লখা ভুটাইয়ের পাশে বসল। সে দিকে তাকাল না ভুটাই। বেশ কয়েক মাস দেখা নেই লখার সঙ্গে। শেষ যেদিন দেখা সেদিন লখাকে ভুটাই বলেছিল, ‘তুই যাদের হয়ে খাটাখাটনি করছিস, ওরা কিন্ত এখানে খাতা খুলতে পারবে না। খেপ খাটা খেলোয়াড় দিয়ে ম্যাচ জেতা যায় না।’
লখা তখন বলেছিল, ‘তুই বুঝতে পারছিস না। এবার হাওয়াটা একেবারে অন্যরকম। এবার দেখবি আমাদের এখানে অনেক শিল্প আসবে। কল-কারখানা হবে। আমাদের চাকরি হবে। আর লোককে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করে আমাদের বাঁচতে হবে না। তুই কি জানিস আমাদের লোকজন ভয় পায় বটে, তবে ঘেন্নাও করে।’
ভুটাই তখন বলেছিল, ‘অত্ত সোজা? ঘেন্না করলেই হল? বাড়ির সামনে গুনে গুনে চার-পাঁচটা মাল টপকালেই দেখবি তখন আর ঘেন্না করবে না।শ্রদ্ধা ভক্তি করবে।’
‘লজ্জা করে না। তুই এম এ পাশ করে মাল টপকাবার কথা বলছিস!’
ভুটাই বলেছিল, ‘তুইও তো বি এ পাশ। তুই কোন ঘোড়াড্ডিমটা করতে পেরেছিস? বরং মাল টপকে আওয়াজ করে পাতি পাবলিককে ভয় দেখিয়ে কিছু আমদানি হচ্ছে। একটা চ্যানেল ধরে একেবারে জায়গা মতো পৌছে যাই তখন দেখবি একেবারে মালামাল হয়ে যাবে। সম্রাটের মতো জীবন কাটবে।’
‘বাজে কথা বলিস না। যখন ধরা পড়ে নাকানি-চুবানি খেতে হবে তখন কিন্তু কেউ পাশে থাকবে না। চিনতেই চাইবে না তোকে।’
‘অত্ত সোজা না। তখন ধরতেই পারবে না আমাকে। অন্য দেশের কোন একটা দ্বীপে পালিয়ে যাব। যারা ধরতে আসবে তাদের ঘুরিয়ে একেবারে পাগলা করে দেব।’
‘এই দেশ ছেড়ে তুই অন্য দেশে যাবি?’
‘তাতে অন্যায়টা কি? তুই তো বলিস আমরা ভারতবর্ষের নাগরিক। সব প্রদেশে সবার যাওয়ার অধিকার আছে। এইজন্য কাউকে বহিরাগত বলা উচিত না।’
‘সেটা তো ঠিকই বলেছি।’
‘এটা শুনিস নি যে গোটা পৃথিবীটাই একটা গ্রাম। আমি তো পৃথিবীতেই থাকব। তবে আইনটা এমন যে সেখানে কোনো মায়ে কা লাল সহজে হাজির হতে পারবে না।’
‘তুই জানিস আইনের হাত কত লম্বা!’
‘ওসব বাজে কথা। মোটেও লম্বা না। যদি তাই হত তবে কোটি কোটি মামলা ঝুলে থাকত না।’
লখা বলল, ‘সেটা তো সম্ভব না। সঠিক বিচার করে দেখতে হবে। অপরাধীকে ধরতে গিয়ে সতর্ক হতে হবে। দেখতে হবে ভুলেও যেন একজন নির্দোষ লোক শাস্তি না পায়।’
‘এতেই তো একটা জীবন বিন্দাস কাটিয়ে দেওয়া যাবে। বিচার শেষ হওয়ার আগে অপরাধী বার্ধক্যজনিত রোগে এমনিতেই পটল তুলবে।’ কথাটা বলে হো হো করে হেসে উঠেছিল ভুটাই। ‘যখন পৃথিবীতে মানুষ হয়ে এসেছি তখন একটা দাগ তো রেখে যেতে হবে। কোর্টের গোডাউনে কোটি কোটি ফাইল পড়ে থাকবে। তার একটিতে আমার নাম লেখা থাকবে। ভাবা যায়!’
সেদিন লখা উঠে পড়েছিল। যাবার সময় বলছিল, ‘তুই তাহলে চাইছিস না যে আমাদের এখানে শিল্প আসুক। আমরা একটা ভদ্রগোছের জীবনযাপন করি।’
ভুটাই বড়ো করে হাই তুলে বলেছিল, ‘চেষ্টা করে দ্যাখ। তেমন কিছু হলে মন্দ কি? লক্ষীন্দরবাবু বি এ পাশের একটা গতি হবে।’
‘শুধু আমার হবে কেন? তুই যে ভারতভূষণবাবু এম এ পাশ তোরও হবে।’ সেটাই শেষ দেখা।
লখা পাশে বসায় ভুটাই বলল, ‘ তা হলে তুই চলে এলি?’
লখা বলল, ‘চলে এসছি মানে? তুই কি বলতে চাইছিস? একা আছিস বলেই এলাম। চক্রের মধ্যে থাকলে তো তোর আবার বন্ধুত্বের কথা মনে থাকে না। এটা আবার তুই চারিদিকে চাউর করিস না যে, আমি ফিরে আসতে চাইছি। এটা বন্ধুর সঙ্গে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকার।’
ভুটাই বলল, ‘কতদিন বাদে বন্ধু শব্দটা শুনলাম। এখন তো সব শুধু কামাই করার পার্টনার। এসে ভালোই করেছিস। তোর সঙ্গে আমার একটা কথা আছে। একদম প্রাইভেট। সবাইকে বলা যায় না।’
‘দেখ ভুটাই আমার ফালতু কাজে কামাইয়ের দরকার নেই। আমি সবজি বেচে যা পাচ্ছি তাতে চলে যাবে।’
‘বি এ পাস করে সবজি বিক্রি করবি?’
‘সে দরকার হলে আমি চপও ভাজব। তবে সেটা বিকেলের দিকে।’
ভুটাই বলল, ‘তাহলে একটু রাত করে চপ ভাজ। চাট হিসেবে অঢেল বিক্রি হবে।’ কথাটা বলে হাসল।
‘আমি যাচ্ছি। তোর হাসি দেখতে আমার ভালো লাগছে না। তুই এম এ পাশ করে মাল টপকাচ্ছিস আমি সেটা পারব না।’
‘চলে যাস না। ভুটাই বলল, ‘আমি খুব বিপদে পড়েছি। তোর একটা পরামর্শ দরকার। কাউকে বলতেও পারছি না। তুই পারবি আমাকে সাহায্য করতে।’
‘আমি!’ অবাক হয়ে বলল লখা।
‘হ্যাঁ তুই। ছোটোবেলা থেকে যত গোপন কথা সবই তো তোকে বলেছি। তুই ছাড়া আর কে প্রিয় বন্ধু আছে আমার বল?’
ভুটাইয়ের কথা শুনে চুপ করে রইল লখা। খানিকক্ষণ পরে বলল, ‘বল কি বলবি?’
ভুটাই একটু লজ্জা লজ্জা ভাব করে বলল, ‘আমার একজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে।’
‘তাই! এটা তো আগে বলবি। তবে তো শুনতেই হবে। কোথায় থাকে। কেমন দেখতে?’
‘সে কথা পরে হবে। মেয়েটির পরিচয় শুনলে তুই চমকে যাবি।’
লখা বলল, ‘নানা উলটো পালটা কথা শুনতে শুনতে এমন বমকে আছি যে,আমি আর এখন বেশি চমকাই না। চমকে ওঠা কাকে বলে তা ভুলেই গেছি। তোর কথা বল।’
ভুটাই বলল, ‘মেয়েটির মামার ভায়রাভাইয়ের মেসোমশাইয়ের ভাগ্নের বউয়ের বাবার ছোটোবেলার বান্ধবীর ছোট বোনের সঙ্গে একজন মন্ত্রীর ভালো আলাপ আছে। একটু যোগাযোগ রাখতে পারলে একটা ভালো চাকরি পাওয়ার কোন সমস্যা হবে না। ভাবছি আমার চাকরি হয়ে গেলে, আমি তোর জন্য চেষ্টা করব।’
শুনতে শুনতে লখা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ‘ মেয়েটির মামার ভায়রাভাইয়ের দিদিমার আমি আর মনে করতে পারছি না। ঠিক আছে তুই আগে চাকরিটা পেয়ে যা। ভালোই হবে।’
‘কিন্তু একটা সমস্যা হচ্ছে।’ ভুটাই বলল।
‘সমস্যা! টাকা দিতে হবে? তবে তো আর হল না। তোর বাবার তো অত টাকা নেই।’
‘না না টাকা না। মেয়েটির পরশু জন্মদিন। আমাকে নিমন্ত্রণ করেছে। ওখানে সবার সঙ্গে আলাপ পরিচয় করাবে। শুনেছি মাননীয় মন্ত্রীও আসবেন।’
‘ভালোই তো। চলে যা।’
‘সেটাই তো সমস্যা।’
‘আবার কিসের সমস্যা?’
‘বলছি এমন একটা কিছু বল তো যাতে নিশ্চিন্ত হতে পারি। আমি ভেবেছি একটা কানের রিং দেব। সেটা কি ভালো হবে? তুই এর উপর একটা কিছু ভালো সাজেশন দে।’
‘খারাপ কি? যা ভেবেছিস ভালোই তো।’
‘তুই না ঠিক বন্ধুর মতো কথা বলছিস না। মনে হচ্ছে যেন অন্য দলের লোকের মতো কথা বলছিস।’
‘ভুল করছিস ভুটাই। আমি বন্ধুর মতোই বলছি। একটা কাজ কর ওই রিং দু’টোয় হিরে বসিয়ে দে।’
ভুটাই বলল আমি ভাবছি উপহার খুব ছোটো হলে হবে না। আমি চাই ওকে আরও বড়ো কিছু দিতে। যাতে দূর থেকে সেই রিংদু’টো সবার নজরে পড়ে। মন্ত্রী যদি আসেন তিনিও দেখবেন। আমার সেই উপহার দেখে তবে আমাকে চাকরি দেওয়ার কথা ভাববে। তারপর তোরও তো চাকরি হবে। এমন একটা কিছু বল যা আরও বড়ো হবে। সেটা কানে দিলে সবার নজরে পড়ার মতো হবে। সবাই অবাক হয়ে যাবে।
লখা মাথা চুলকে অনেক ভেবে ভুটাইকে বলল, ‘ তবে একটা কাজ কর।’
ভুটাই আগ্রহের সঙ্গে বলল, ‘বল। বল। তুই আমার বন্ধু। আমি জানি তুইই বলতে পারবি।’
লখা বলল, ‘ তুই মেয়েটিকে দু’টো সাইকেলের টায়ার দে।’