‘কাল- প্রবাহ বহি যায়
নদীর- ই স্রোতের প্রায়। ‘
আমরাও সবাই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন্তে বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে হাই- স্কুলে পড়ছি; মামার বাড়ি যাবার পর্বও কমে এসেছে। মামাও পড়াশোনা শেষ করে কাজের ক্ষেত্রে বাস করছে; মামার গ্রামের বাড়ি তালা বন্ধ। সময়ের তালে আমি ও এখন ক্লাশ নাইনের ছাত্র; বিজ্ঞান- মনস্ক ভাব চোখে মুখে। বিনা তর্কে, কিছু না মানার প্রবনতা অধিক, স্বরে পরিবর্তন এসেছে, লোকে বলাবলি করে, বয়ঃসন্ধি কাল। । একদিন স্কুলে খবর পেলাম, আমাদের পাড়ায় ভূতের দেখা মিলেছে; বিকাল বেলায়, স্কুল থেকে এসে কয়েক জন বন্ধু মিলে ভূত দেখতে এসেছি। আমাদের বাড়ির উল্টো দিকে একটা প্রকাণ্ড বড় পুকুর, ঐ পুকুরের কাছেই রয়েছে এক বিরাট পুরোনো ভাঙ্গা বাড়ি ও পাড়ের অন্যান্য দিকে আম বাগান। ঐ আমবাগানের কিছু অংশ পরিস্কার করে পুব- বাংলা থেকে আগত অনেকেই বাড়ি করেছেন। রেলে চাকুরি- জীবী, অমূল্য চরন মুখুজ্জ্যে মশাইও এখানে বাড়ি করেছেন; তাঁর ভাই প্রফুল্ল চরন সদ্য বিবাহিত, কলকাতার কোন এক প্রেসে কাজ করেন।
আমরা, সদলবলে বাড়ির বাঁশের আগড় খুলে ভিতরে প্রবেশ করেছি। চারদিক বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। ঘরের খোলা বারান্দায় প্রফুল্ল বাবু বিরস- বদনে বসে আছেন, ঘরের বাইরে থেকে শিকল তোলা। আমাদের আগমন বার্তা পৌঁছে গেছে। ভূত -রূপী
ঐ মহিলা আলুথালু বেশে জানালার কাছে বললো, ” ভূত দেখতে এসেছিস, একটা বিড়ি দে।” বিড়ি নেই শুনে, ওয়াক, থু, ওয়াক, থু করে থুথু নিক্ষেপ করায় আমরা সতর্ক হয়ে দূরে থাকি। ভদ্র মহিলা, অপরূপ সুন্দরী, একডাল চুল; বঙ্কিমচন্দ্র মশাই’র দুর্গেশনন্দিনীর আয়েশার চুলের বর্ণনা মনে পাড়িয়ে দেয়। পাড়ার ধন্বন্তরী ডাঃ, পচা মামা এটাকে মনোরোগ বলে চিহ্নিত করেছেন; ডাঃ বললে, হবে! পাড়ার হিতাকাঙ্ক্ষীরা ওঝার শরণাপন্ন হবার উপদেশ দিয়েছে।ঐ ভাঙ্গা বাড়ির ভূত মেয়েটিকে ধরেছে, ও মেয়ে টি কে নিয়ে তবে যাবে।অতএব,চলুক ভূত- ওঝার মারণ উচ্চাটন নিক্ষেপ ক্রমাগত।বাড়ির লোকে কেউ ঘরে থাকতে পারবে না। সারা রাত ঘরে থাকবে শুধু ওঝা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গো, আর ঐ ভূত-রূপী সুন্দরী। কয়েক দিন চলেছে মারন- উচ্চাটন, তারপর ভূতের পশ্চাদপসরণ। ভূত ভেগেছে।
মহিলা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছেন,কিছু দিন পরে সুন্দর,সুস্থ সন্তানের জননী হয়েছেন। শুধু পাড়া- প্রতি বেশীদের চাপা গুঞ্জন শুরু হয়েছে, সন্তানের মুখের আদলে না কি ঐ ওঝার এক সাগরেদের মুখ ফুটে উঠছে; ঐ সাগরেদ আমাদের অঞ্চলেরই বাসিন্দা।
স্কুল- কলেজের পাট চুকিয়ে চাকরি করছি, নতুন জায়গায় বাড়ি করেছি ; গৃহ প্রবেশের কয়েক দিনের পরই ঘেরা বারান্দা থেকে কোলাপ্সিবল গেটের খান তিনেক বড় বড় তালা ভেঙ্গে, আমার শখের স্কুটারটি চুরি হয়েছে, মনটা খারাপ। পুরোনো বাড়ির খোলা উঠোনে গাড়ি পড়ে থাকতো, আর এখানে! ঘেরা বারান্দার তালা ভেঙ্গে—–। নাঃ, বাড়িটা বোধ হয় আমার কাছে অশুভ; পাড়ার লোকে আগ বাড়িয়ে এসে বলে, সকলের কাছে নতুন বাড়ি সয়না, যাগ- যজ্ঞ করতে হয় ইত্যাদি, ইত্যাদি। যাই হোক, চুরি যাওয়ার তিনদিনের মাথায় মেমারী ( বর্দ্ধমান) থানা থেকে স্কুটার ফেরৎ এলো। ফেরৎ পেলে হবে!চললো বামুনের আনা- গোনা, পুজো-আচ্ছা; যাক্ শান্তি নামলেই হলো।
রাত জেগে পড়াশোনা করা অভ্যাস, ঘুমিয়ে পড়েছি; হঠাৎ ক্রিং—— ক’রে রাতের বেলা বেজে উঠলো কলিং বেল। ঘুম ভেঙ্গে দরজা খুলে বারান্দায় আসা মাত্র বেল থেমে গেছে, বারান্দার জানালা খুলে কাউকে না দেখে , কোন বদমাশ ছেলের কাণ্ড বলে বোধ হওয়াই স্বাভাবিক। বেশ চলছে; আবার কয়েক দিন পরে রাতের বেলা জোরে বাজলো ক্রিং———। এবার কোন শব্দ না ক’রে টর্চটা নিয়ে আমি ও আমার ঘরনী বারান্দার জানালা খুলেই টর্চ ফেলেছি কলি
– বেলে, দেখি এক হতভাগ্য টিকটিকির ল্যাজ তখনও নড়ছে। নড়া থামতেই, বেল- বাজাও থেমেছে। টিকটিকি পোকা ধরতে কলিংবেলের সুইচ- বোর্ডের ফোকরে মাথা গলিয়েছে, ব্যস শক খেয়ে আমাদের চিন্তায় ফেলেছে। পরের দিন দুটোর মৃতদেহ আমাকে ফেলতে হয়েছে। যাই হোক, না এগিয়ে গেলে ঐ রহস্য ভূত- ভূমিকায়, অদৃশ্যে কত কী খেলা দেখাতো কে জানে!