তারপর—- হরিহর কুঠিরের সেই ভূতেরা (এই পর্বের সব ফটো সৌজন্য: গৌতম বাড়ই)
ভূতেরা কী না করতে পারে! এখনও। আমার ধারাবাহিক লিখতে গিয়ে যা কখনও হয়নি, তা এবারে হল তো? সম্পাদককে যথাসময়ে লেখা দিতে পারলাম না আর পর্ব – ১৩ একসপ্তাহ বাদে। তাহলে ভূতেরা আছে তো!
রহস্যময় সেই বাড়ির অন্দরমহলটাই আকর্ষণ করত বেশি। একে তো পরিত্যক্ত বাড়ি। এ বাড়িটি বাবু শ্রী হরিচরণ মজুমদার নামে কোন ভদ্রলোক তৈরী করেছিলেন। তখনও শিলিগুড়ি মহকুমা শহর হয়নি। আশ্চর্য লাগবে এখন শিলিগুড়ি থেকে অনেকটা দূরে ফাঁসিদেওয়ায় ছিল মহকুমার অফিস আদালত। সেই আদালতে ওকালতি করতেন সম্ভবতঃ এই হরিচরণ মজুমদার। অনেকে বলেন ১৯৬২ সালের চিনের সাথে যুদ্ধের আগে পর্যন্ত ঐ বাড়িতে বসবাস ছিল, তারপর কবে যেন পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে হরিহর কুঠির। আর লোকমুখে শুনতে পাওয়া যায় ঐ বাড়িতে এক বীভৎস খুন আর আত্মহত্যার ঘটনা। তারপর আরও কিছু রহস্যময় ঘটনা। যখন কোন কিছুর উত্তর আর সঠিক ভাবে পাওয়া যায় না, তখন রহস্য ঘিরে ধরে তাকে।
এতবড় একটি বাড়ি একদম ঘনবসতিপূর্ণ বাজার এলাকায় পরিত্যক্ত কেন? কেন ঝোপঝাড় আগাছায় ভর্তি? উল্টো দিকেই পুলিশের থানা, তবে? এর সঠিক উত্তর কারও কাছে ছিলনা। তাই শিলিগুড়ির একমাত্র হন্টেড হাউস হয়েও হারিয়ে গিয়েছে কালের গর্ভে। সেই রাতের ছায়া- ছায়া মুখ তারপরেও দেখেছি রাতের অন্ধকারে। হয়ত অন্ধকার আমার মনে ঐ কল্পনার বাস্তবতা হয়ে দেখা দিত। শুনেছিলাম রাতের অন্ধকারে এক মহিলার মায়াবী কান্না শোনা যেত। একজন পাঞ্জাবী শিখ পরিবার নাকি ঐ বাড়ির শেষ বাসিন্দা। হয়ত বাড়িওয়ালার কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে ছিলেন। জনশ্রুতি, সেই পরিবারটির সবার আশ্চর্যজনক ভাবে মৃত্যু ঘটে ঐ বাড়ির ভেতরে। তারপর পরিত্যক্ত ঐ বাড়ি শিলিগুড়ির ভূতের বাড়ি। অনেক জায়গা নিয়ে এই তো সেদিন আটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিরাজ করে গিয়েছে সে বাড়ি। তবে আজ আর সেই বাড়ি নেই। যখন ছিল তখন বেশ খবরে ছিল। আমাদের ঐ ভূতের বাড়ির সামনে দিয়ে ছিল রোজ যাতায়াত। তারপর একদিন চোখের সামনেই দেখতে পেলাম প্রচুর লোকজন মিলে ঐ ঝোপঝাড়ের সাথে এই বড় ইমারত ভেঙ্গে ফেলছে। ভূতেরবাড়ি লোপাট হচ্ছে।
এখন সেখানে বহুতল দৃশ্যমান। ব্যাঙ্ক, বিভিন্ন বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, শো- রুম সেই খানে দেখা যাবে। ১৯৮৫- ৮৬ সালেই সেই বাড়ি ভেঙ্গে বহুতলের কাজ শুরু হয়। এ প্রজন্মের তোমাদের কাছে আজ তাই অজানা অচেনা শিলিগুড়ির ভূতের বাড়ি। শুধু ভূতের বাড়ি হারাল না এই শহর, হারিয়ে গেল শিলিগুড়ির একমাত্র হেরিটেজ বাড়িও। আমার এই লেখা দেখেও যদি আরও কিছু তথ্য অন্যান্য কারও কাছ থেকে পাওয়া যেত তাহলে খুবই ভালো লাগতো। আমার স্মৃতিকথার ঝুলি থেকে তাই বেরিয়ে পড়ে এইসব ঝিকিমিকিরা।
আমাদের প্রত্যেকের মনের ভেতর সেই রহস্যের টান, প্রত্যেকের মনেই থাকে ভূতের গল্প। তাই আজও এই তথ্য প্রযুক্তির যুগেও অনেকটা দখল করে থাকে সেই হন্টেড হাউসগুলো। শিলিগুড়ির একটু ওপরে যেমন কালিম্পং আর কার্শিয়াং- র ডাউহিলের ভূতবাড়িগুলো আছে আবার মহানগর কলকাতাতেও আছে ভূতবাড়ি। থাকুক। মানুষ থাকুক আর ভূত- ও থাকুক, সব থাকুক পাশাপাশি। কেউ কারও ক্ষতি না করলেই হল। শুধু হরিহর কুঠিরের মতন হারিয়ে যাওয়াটাই দুঃখের আর বড় মনোকষ্টের।