়নের ঘোর বিরোধী চে গেভারা শুধু ল্যাটিন অ্যামেরিকাতেই নয়, বিশ্বের বহু দেশের অবহেলিত ও নিপীড়িত জনগণের কণ্ঠস্বর ছিলেন৷ কিউবার আলোকচিত্র শিল্পী আলবার্তো কোর্দা কি কখনও ভেবেছিলেন তাঁর তোলা একটি প্রতিকৃতি এতটা পরিচিতি পাবে? অ্যারনেস্তো গেভারা দে লা স্যারনা, বাংলায় যাঁকে আমরা চে গুয়েভারা বলে চিনি, তাঁর সাদা-কালো এই প্রতিকৃতি শুধু বিপ্লবেরই প্রতীক নয়, বিশ্ব যুব সমাজে সংস্কৃতির একটা অঙ্গও বটে৷ ১৯৬০ সালের ঐ ছবিটি টুপি, টি-সার্ট, পোস্টার এবং আরো কত কিছুতেই না ছাপা হয়৷
অতীতের যে কোনও সময়ের চেয়ে সারা বিশ্বে চে গুয়েভারা এখন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক, অনেক বেশি জাগ্রত। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে, প্রতিবাদে ও সংগ্রামের রক্তধারায় মিশে আছেন চে। মানুষের জাগরণে, অনুপ্রেরণা এবং প্রণোদনা হয়ে প্রতিদিনের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। এই মুহূর্তে যেন শুধু লাতিন আমেরিকা নয়, সারা বিশ্বের নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের বিপ্লব, বিদ্রোহ ও উত্থানের আরও শক্তিশালী সহযাত্রী হয়ে ফিরে এসেছেন আর্নেস্তো চে গুয়েভারা৷
আজ বিপ্লবের ফেরিওয়ালা চে গুয়েভারার জন্মদিন। আজকের এই বিশেষ দিনে তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা ও স্যালুট। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক৷