ফুলেশ্বরী একটি নদী আর সেটি পেরিয়ে গেলে জোড়াপাণি বলে আরও একটি নদী। দুটো নদী পেরিয়ে গেলে সবুজ জঙ্গলের রেখা। সেই জঙ্গলের নাম বৈকন্ঠপুর। ঐ বৈকুন্ঠপুরের জঙ্গলের গভীর থেকেই বেরিয়ে এসেছে এই ছোটো পাহাড়ি ঝোরার মতন নদীগুলি। এখন শহরের যত আবর্জনা এই নদীগুলো দিয়ে প্রবাহিত হয়। ঘুঘুমালিতে আমরা এক- দুবার চড়কের মেলা দেখতে গিয়েছিলাম। তবে ঐ মেলার বীভৎসতা দেখে আমি তার বর্ণনা করব না। এও আমাদের এক ধরনের পুজোর উদযাপন। বাঙলা ক্যালেন্ডারের শেষ মাস চৈত্রের শেষ দিনে এ উদযাপিত হয় হিন্দুধর্মের বিশেষ এক সম্প্রদায় বা শ্রেণীর মানুষদের দ্বারা। ঐ জঙ্গলের ভেতর শীতের শেষে বনদূর্গার পূজা হয়। সারারাত মানুষজন ওখানে যায়। আমি জঙ্গলের গল্পে আজ আর যাব না। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে মস্ত সেই ভূতের বাড়ি। রোজ দু- বেলা দেখতাম আর অবাক চোখে ভয়ে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম।’হরিহর কুঠির’ সেই বাড়ির নাম বা ভূতের বাড়ির নাম।
শিলিগুড়ির তখন একটি মাত্র থানা। বলাবাহুল্য সেই থানা আকারে প্রকারে অনেক বড়। থানার উল্টোদিকে ছিল এই ভূতের বাড়ি। একমাত্র হেরিটেজ বা পুরানো আমলের পাকাবাড়ি বলতে ওটাই। বাড়ির সামনে ফলকে দেখতাম ঐ নামটি আর এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না মজুমদার পদবী কারোর এই বিল্ডিংটি ছিল। দিনের বেলায় স্কুল যাবার পথে বেশ বীরপুরুষ হয়ে তাকিয়ে দেখি এ বাড়িটি। চাদ্দিকে অনেক জায়গা নিয়ে পাঁচিল দিয়ে ঝোপঝাড়ের সাথে এই বাড়িটি, যা এক্কেবারে বড় রাস্তার উপরে। লাল ইঁটের বাড়ি। আমার স্কুলের বন্ধু প্রবীর একদিন স্কুল ফেরতা পথে বলল একদম ফিসফিস করে যেন ভূতেরা শুনতে পারবে এই ভয়ে— ঐ ভূতের বাড়ির ঘটনাটা জানিস তো?
আমি বললাম– জানি বড়দের কিছু কিছু আলোচনায়। তবে ভূত আছেই ঐ বাড়ির ভেতরে। একদিন ঢুকবি কলাহাটির পেছন দিয়ে? প্রবীর বলল— তোর মাথা খারাপ হয়েছে!
দিনের আলোতে তেনারা থাকেন না, আবার সূর্য ডুবতেই একে- একে ভূতেরা এসে পড়েন। কোন এক পুলিশ অফিসার নাকি একবার চ্যালেঞ্জ করে ঐ বাড়ির ভেতর ঢুকেছিল। হরিহর কুটিরে পরদিন তার রিভলবার আর পুলিশের পোশাক পড়েছিল, আস্ত মানুষটি গায়েব। থানা থেকে রাত দুটোর সময় শুধুমাত্র একটি গুলির শব্দ শোনা গিয়েছিল। এক পুলিশকাকুর মুখ থেকে সেই ছোট্টবেলায় শোনা এ গল্পটি।
(চৈত্র সংক্রান্তি ও চড়কের মেলা। পাপুন ভট্টাচার্য্যের তোলা ফটো)
একদিন রাতে হাকিমপাড়া থেকে এক নেমন্তন্ন বাড়ি থেকে নিজেদের বাড়ি ফিরছি, থানার কাছে আসতে ভয়ে ভয়ে চোখ গেল ঐ ভূতের বাড়ির দিকেই, একদম সত্যি বলছি কিছু ছায়ামূর্তি আর লাল- লাল আগুনে চোখ দেখলাম অন্ধকারে। বাবাকে বলতেই বাবা বলল— এ ভুল দেখা। চোখের ভুল। আর মা চুপ করে ছিল। পরে বলেছিল, তুই যা দেখেছিস সত্যি। মায়েরা তো সত্যি কথাই বলে, তাই না?
(জলকেলিতে। পোড়াঝাড়। মহানন্দা। এই ডিসেম্বরে তোলা পাপুন ভট্টাচার্য্যের ফটো)
সেই হরিহর কুটিরের নাম আর শিলিগুড়ির সেই ভূতের বাড়ির কথা পুরানো বাসিন্দারা সবাই জানে। এখনও জিগ্গেস করলে যে কেউ বলে দেবে। তবে এই ভূতের বাড়ি ছিল একদম জমজমাট বাজারের ধারে। পরের সপ্তাহে বলব হরিহর কুটিরের আরও কিছু ভূতের গল্প।