সাপ্তাহিক শিল্পকলায় শিল্পের জন্য শিল্প – লিখেছেন অ্যালবার্ট অশোক (পর্ব – ৪৬)
by
·
Published
· Updated
পিকাশো কবিতাও লিখতেন
রবি ঠাকুর (১৮৬১ – ১৯৪১) ৮০ বছর বেঁচেছিলেন। পিকাশো ( ১৮৮১ – ১৯৭৩) ৯২ বছর বেঁচেছিলেন। মানুষ অনেকে ৫০ বছরও বাঁচেনা। ৩০ এর কাছাকাছি এসে অনেক বড় বড় প্রতিভা বিলীন হয়ে গেছেন। জীবনে ৩০ বছরের আগে পরে দু এক দশক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ থাকে। মানুষ তার বোধবুদ্ধি নিয়ে মেধা ও গায়েগতরে খেটে নতুন জীবনের মঞ্চ বা ব্যবহারযোগ্য প্রাসাদ বানায়। আবার অনেক বিশিষ্ট মানুষ বলেন ৫০এর পর মানুষের নবজন্ম ঘটে। আমি রবি ঠাকুরের জীবনে তৎকালীন সমাজের চোখে উত্তেজিত হওয়ার ঘটনা তার ৫২ বছরে নোবেল পুরস্কারের আগে দেখিনা, তারপর ৬০ বছরে গিয়ে, তিনি ছবি আঁকা শুরু করে জীবনের শেষ ১৫ বছরে ২৫০০ ছবি আঁকেন। ১৯৩০ সালে প্যারিস, লন্ডন, বার্লিন, মস্কো, নিউইয়র্ক প্রদর্শনী করে বুঝিয়ে দিলেন, বাংলার থেকে এক কবি ছবিও আঁকতে পারেন। সাধারণ বোঝানো নয়, রীতিমত এক্সপ্রেসনিষ্ট ও কন্সেপচুয়াল ধারায় নতুন এক রূপবন্ধ। তাহলে এই ষাট বছরের কাছাকাছি এসে তিনি এত শক্তি ও সাহস কোথা থেকে সংগ্রহ করেন? ভাবলে তো তাজ্জব লাগে। অন্যদিকে পিকাশো ১৯০৭ সালে তার ২৬ বছর বয়সে প্যারিসে Trocadéro museum এ আফ্রিকার ভাস্কর্য দেখে Les Demoiselles d’Avignon বলে একটি পেইন্টিং করে বিখ্যাত হয়ে উঠেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই পেইন্টিং করেন ও স্পেন ও প্যারিসে যেমন কাজ হচ্ছিল তেমন – ঊনিশ বিশ ভাল মন্দ- ছবি আঁকছিলেন। তার জীবন দাবানলের মত প্রচার পেল গুয়ের্ণিকা এঁকে। ১৯৩৭ সাল। জার্মানরা গুয়ের্ণিকার বাস্ক শহরে বোমা ফেলে, অনেক মানুষ তাতে মারা যায়। তখন তার বয়স ৫৬ বছর। ১৯০৪ বা ৫ সালে পিকাশো দারিদ্রতার চরম অবস্থায়, তার বয়স তখন২৩ বছর। সেখান থেকে তিনি নিজেকে গড়তে শুরু করেন। কিউবিজমের বা ঘণকবাদের চর্চা চলছে, ১৯০৭ সালে ব্রাকের সাথে পরিচয় ও পেইন্টিং এর ধারায় নতুনের স্বাদ এনে নিজেকে প্রতিষ্ঠা দেন। ১৯৩৯ সালে জার্মান পোল্যান্ডকে আক্রমণ করল, শুরু হল ২য় বিশ্বযুদ্ধ। পিকাশো ততদিনে ৪ জন সঙ্গিনী সহ বিলাস ও সম্মান, খ্যাতির সাথে পরিচিত। ৫০ বছরে দোরা মার কে বিয়ে করেন, দোরা মার কে দিয়ে একটি কান্নার ছবি করেন কিউবিক প্যাটার্ণে। হিটলার পিকাশোর এই কিউবিক প্যাটার্ণের ছবিগুলিকে ‘degenerate’ ঘোষণা করল। গুয়ের্ণিকা প্যারিসের বিশ্ব মেলায় স্পেনের প্যাভিলিয়নে প্রদর্শিত হয়েছিল। জার্মানের পিকাশোর ছবির বিরুদ্ধাচরণ পিকাশোকে বিখ্যাত করে তুলেছিল। ১৯৩৫ সালে, ৫৪ বছর পিকাশোর। তিনি ছবি আঁকা বন্ধ করে দেন। হঠাৎ কবিতা লেখা শুরু করেন। শুধু কবিতা নয় গান বাজনাতেও ঢুকে যান। এটা প্যারিসে থাকাকালীন Max Jacob, Guillaume Apollinaire, André Breton, and Jean Cocteau প্রমুখ লেখক কবিদের সাথে চলা কালীন কবিতার প্রতি তার প্রবণতা আসে। জীবনে তিনি আগে কবিতা কখনো চর্চা করেননি, পড়েননি। এরপর মৃত্যু অব্দি ২৫ বছর কবিতা চর্চা করেছেন। অনেকে বলেন তিনি যদি তুলি রঙ না ছুঁতেন তবু স্পেনের একজন বড় কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত থাকতেন। কিন্তু আমি দেখেছি ব্রিটিশরা তার কবিতা পড়ে হাসে। বলে বাচ্চাদের মত লেখা। আর তিনি যেভাবে তুলি চালান। অনেক ফিগার এঁকে কোলাজ করেন ঠিক সেইভাবে কবিতাও লিখেছেন। তার অনেক কবিতার বই আছে। স্পেনিশ থেকে ইংরেজী তর্জমা হয়েছে অনেক। সেগুলি পড়ে আমার মনে হয়না এখন তার গুরুত্ব আছে। অধিকাংশই নবীশের মত লেখা।
আমার ভাবনা হল মানুষ ৫০ শে এলে মৃত্যুর অপেক্ষা করে। কিন্তু রবি ঠাকুর ও পিকাশোর মত আরো অনেকে ৫০ এর পর কাজ করে, আরো গোটা ৪/ ৫টি বিয়ে করে জীবন চালানোর এত শক্তির উৎস কোথায় পান! তারা যদি ৫০ শে মারা যেতেন আমরা কি তাদের খোঁজ রাখতাম?
পিকাশো ও পুলিশ
১৯১১ সালে প্যারিসের লুভ্যর মিউজিয়াম থেকে ভিঞ্চির মোনালিসা চুরি হয়ে যায়। সেই সময় স্পেনিশ আর্টিষ্ট পাবলো পিকাশোকে ওই ডাকাতির জন্য সন্দেহ করা হল। সন্দেহ করার শক্তিশালী কারণও ছিল। তিনি প্যারিসে এসে যাদের সাথে জুটে ছিলেন সেইসব বোহেমিয়া টাইপের কবি শিল্পীদের একজন সত্যিই ছিল প্রতারক গোছের। তার নাম Honoré Joseph Géry Pieret, তিনি লুভ্যর থেকে প্রায়ই শিল্প কর্ম চুরি করে এনে অনেকের কাছে বিক্রী করতেন পিকাশো সহ। পিকাশো চুরির মাল কিনতেন। পুলিশ মোনালিসা চুরি র পর Pieret ও পিকাশোর কমন বন্ধু লেখক Guillaume Apollinaire কে নিয়ে পিকাশোর বাড়িতে চলে আসে। পিকাশো Pieret এর কাছ লুভ্যরের চুরি যাওয়া দুটি Iberian ভাস্কর্য তখন কিনেছিলেন। পিকাশো জানতেন বা ভাস্কর্য চুরির পিছনে পিকাশোর হাত ছিল। পুলিশ মোনালিসা না পেয়ে পিকাশোকে মুক্তি দিয়ে দেন। আসলে একটি নির্মাণকারী সংস্থা, ছবিটা ইটালিতে কিছু পন্ডিত ও বিদ্বৎজনকে পড়াশুনার জন্য দিয়ে আসার কথা ছিল। সে ছিল লুভ্যরের প্রাক্তন কর্মচারী। তার নাম Vincenzo Peruggia। সে তার বাড়িতেই মোনালিসা লুকিয়ে রেখেছিল। তারপর দু বছর পর মোনালিসা উদ্ধার হয়। বলাবাহুল্য মোনালিসা তখন এত খ্যাতির অধিকারি হয়নি। হাওয়ার উপর এই ছবিটির মত খ্যাতি আর কোন ছবি পায়নি। অতিরঞ্জিত খ্যাতি।
পিকাশোর কৈশোরের ছবি
কিছু কিছু মানুষ অতি শৈশবেই প্রতিভার পরিচয় রাখেন। পিকাশো ছিলেন তেমন একজন । মাত্র ৯ বছর বয়সেই তিনি তার প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। লে পিকাডর ছবিটা দেখুন। পিকাশোর বাবা ছিলেন একজন পেইন্টার। ছেলেকে অতি শৈশবেই ছবি আঁকা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তার বাবা বার্সিলোনা স্কুল অব ফাইন আর্টস এ চাকরি করতেন।তাই কৈশোরে পা রাখার সাথে সাথেই আঁকার স্কুলে La Lonja School of Art ভর্তি করে দেন। ১৮৯৫ এ মানে ১৪ বছর বয়সে বিশাল ক্যনভাসে তার প্রথম অ্যাকাডেমিক ছবি আঁকা। নাম করণ করেন First Communion,1896 সালে বার্সিলোনার প্রদর্শনীতে স্থান পায় ও প্রেসের নজর টানে।ওই সময় তার ছবির বিষয়- এক ক্যাথলিক মেয়ে গীর্জার প্রার্থনার বেদীর সামনে হাঁটুমুড়ে আছে। একনাটকীয় দৃশ্য। শোনা যায় পিকাশোর বাবা তার ছেলের মডেল হয়ে পেইন্টিংটা সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করেছিলেন। আমাদের এই এশিয়ার ঘরে এরকম প্রশ্রয়ী পিতামাতা বিরল। ওর বাবা ১৩ বছর বয়সী ছেলের দক্ষতা দেখেম বাস্তবিক নিজে আঁকা ছেড়ে দেন। তার ধারণা হয়েছিল তার ছেলে তার দক্ষতা স্তর ছাপিয়ে বড় পেইন্টার হয়ে গেছেন। শিল্প সাহিত্য প্যাম্পারড্ মানে লাই বা প্রশ্রয় না পেলে মানুষকে মহান বানায়না। আপনারা দেখুন লাই পাওয়া রবি ঠাকুরকে। শিল্পী হতে গেলে ঘরে বাইরে নিঃশর্ত লাই দরকার। আপনার কাছের মানুষকেও আপনি তার শিল্প কর্মে প্রশ্রয় দিন। এখানে আরো কিছু পিকাশোর ১৪ বছরের আঁকার নমূনা দিলাম।