সরকারি হিসেবে বলা হয় ৫ থেকে ১৪ বছরের শিশুরা হল শিশু শ্রমিক । কিন্তু আমরা জানি ৫ নয় ৪ থেকেই শুরু হয়ে যাচ্ছে শ্রমিক জীবন l ২০১১ সালের সেন্সার বলছে সারা দেশে প্রায় ১০ কোটির ও বেশি শিশু শ্রমিক। বর্ণপরিচয় সহজপাঠ নয়, ওদের শিক্ষা শুরু হয় সেই ভোর হতে, আর শেষ হয় দিনাবসানে বা গভীর রাতে। ওদের গুরুকুল চায়ের দোকান, পাইস হোটেল, ধাবা, ইটভাটা, মোটর গ্যারাজ, পাথর খাদান, ফ্ল্যাটবাড়ি, কাঠের গুদাম, লেদ প্লাস্টিক কারখানা— বিস্তৃত সে পরিমণ্ডল l ব্যাপক আকাশ l তবে সে আকাশে আলো নেই, শুধুই মেঘলা আবছায়া আর কালো অন্ধকার l আছে বঞ্চনা অপুষ্টি লাঞ্ছনা যৌনহেনস্থা আর মাদকের নেশাগ্রস্ত স্বপ্নহীন ধোঁয়াটে জীবন। গভীর দারিদ্র্য, শ্রেণী বিভাজন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, প্রান্তিক মানুষজনের অসচেতনতা আর ভয়াবহ বেকারত্ব এই শিশুশ্রমের মূলে। ভারতবর্ষে শিশুশ্রম আজ ভয়াবহ আকার নিয়েছে।
অথচ কত আলো, কত আয়োজন চারপাশে l শিশুশিক্ষা, শিশুস্বাস্থ্যের জন্য আমাদের কত না ঢক্কানিনাদ। কুমীরের চোখে জল। বাধ্যতামূলক শিশুশিক্ষা আইন, সবই আজ প্রহসনে পরিণত। গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে ভোট আসে, প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে যায়। সর্বজনীন শিক্ষা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, শিশু সুরক্ষা অধিকার আইন, শিশুশ্রম বিরোধী আইন, কত বিন্যস্ত সুচারু কারুকার্যময় বাহারি বিলাপ ! অথচ এই ভারতবর্ষেই দিন দিন শিশুশ্রম বাড়ছে।
আমাদের ভারতবর্ষে শিশু শ্রমিকদের বেশির ভাগটাই আসে তপশিলি জাতি-উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর জাতি এবং দলিত সম্প্রদায় থেকে। এছাড়াও একটা বড় অংশ আসে বাস্তুহারা পরিবার থেকে। দেশের সার্বিক উন্নয়নের কাজে বিভিন্ন প্রকল্পে যাদের ভিটে-মাটি হারাতে হয়েছে কিংবা রাজনৈতিক সংঘর্ষ-পীড়িত ও সন্ত্রাস কবলিত এলাকার পরিবার থেকে ।
গোটা ভারতবর্ষে ৬ থেকে ১২ কোটি শিশু শ্রমিক l এটা সরকারী হিসেব, তাই এর মধ্যে অনেকটা রাজনীতি ঢুকে আছে, বাস্তব আরও নিদারুণ এক ভয়াবহ চিত্র দেয় । দারিদ্র্য আর সামাজিক সুরক্ষার অভাব এই শিশুশ্রমের আসল কারণ l উন্নত দেশগুলিতে সামাজিক সুরক্ষা বলয় থাকে, কিন্তু ভারতবর্ষের মত তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়শীল দেশে সামাজিক সুরক্ষা না থাকায় আর উদার অর্থনীতির ধাক্কায় বেসরকারীকরণের ফলে বেকার সমস্যা ভয়াবহ আকার নিয়েছে। সমাজের প্রান্তিক মানুষজন নানান সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ও কর্মহীন হয়ে অন্ন সংস্থানের জন্য বাধ্য হচ্ছে নাবালক ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন কাজে পাঠাতে বা বিক্রি করে দিতে। আর এই বিক্রি হয়ে যাওয়া শিশুদের শিশু শ্রমিকে পরিণত করা হয়। তাদেরকে দিয়ে অমানবিক ভাবে পরিশ্রম করানো হয়। ক্ষুধার অন্ন দেওয়া হয় না। নামমাত্র মজুরিতে উদয়াস্ত খাটানো হয়। শারীরিক রুগ্নতা ও অসুস্থতাকে পাত্তা দেওয়া হয়না। এছাড়া আরো একটা মর্মান্তিক দিক আছে শিশু শ্রমিকদের । সেটা হলো বেগার খাটা। অনেকটা দাস প্রথার মত। শিশুর অভিভাবক হয়ত মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে এই শর্তে যে, কাজ করে তা শোধ করে দেবে । সেখানে বাধ্য হয়ে যুক্ত করা হয় শিশুদের । বিশেষ করে চাষের কাজে, চালকল, ইটভাটা, পাথর ভাঙা প্রভৃতি কাজে ৷ আর কন্যা সন্তান হলে তাকে লাগানো হয় দেহ ব্যবসার কাজে।
স্বাস্থ্য শিক্ষার পরিকাঠামোহীনতা, সামাজিক সুরক্ষার অভাব, দারিদ্র্য এখানে শিশুশ্রমের উৎস l কম পয়সা দিয়ে, অনেক ক্ষেত্রে শুধু সামান্য খাদ্যের বিনিময়ে আট থেকে তের চোদ্দ ঘন্টা খাটিয়ে নেওয়া হয় l শৈশব চুরির এই সওদা আমাদের দেশে বেশ প্রকাশ্যেই চলছে। শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মানুষ শিশুশ্রম বিরোধী মিছিলে হাঁটছেন, আবার বাড়িতে সব সময়ের কাজের লোক রাখছেন শিশুদের l তাদের দিয়ে গাড়ি ধোয়ানো, অফিসে ঝাড়পোঁচ, দোকানে খাটানো, এমনকি রান্নাবান্না সবই চলছে l যে বয়সে খেলাধুলো পড়াশোনা আর আনন্দ করার সময়, তখন এই শিশুরা অসুস্থ পরিবেশে অমানবিক কায়িক ক্লেশে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে অন্ধকারে দিন গুনছে। বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে সরকার আসে সরকার যায় শিশুর শৈশব আর ফেরে না । কোন এক অজ্ঞাত কারণে শিশুশ্রম বিলোপে সরকারি কোন সদিচ্ছা নেই। মহান ভারতের ভদ্রজন উদাসী নির্লিপ্ত ! শুধু ভোটের স্লোগান হয় ‘বেটি পড়াও, বেটি বাঁচাও’ l কিন্তু শিশুরা আর বাঁচে না।
“তবু ‘দুর্গা’ তাকে আজ কতদিন দ্যাখেনি আকাশ !
রৌরব-অন্ধকারে সেই মৃতা বালিকার শব—
মাটি ও মানুষ ছাড়া চৌরঙ্গী পাড়ায়
‘অপু’ শুধু গাড়ি ধোয়, কাজ করে যন্তরে মেশিনে…
এভাবেই শিশু মরে,শিশু মারে, বদল হয় সভ্যতার সাজ।”