• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব – ১)

কলকাতার ছড়া 

তখন গড়ে উঠছে কলকাতা। ভাগ হয়ে গেছে স্পষ্ট দুটি ভাগে। হোয়াইট টাউন ও ব্ল্যাক টাউন। সামাজিক বৈপরীত্যও স্পষ্ট। হোয়াইট টাউনে আভিজাত্য আর ব্ল্যাক টাউনে রোগ, মহামারী, অনাহার। বর্তমান লালবাজার, বিবাদি বাগ অঞ্চল ছিল সাহেবদের একচেটিয়া অধিকারে। প্রবেশের অধিকারও ছিল না দেশীয়দের। আর বর্তমান শোভাবাজার, বাগবাজার, চিৎপুর ছিল দেশীয় নেটিভ টাউন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে কলকাতা শহর একেবারেই ইংরেজ বণিকদের বদান্যতায় তৈরি হয়ে ওঠা এক আজব নগরী। চোখের পাতা ফেলার নিমেষে অজ পাড়াগাঁ থেকে রমরমে নগর। এইসবকিছু নিয়ে ধীরে ধীরে আলোচনা করা যাবে আগামীর পর্বগুলোয়। তবে কলকাতার আজব উত্থানের কিঞ্চিৎ পরিচয় দেওয়া যাক। পলাশীর যুদ্ধের আগে ১৭১৫ সালে কলকাতার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১২০০০। অথচ ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে প্রায় ৬ লাখ। ১৭০৬ সালে আজকের তিলোত্তমায় পাকাবাড়ির সংখ্যা মাত্র ৮টি। আর নবাব সিরাজদ্দৌলা যখন সৈন্যসামন্ত বাগিয়ে রণহুংকার ছেড়ে কলকাতা আক্রমণ করলেন অর্থাৎ ১৭৫৬ সালে পাকাবাড়ি প্রায় ৪৯৮ টি। সবটাই গড়ে উঠছিল নবাব বাদশার চোখের আড়ালে। সাধে কী আর চটেছিলেন সিরাজ? কি? আশ্চর্য শহর নয় এই কলকাতা? কলকাতায় ইংরেজদের অনেক আগে পা রেখেছিলেন আর্মেনিয় বণিকরা। আজও জব চার্ণকের আগমনের আগের এক আর্মেনিয় মেমসাহেবের সমাধি দেখতে পাওয়া যায় সেন্ট জন্স চার্চের সংলগ্ন কবরে। এটিই প্রমাণ দেয় ইংরেজ এই শহরের প্রথম অতিথি নয় মোটেই। তবে ইংরেজ কোম্পানীর কর্মচারীরা সব বিষয়েই এক আলাদা কৌশল সহকারে ব্যবসা করতেন। তাই দেশীয় শক্তিকে দমন করে তাদের রাজদণ্ড তুলে নিতে খুব একটা অসুবিধাও হয় নি। প্রথম দিকে খুব তাড়াতাড়ি ব্যবসায় লাভের কৌশল অদ্ভুত ভাবে আয়ত্ত ছিল এইসব বিলিতি বেনিয়াদের। এমনকি সেযুগেও বাগবাজারের পেরিন সাহেব বেআইনি জাহাজে করে বিদেশে ব্যবসা করছেন সেই নথীও কোম্পানির পুরনো কাগজ থেকে পাওয়া যায়। আজ যেখানে বাগবাজার সার্বজনীনের দুর্গোৎসব হয়, পলাশীর যুদ্ধের আগে সেখানেই ছিল এই অবৈধ বণিক পেরিনের বিশাল অট্টালিকা। এইসব জাল ব্যবসায়ের গল্প এদেশীয় সকলেই জানত। অবাকও হত। তাই সে সময় এই কথা মুখে মুখে প্রচলিত ছিল—
“সাহেব মেরা বেনিয়া, করে সকল ব্যাপার |
বিন ডারি বিন্ পলরা, যোখে সকল সংসার |”

আবার সামান্য কোনো সরকারী কাজের জন্যও খুশি করতে হত ইংরেজ অফিসার থেকে শুরু করে দপ্তরের দেশীয় কর্মচারীদেরও। ঘুষ শুধু আজকের দিনে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা জিনিস নয়। কলকাতা শহরের আশ্চর্য উত্থানে এভাবেই জুড়ে আছে বহু জুয়াচুরির ইতিহাস। বণিকের জাত ইংরেজ এদেশে এসে যে আজব কর্মসংস্কৃতির গোড়াপত্তন করেন, তার গুণাবলিই আজও চলে আসছে দিকে দিকে। এ দেশের লোক কলকাতায় কোম্পানীর কর্মচারী ও উমেদারদের এমন বহু গুণ দেখে মুখে মুখে বলত-
“জাল জুয়াচুরি মিথ্যাকথা |
এই তিন নিয়ে কলিকাতা ||”

ক্রমশ…

[তথ্যসূত্র – ‘কলিকাতা দর্পণ’, রাধারমণ মিত্র,
‘৩০০ বছরের কলকাতা’, ডঃ অতুল সুর,
১৯৩০ সালে ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘প্রাচীন কলকাতার পরিচয়’, শ্রী হরিহর শেঠ]
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।