• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মানস চক্রবর্ত্তী – ৩

মর্তকায়ার অন্তরালে 

||তিন ||

 এরপর রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিমোহনকে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসাবে পেতে চেয়ে শিলাইদহ থেকে একটি চিঠি লিখলেন | তারিখ ১লা ফাল্গুন ১৩১৪ | আমরা এবার সেই চিঠিতে চোখ রাখব :
                              ওঁ
                                                                  শিলাইদহ
                                                                    নদিয়া
সবিনয় নমস্কারপূর্ব্বক নিবেদন
বোলপুরে আমি কিছুদিন হইতে একটি ব্রহ্মচর্য্যাশ্রম স্থাপন করিয়া বালকদিগকে শিক্ষা দিতেছি | আপনার সম্বন্ধে আমি যেরূপ সংবাদ পাইয়াছি তাহাতে এখানকার কর্ম্মে আপনাকে আবদ্ধ করিবার জন্য বিশেষ উৎসুক হইয়াছি | যদি অনুগ্রহ করিয়া এই কার্য্যে যোগদান করেন তবে আমি সহায়বান হইব | এবং যাহাতে আপনার আর্থিক ক্ষতি না হয় সেইরূপ ব্যবস্থা করিয়া দিব | আমার বিশ্বাস সেখানকার কর্ম্মে আপনি আনন্দ লাভ করিতে পারিবেন |
ইতি ১লা ফাল্গুন ১৩১৪
                                                              ভবদীয়
                                                   শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিঠিটা ক্ষিতিমোহনের হাতে পৌঁছাল দিন চারেক পরে | ক্ষিতিমোহন কিন্তু একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না | “আশ্রমের কাজ ! কোন্ সাহসে যোগ দেব | তাঁকে নিজ অযোগ্যতার কথা জানালাম | ” এখানে স্মরণ রাখতে হবে ক্ষিতিমোহন অধ্যাপনার কাছে অনুপযুক্ত ছিলেন তা কিন্তু নয় | তাঁর প্রধান বাধা তখন বোধহয় অর্থনৈতিক | ক্ষিতিমোহন লিখলেন : “সংসারী মানুষ | বড় ভাই মারা গেছেন | পুত্রশোকাতুর বৃদ্ধ পিতা শক্তিহীন | সব ভার আমার উপর | আশ্রমের কাজে যোগ দেব কোন্ সাহসে ? হিমালয়ের কাজে ভবিষ্যৎ ছিল | কাশীর কলেজের ইংরাজ অধ্যাপকরাও ভালোবাসতেন , তাঁরা ডাকছিলেন | কবিরাজীটাও পড়া ছিল – এই কুলবিদ্যা নিয়ে কলিকাতায় বসবার কথা সবাই বলেছিলেন |”
অবশ্য এটা যে ক্ষিতিমোহনের মনের কথা ছিল না দ্বিতীয় চিঠিটা তাঁরই প্রমাণ | পুরো চিঠিটা এখানে উল্লেখ করব না | প্রবন্ধের স্বার্থে চিঠির নির্বাচিত কিছু অংশের উল্লেখ করব | তারিখ ১২ই ফাল্গুন ১৩১৪ | আর্থিক কথার  উল্লেখ আর এই চিঠিতে করলেন না | “এখন কবে আমি যোগদান করিতে পারি সেটাই বিবেচ্য | রাজার সঙ্গে যেরূপ আমার কথাবার্ত্তা তাহাতে তিন মাসের পূর্ব্বে তাঁহাকে পদত্যাগের কথা জ্ঞাপন করিতে হইবে | সে অনুসারে আমি যখন মার্চ্চের শেষে চম্বা রাজ্যে ফিরিব এবং এপ্রিলে ত্যাগপত্র দিব তখন হইতে জুলাই মাস পর্য্যন্ত আমাকে রাজ্যে থাকিতে হইবে |
এখানে জুন মাসটা ছুটি | আমি বহুদিন বাড়ীতে যাই নাই | সে সময়টা ছুটি উপলক্ষ্যে বাড়ী হইয়া আসিতে পারিব | এ আমার একটা যুক্তি | স্বার্থপর যুক্তিও বটে | দেশে গিয়া লোকেরও সন্ধান করিব |
এই চম্বা রাজ্য সুরা ও ব্যভিচারের আশ্রয়স্বরূপ | এখানে এইসব ব্যসন দূষণীয় নহে | কাজেই ছেলেরা ভয় করে চরিত্রহীন শিক্ষকদের নিষ্পেষণকে | আমি পদত্যাগের কথা ভাবিতেছি এই খবর শোনামাত্রই ছাত্ররা আমাকে ধরিয়াছে , একজন ভালো লোক দিয়া যাইবেন | ছাত্ররা জানে পরবর্তী শিক্ষক মনোনয়ন আমাকেই করিতে হইবে |
আমি আমার কার্য্যত্যাগের বিষয় রাজার সেক্রেটারীকে জানাইয়াছি | তবে রাজাকে না জানাইলে তাহা বিধিসম্মত জ্ঞাপনরূপে পরিগণিত হইবে না | আশা করি আপনি ইহাতে সম্মতি দান করিয়া আমাকে নিশ্চিন্ত করিবেন |”
এই চিঠিখানি রবীন্দ্রনাথের হাতে পৌঁছানোর পূর্বেই রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিমোহনকে দ্বিতীয় চিঠিখানি লিখে ফেলেছেন | এই চিঠিটা ক্ষিতিমোহনের প্রথম চিঠির উত্তর | বিশেষ লক্ষণীয় ক্ষিতিমোহন যেদিন দ্বিতীয় চিঠিখানি লিখলেন রবীন্দ্রনাথ সেইদিনই প্রথম চিঠির উত্তর দিলেন | রবীন্দ্রনাথ লিখলেন :
                              ওঁ
                                                                শিলাইদহ
                                                                   নদীয়া
সবিনয় নমস্কারপূর্ব্বক নিবেদন
আপনার পত্র পড়িয়া নিরাশ হইলাম , তথাপি আশা পরিত্যাগ করিতে প্রবৃত্তি হইতেছে না | যে লক্ষ্য ধরিয়া আজ ছয় বৎসর কাল এই বিদ্যালয়কে প্রতিষ্ঠাদান করিবার চেষ্টা করিতেছি তাহা সিদ্ধ করিবার জন্য উপযুক্ত সহায়ের একান্ত আবশ্যক | এই কারণেই আপনার সন্ধান পাইয়া , আপনার অসম্মতি সত্ত্বেও পুনর্ব্বার আপনাকে সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ জানাইতেছি |এই বিদ্যালয়ে আপনি নিজের শক্তিকে সর্ব্বথা প্রয়োগ করিবার সুযোগ পাইবেন – ইহাতে যথার্থই আপনি সৃষ্টি করিয়া তুলিবার আনন্দ পাইবেন এবং ঈশ্বরের প্রসাদে এই সৃষ্টির দ্বারা দেশের একটি স্থায়ী মঙ্গলের প্রতিষ্ঠা হইতে পারে | এই কাজে আপনাদের সহায়তা আমি কেবলমাত্র প্রার্থনা করিব না – দাবী করিব | দেশে প্রকৃত শিক্ষার প্রয়োজন অত্যন্ত অধিক , এই প্রয়োজন পূরণ করিবার জন্য যদি আহ্বান প্রাপ্ত হন তবে কোনোমতেই তাহাকে অবহেলা করিবেন না | আমি ক্ষেত্র প্রস্তুত করিতেছি – এ ক্ষেত্র কর্ষণের দ্বারা ফলবান করিবেন আপনারা- এই চেষ্টাকে অকৃতার্থ হইতে দিবেন না | একবার গভীরভাবে ও উদারভাবে কথাটাকে ভাবিয়া দেখিবেন – যদি নিতান্তই অন্তঃকরণ হইতে কোনো সায় না পান তবেই আমি অন্যত্র সন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইব | ইতি ১২ই ফাল্গুন ১৩১৪
                                                             ভবদীয়
                                                    শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ইতিমধ্যে ক্ষিতিমোহনের লেখা ১২ই ফাল্গুনের চিঠি পেয়ে রবীন্দ্রনাথ অনেকখানি আশ্বস্ত হলেন এই ভেবে ক্ষিতিমোহন শান্তিনিকেতনে আসতে সম্মত আছেন | ১৬ই ফাল্গুন রবীন্দ্রনাথ লিখলেন :
                                 ওঁ
                                                                শিলাইদহ
                                                                  নদিয়া
সবিনয় নমস্কারসম্ভাষণমেতৎ
আপনার পত্রখানি পাইয়া আশ্বস্ত হইলাম | জুলাই পর্য্যন্তই অপেক্ষা করিব | কার্ত্তিকের মাঝামাঝি অথবা অগ্রহায়ণের প্রারম্ভেই আমাদের বিদ্যালয়ের শেশন আরম্ভ হয় | ভাদ্র মাস হইতে প্রায় আড়াই মাস তিন মাস বন্ধ থাকে | যদি শ্রাবণ মাসে আপনি নিষ্কৃতি পান তবে ছুটির কয়টা মাস বাদেই আপনাকে কাজে যোগ দিতে হইবে | যদি জ্যৈষ্ঠ অন্তত আষাঢ়ের মধ্যেও আসেন তবে পূর্ব্বেই কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইতে পারিবেন | যেরূপ ভালো বিবেচনা করেন আমাকে জানাইবেন এবং মাসিক বৃত্তি কিরূপ হইলে আপনাকে ক্ষতিগ্রস্থ না হইতে হয় তাহাও আমাকে লিখিবেন | আমাদের বিদ্যালয়টি সাশ্রম অর্থাৎ বোর্ডিং – অধ্যাপকগণ এখানে ছাত্রদের সহিত  একত্রেই বাস করেন | ইতি ১৬ই ফাল্গুন ১৩১৪
                                                                      ভবদীয়
                                                          শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
( বানান অপরিবর্তিত )

ক্রমশ …

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *