তৌগান নানা গাঁজা ও বিড়ির মশলা দিয়ে হুঁকো সেজে টানতে শুরু করলে তার গল্প বলার মেজাজ আসে। সে সময় গল্পের বায়না ধরলে নানা ফেরায় না। একদিন আমরা বাচ্চারা সবাই ধরেছিলাম আরো বাঘের গল্প শোনার জন্য।
নানা শুরু করলো, তখন মাঘ মাসের জাড়। মাঠের ধান কাটা হ’য়ে গেছে । কিছু কিছু কেঁচোল জমিতে গম সরষে আলুর চাষ হয়েছে, আর পানির অভাবে সমগ্র মাঠ ফাঁকা প’ড়ে আছে। সেই সময় একদিন তোদের সোলেমান নানা গেছিল নবগ্রাম থানার কুশমোড় গ্রামে এক আত্মীয়ের সাথে দেখা করতে। ঐ দিনই ফিরবে ব’লে গেছিল বাড়িতে। সে রাত দুপুর হ’য়ে যায়, সোলেমান আর ফিরে না ।তখনকার মানুষের রাতবিরিতে চলাফেরার একটা রেওয়াজ হ। কারণ, তখন সাধারণ মানুষের পায়ে হাঁটাই ছিল একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম। তার আত্মীয়ের বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা হ’য়ে গেলো।
সোলেমান নানাও খুব সাহসী ও নির্ভয় ছিলো। ভয়ডর নাই। হাতে পাকাহীর চুকচুকে লাঠি, মাথায় পাগড়ি আর বগলে ঝোলা নিয়ে নানা বাড়ি রওয়ানা হলো।
শুনশান মাঠের রাস্তা। শীতকালের রাত।কোথাও কোনো জনপ্রাণী নাই। মাঝেমধ্যে শুধু দূরবর্তী শিয়াল বা কেঁদো বাঘের ডাক শোনা যাচ্ছে। – – রাত দু’টো নাগাদ সে বাড়ির গ্রামে ঢুকতে যাবে , এমন সময় দূর থেকে একটা ঝড় আসার মতো সাঁ সাঁ সাঁ সাঁ আওয়াজ শুনতে পেলো। সে অভিজ্ঞ ঝানু লোক। এর আগে অনেকবার সে বাঘের সামনে পড়েছে। তৎক্ষণাৎ সে বুঝতে পারলো কালাচিতির মাঠের জঙ্গল থেকে শেলা বাঘ দুরন্ত বেগে মনিগ্রামের শালবনে ফিরছে মাঠের মধ্য দিয়ে। এইটাই তার একটা রাস্তা। ।সে তো একলাফে বারো হাত যায়। মুহূর্ত্তে এসে পড়বে। সে দেখলো , সামনে একটা বহু পুরোনো পাকুড় গাছ আছে। সে জানতো, তাতে একটু উঁচুতে মানুষ ঢুকে যাওয়ার মতো একটা বড়ো কোটর আছে। সে তক্ষুণি সেই কোটরের মধ্যে ঠেলেঠুলে ঢুকে পড়লো।কাপড়চোপড় বাইরে বেরিয়ে থাকলো কিনা দেখার সময়টুকুও পেলো না। মিনিটের মধ্যে সেই পাকুড় গাছের তলা দিয়ে তীরের বেগে প্রকাণ্ড শেলা বাঘ বেরিয়ে গেলো। নানা এক ঝলক দেখলো তার আগুনের গোলার মতো চোখের চারপাশে শুধু জোনাকির ঝড় । নানা জানতো, বাঘ যখন লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড় লাগায় তখন তার আশপাশে তার নজর থাকে না, শুধু সামনে নজর থাকে । তার সামনে পড়লে আর রক্ষা নাই । – – – সামনের গ্রামে যেতে হবে। তখনো অনেক রাত বাকি।
বাঘ চ’লে গেল, নাকি গ্রামেই কোনো গোয়াল ঘরে হামলা করলো বুঝতে পারলো না। তাই সে কোটর থেকে বেরোবর সাহস পেল না।কোটরেই চেপ্টে ভোর পর্যন্ত লেগে থাকলো।আর বাঘের ডাকের কাঁপুনিতে আর প্রচন্ড শীতে সে অজ্ঞান হ’য়ে গেল। ভোর বেলায় বাড়ির লোকজন খুঁজতে গিয়ে দ্যাখে, ওই পাকুড় গাছের নীচে সোলেমানের লাঠিটা প’ড়ে আছে । ওই কোটর থেকে ওরা তাকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে আর বাড়ি এনে সেঁকাপোড়া ক ‘রে তার জ্ঞান ফেরায়। সেই থেকে সে আর বেশী রাতে বাড়ির বাইরে যেতো না
তৌগান নানা হুঁকো টেনে বললো, যা তোরা ভাগ এবার, আমার কাজ আছে। তার হুঙ্কারে আমরা সবাই বাড়ি ছুটলাম। চাদ্দিকে যেন বাঘের ভয়…