• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ২৩)

আমার মেয়েবেলা

(আমার প্রথম প্রেম)

প্রেমে সব মানুষই পড়ে। তাই আমিও বেশ গুছিয়েই প্রেমে পড়েছিলাম। সেই সময় অদ্ভুত সব আচরণ করতাম। মায়ের সজাগ দৃষ্টি এড়িয়ে কিভাবে যে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম জানিনা।
আমার জীবনের সব থেকে প্রধান সমস্যা ছিল কাউকে কোনও দিন আমার সবটুকু বলতে পারিনি। সব ঝড় আমি একাই সামলেছি। বাবা মা বন্ধুদের সব বললেও কিছু রেখে দিতাম শুধু নিজের জন্য। শুধুই আমার আমিটার জন্য।
আজ মেয়েবেলা লিখতে বসে চোখের সামনে যেন ভেসে উঠছে সেই তেরো চোদ্দ পনের বছরের অসহায় এক কিশোরী। যে সব সময়ই ভুগত এক সাংঘাতিক একাকিত্বে। কিন্তু কিছুতেই নিজের কথা বলার মতো কাউকে খুঁজে না পাওয়ায়– যে সারা জীবনই রয়ে গিয়েছে একা। একদমই একা।

যা বলছিলাম,,,
সেই সময় মনে হতো একটু গিয়ে বসি গঙ্গার ধারে। কিন্তু সেই সময় আমার এবং আমাদের সেখানে বসা বারণ ছিল। একা একা রাস্তায় বেরোনো বারণ ছিল। কারোর সঙ্গে বেশি কথা বলা বারণ ছিল। ছাতে বেশিক্ষণ থাকা বারণ ছিল। বিকেলে মাঠে খেলা বারণ ছিল। ছোট থেকে যে বন্ধুর সঙ্গে স্কুলে খেলা করেছি, মারামারি করেছি। সে রাতারাতি পুরুষবন্ধু হয়ে যাওয়ায় তার সঙ্গে কথা বলাও বারণ ছিল। ওদের দেখলে চোখ নামিয়ে নিতাম। যেন কাউকে দেখিই নি আমি। ঠিক সেই সময় থেকেই ভেতরে ভেতরে একটা কষ্ট যন্ত্রণায় আমার মনটার থেঁতলে যাওয়া শুরু হল।

কিন্তু এতসব বারণের পরেও মা আমার মনটাকে কিছুতেই বাঁধতে পারল না। মায়ের কিছু অযৌক্তিক অবাস্তব শাসনে বিধ্বস্ত আমি আস্তে আস্তে গুটিয়ে যেতে শুরু করলাম। আমার শৈশব আমার কৈশোরের আমিটাকে একটু একটু করে যেন শামুকের খোলোসের মধ্যে ঢুকে যেতে দেখলাম। সেই সময়ের ডানপিটে ঝগড়ুটে রোগা লিকলিকে ধুলো বালি মেখে থাকা ফর্সা গালের ঝাঁকড়া চুলের ছটফটে ধানিলঙ্কা (ছেলে বন্ধুদের দেওয়া নাম) মেয়েটাকে নিজের তৈরি খোলোসের মধ্যে চিরকালের নির্বাসনে চলে যেতে দেখেছিলাম আমি নিজেই,,, একা।
আমার কিচ্ছু করার ছিলনা। বলা যায় ক্ষমতা ছিল না। এত শাসনের মধ্যেও তবুও একটা দুরন্ত প্রজাপতি খেলে বেড়াতেই লাগল আমার মনের সুন্দর বাগানে। আর রয়ে গেল সে সেখানেই আজীবন।
আমি তখন ষোড়শী। আমার মনের একটা অদ্ভুত পরিবর্তনে জেরবার হয়ে যাওয়া আমি তখন দিশেহারা।
কখনও রাহুল দেব বর্মনের ‘কী হবে আর পুরোনো দিনের কথা আজ তুলে,, কিছু ভুলেছো তুমি,, আমিও গেছি ভুলে’–
গানটা শুনে আনমনা আমি ভিজে চোখ মুছে নিচ্ছি।
আবার কখনও একটা অসম্ভব ভালোলাগায় ভেসে যাচ্ছি সেই গান শুনে ‘বলো কী আছেগো তোমার এই আঁখিতে।’
শোনার পর মনে হচ্ছে শুধু আমার কথা ভেবেই তিনি গান গাইছেন। এই গান শুধু আমাকে নিয়েই, আমারই জন্য,,,
একটু একটু করে আমার অনিকেত দার জন্ম হচ্ছে। অথচ আমিই বুঝতেই পারছি না। সে যে কী অসহায় অবস্থা!
ওঁর গান শুনে তখন পাগল আমি। ওঁকে দেখতে ইচ্ছে করছে, ছুঁতে ইচ্ছে করছে। কী যে করি সবসময় কেমন যেন একটা আনচানানি ভাব,,,একটা অদ্ভুত ছেলেমানুষি। মনে হচ্ছে এই তো আমার স্বপ্নের সেই রাজকুমার! আমার অনিকেতদা!

রাতের পর রাত কেটে যাচ্ছে আমার স্বপ্নের রাজকুমারের কথা ভেবে। কিন্তু একেই যে প্রেম বলে সেকথা আমি বুঝে ছিলাম অনেক পরে।

বয়ঃসন্ধির সমস্যা আমাকে উত্যক্ত করে মেরেছে।আর এই জন্যই যে আমার মনের,, শরীরের এতো পরিবর্তন সেকথা আমি সেই সময় বুঝতেই পারিনি। আমার কোন বন্ধু ছিলনা। কেউ বলে দেয় নি।
কারণ আমি একটু বড়ো হতেই কারোর সঙ্গে সেভাবে মিশতেই পারিনি। স্কুল বাদ দিয়ে আমাকে সব সময় বাড়ির মধ্যেই থাকতে হতো। কোনও প্রিয় বন্ধু ছিল না আমার । দাদা দিদি কেউ ছিল না যাকে আমি আমার সমস্যার কথা বলতে পারতাম।
তাই আমার কথা আমি কোনও দিন কাউকেই বলতে পারি নি। হয়তো বলতেই চাইনি।
তাই কেউ জানতেও পারেনি আর আমিও বুঝতে পারিনি, জানতে পারিনি আমার এই অজানা ভালোবাসার কথা, আমার এই বয়ঃসন্ধির সমস্যার কথা। কী যে কষ্ট বোঝাতে পারতাম না। বয়ঃসন্ধির সমস্যা নিয়ে ভাবার মতো মানসিকতা সেই সময় আমাদের অভিভাবকদের মধ্যে তো ছিলই না।
আসলে আমার কাউকে বলার মতো তো কিছুই ছিল না।
যাকেই দেখছি স্বপ্নের রাজকুমারের সঙ্গে মেলাতে চাইছি। আমি বার বার প্রেমে পড়ছি। আর বারবারই ফিরে আসছি।
আমার অনিকেত দার সঙ্গে কারোর চোখ মিলছে তো কারোর চুল, কারোর কথাবলা ভালো লাগছে তো কারোর ঠোঁট। এভাবে কী হয়?
আমার মনের মানুষের খবর তাই কাউকে বলতেই পারলাম না। যখনই বলতে চেষ্টা করেছি তার কথা, মোহভঙ্গ হয়েছে। ফিরে এসেছি। কষ্ট হয়েছে, যন্ত্রণা এসে বিঁধেছে সোজা হৃদয়ে। ভেঙে পড়েছি। কিন্তু সময় নিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। এগিয়ে গিয়েছি।
কিন্তু এর পরবর্তীতে যেটা হল, কাউকে আমার আর কোনও দিন কিছুই বলা হল না। পায়ে পায়ে এগোতে চাই জানানোও হল না। একই রাস্তা ধরে ফিরে আসাও হল না, রাত জেগে চিঠি লেখা সেও আর হল না, এক সাথে ভিজে ঘাসে পা রাখাও হল না।

হল না অনেক কিছুই। যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা, যাকে শুধু স্বপ্নেই পাওয়া। বাস্তবে পেলাম না কোথাও কোনদিন । আসলে স্বপ্নের পুরুষটিকে যে পাওয়া যায় না সেকথাও আমি বুঝেছিলাম অনেক পরে।

কাউকে বলতে না পারার কষ্ট যন্ত্রণা নিয়ে, দিনের পর দিন কাটিয়েছি আমি একাই। ইচ্ছে হলেও তবু কাউকে জিজ্ঞেস করিনি,,, কেন আমার এমন হয়! এ কিসের পাগলামি আমার? কার কথা ভেবে? কে সে ??
আজ বুঝতে পারি সে আর কেউ নয়——
সে আমার প্রথম ভালোবাসা আমার প্রথম প্রেম,,,, আমার,,,, শুধু আমার অনিকেত দা,,,,,,,,,,

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।