• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মৌসুমী নন্দী (যাপন চিত্র – ২৪)

যাপনচিত্র – ২৪

বিশ্বাস

কথায় আছে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর ৷কিন্তু বর্তমান যুগে কি বিশ্বাসের কোনো বিশেষ দাম আছে ! আজকাল তো আমরা সবাই সব ব্যাপারেই সন্দিহান ৷ সবসময়ই সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখি ৷ তার অবশ্য কারণ আছে ৷ কিছু মানুষ এই বিশ্বাসের আড়ালে এতটাই বিশ্বাসঘাতকতা করে যে অপরদিকের মানুষটির জীবন থেকে “বিশ্বাস” কথাটা চিরতরে চলে যায় ৷ তবুও কিছু মানুষ এখনো মানুষকে বিশ্বাস করে ৷ আসলে সহজ সরল মানুষকে হয়তো ঠকানো সম্ভব কিন্তু তারা হয়তো ঠকে কিন্তু সাময়িক সে জিতে গেলেও আদতে তার শিক্ষা ,সংস্কৃতি ও মনুষ্যত্বের হার ৷ তবুও আজো পৃথিবীতে বেঁচে আছে এই বিশ্বাস ,এবং ভবিষ্যতেও থাকবে ৷
সেদিন লকডাউনে এ.টি.এম গেছি টাকা তুলতে ৷ চারিদিকে ফাঁকা এমন কি এ.টি.এম গার্ডটিকেও দেখতে পেলাম না ৷ টাকা তুলে বেড়িয়ে আসার সময় দেখলাম দুজন বয়স্ক মানুষ আমার দিকে কেমন একটা অসহায় ভাব করে তাকিয়ে আছেন ৷ জানতে চাইলাম কিছু বলবেন ? বয়স্ক মানুষগুলোর একজন বৃদ্ধ আর একজন বৃদ্ধা আমার আরো সামনে এগিয়ে এলো।দেখেই মনে হলো ওনারা স্বামী স্ত্রী।আমি টাকা তোলার জন্যই এ.টি.এমে ঢোকার আগে থেকেই থেকেই ওনারা দাঁড়িয়ে ছিলেন ।আমার সামনে এসে বৃদ্ধ মানুষটি বলে,
-আমাকে টাকাটা তুলে দেবে মা ?
-কেন দেব না।নিশ্চয়ই দেব!
আমি টাকা তুলে দেব শুনে এ.টি.এম কার্ডটা আর একটা কাগজে লেখা পিন নাম্বারটা পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে দিয়ে বললেন ,
–নাও মা ।
—চলুন ভিতরে চলুন। আমি তুলে দিচ্ছি।
-না না আমরা বাইরেই দাঁড়াচ্ছি। ও তুমি তুলে নিয়ে এসে দাও।
–সেকি আপনি চলুন।আপনার টাকা আপনি যাবেন না,সেটা হয় নাকি?
-কেন হয় না মা ।সব হয়।ও কিছু অসুবিধা নেই‌।সে বিশ্বাস তোমার ওপর আছেই।ওই ঠাণ্ডা ঘরে ঢুকলে আমাদের ভয় হয়।তুমি যাও আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।
আজকাল যা শুনি তাতে কতরকমভাবে মানুষ মানুষকে ফাঁসায় প্রতারিত করে ৷ রক্ষী বিহীন এ.টি..এম কি করবো
ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।এতটা বিশ্বাস করে আমার হাতে এ.টি.এম কার্ডের পিন নাম্বার দিয়ে দিল।এমন সরল সাদাসিধে মানুষ কেউ আছে নাকি? না কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে ! জানতে চাইলাম কত টাকা তুলতে হবে ?? মনে মনে ভাবলাম সিসিটিভি ক্যামেরা তো আছে কিছু হলে প্রমাণ তো আছেই তখন ভাবা যাবে ৷,৷,আবারো জানতে চাইলাম
-কত টাকা তুলব?
– তিন হাজার টাকা মা ।
যথারীতি তিন হাজার টাকা তুলে নিয়ে এসে হাতে দিয়ে বলি,
-এভাবে সবাইকে বিশ্বাস করবেন না। দিন কাল তো ভালো নয়।মানুষ কে কখন আপনাকে ঠকিয়ে দেবে আপনি বুঝতেই পারবেন না।টাকা তুলে নিলেও আপনি টের পাবেন না।
আমরা কথা শুনে বৃদ্ধ মানুষটি হেসে বলে,
–মা আমরা লেখা পড়া জানিনা।আমাদের এই বিশ্বাসটুকুই সম্বল।এই বিশ্বাস নিয়েই বেঁচে আছি। ভগবানকে যেমন বিশ্বাস করি তেমনি তোমাদের মত মানুষদেরও বিশ্বাস করি।যদি লেখাপড়া জানতাম তাহলে কি আর এই ভাবে টাকা তুলে দিতে বলতাম? নিজেরাই তো তুলে নিতে পারতাম।আমাদের মতো গরীব মানুষকে কেউ ঠকাতে পারবে না।মানুষকে মানুষ কখনো ঠকাতে পারে না।যারা ঠকায় তারা অমানুষ।আর যদি কেউ টাকাটা নিয়েও নেয় তাহলে বুঝব আমার থেকেও সে গরীব।
কথা গুলো শুনে বেশ ভালো লাগছিল।তা আরো একটু কথা বলার ইচ্ছে হলো।নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলাম,
-তা এই বয়সে এই লকডাউনে আপনারা এ.টি.এমে এসেছেন।বাড়িতে আর কেউ নেই?
–না।বাড়িতে আর কেউ নেই।এই বুড়ো আর বুড়ি।দুজন দুজনের জন্য।
-আপনাদের ছেলে মেয়ে নেই?
-ছেলে মেয়ে নেই।ও নিয়ে আমাদের দুঃখ নেই। আমার গিন্নী তখন কাঁদত।আমাকে বলতো, খুব চিন্তা হয় বুড়ো বয়সে আমাদের কে দেখবে?আমি গিন্নীকে বোঝাতাম, ভগবানের ওপর বিশ্বাস রাখো।ভগবান যখন জীবন দিয়ে পাঠিয়েছে তখন তার জন্য ঠিক ব্যবস্থাও করে রেখেছে।শুধু বিশ্বাস করতে হবে।আমি তো লিখতে পড়তেই জানি না।আমার গিন্নী তবু নামটা লিখতে পারে।এই বয়সে এসে দুজন দুজনকেই দেখি।যেখানে যাই একসঙ্গে বেড়োই।আমি কথা গুলো শুনছি আর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওই বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে আছি।বয়সের ভারে যেন বৃদ্ধা অনেকটা ছোটো হয়ে গেছে।ওনার বয়স বয়স সত্তর বাহাত্তর তো হবেই।রোগাটে চেহারা।মাথাভর্তি সিঁদুর।সে তুলনায় বৃদ্ধকে বয়সের তুলনায় একটু স্ট্রং বলেই মনে হলো।মনের জোরটা যে বেশি সেটা দেখলেই বোঝা যায়।এই বয়সে এসেও ওনাদের ভালোবাসার ঘাটতি নেই।কতটা ভালোবাসা থাকলে এভাবে বলা যায়। কিন্তু মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছিল।গরীব মানুষ অথচ লেখা পড়া জানে না‌।এই এ.টি.এম কার্ড তার মানে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট তো আছেই।ভাবি একবার জিজ্ঞেস করি।দেখি হঠাৎ করেই ওই বৃদ্ধের পকেটে থাকা মোবাইলটার রিং হচ্ছে‌।রিং শুনে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধা বলে উঠলো,
—ওই বুঝি রাজু ফোন করেছে।ফোনটা ধরো।
দেখলাম বৃদ্ধ পকেট থেকে কিপ্যাড দেওয়া মোবাইলটা বের করে ফোনটা লাউড করে দিয়ে বৃদ্ধার মুখের সামনে ধরে বলে, হ্যালো বলো!
ফোনের ও প্রান্ত থেকে ভেসে এলো একটি ছেলের গলা,
–টাকা তুলেছো তো?
–হ্যাঁ বাবা।
–ঠিক আছে।বাড়িতে যাও।তারপর আমি ফোন করছি‌।যাবার সময় ওষুধটা মনে করে নিয়ে নিও।
—ঠিক আছে।
—সাবধানে যাও। বলেই ফোনটা কেটে দিল।
তারপর ফোনটা পকেটে রেখেই বৃদ্ধ হাসি মুখে বলে উঠলো,
–এটিএম থেকে টাকা তুললেই রাজুর কাছে খবর চলে যায়।তারপর ফোন করে জিজ্ঞেস করে।আমাদের জিজ্ঞেস করে টাকা পেয়েছি কিনা!
আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করি,
রাজুর কাছে খবর চলে যায় মানে? এই তো বললেন আপনার কোনো সন্তান নেই ,কার কাছে খবর যায়?
-এই যে একটু আগেই ফোন করলো শুনতে পেলে না ও- ই এখন আমাদের কাছে ভগবান।প্রতিমাসে তো ও-ই টাকা পাঠায়।ব্যাঙ্কে একটা বই করে দিয়েছে।বছর দশেক আগে একটা ব্যাগ আমি কুড়িয়ে পাই।ওই ব্যাগের মধ্যে অনেক দরকারী কাগজ আর পঞ্চাশ হাজার টাকা ছিল।আমি ব্যাগটা পাওয়ার পর থানায় জমা দিই।পরের দিন যার ব্যাগ সেই ছেলেটি থানায় এসে ব্যাগটা নিয়ে যায়।আর আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। ওটা ফিরে না পেলে ওর চাকরিটা নাকি আটকে যেত।ও বলেছিল, “টাকাটা বড়ো কথা নয় দরকারী কাগজ গুলো না পেলে কী যে হতো।অনেক বড়ো উপকার করলে।” তারপর আমাদের এই অবস্থা দেখে ছেলেটি নিজেই বলেছিল,তোমরাও আমার আর এক বাবা মা।আমি তোমাদের পাশে আছি।চাকরি পাওয়ার পর থেকে প্রতিমাসে টাকা পাঠায়।মাঝে মাঝে নিজের গাড়ি করে আসে।দেখা করে যায়। এটিএমে ওই ছেলেরই ফোন নাম্বার দেওয়া আছে।তাই টাকা তোলার পর ওর কাছে খবর চলে যায়। এই মোবাইলটাও কিনে দিয়েছে।আমার গিন্নীকে তাই বলি,দেখো যার কেউ নেই তার ভগবান আছে।সৎ পথে থাকলে ভগবান বনে অন্ন জোটাবে।তোমাদের মতো মানুষরা আছে বলেই ভরসা পাই।বিশ্বাস করি‌।আর সেই বিশ্বাস নিয়ে আজও চলছি।আসি মা ,ওষুধের দোকান গুলো কোনদিকটায় গেলে খোলা পাবো বলো তো ?? তোমারও অনেক দেরী হলো তাই না মা ৷ ভালো থেকো গো মেয়ে বলে বৃদ্ধার হাতটা শক্ত করে চেপে এগিয়ে গেলেন সামনের বড়ো রাস্তার দিকে ৷ আমি তখনও দাঁড়িয়ে আছি। ।কত কী শিখিয়ে দিয়ে গেল এই টুকু সময়ের মধ্যে।জীবনে বাঁচার জন্য অনেক অনেক টাকা লাগে না।লাগে সততা।লাগে বিশ্বাস।আর ভরসা করার জন্য একটা শক্ত হাত থাকলে ভালোবাসার অভাব হয় না।জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভালোবাসা যায়।শুধু বিশ্বাসটা রাখতে হয়।সত্যিই তো যার কেউ নেই তার ভগবান আছে।বুঝলাম ভগবান থাকে সবার পিছে সবার নিচে সব হারাদের মাঝে।
সকলে খুব ভালো থাকবেন ৷ আর এই অতিমারীরতে আরো বেঁধে বেঁধে থাকবেন ৷ নিজের সাধ্যমত ভরসার হাত বাড়িয়ে দেবেন একটা চেইন সিস্টেমের মতো ৷ আজ আপনি কারো পাশে থাকলে কাল কেউ অবশ্যই আপনার পাশে থাকবেন এইকথাটা মা ছোটোবেলা থেকেই বলতো আজ আরেক বার সত্য প্রমাণিত করল ৷
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।