• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মানস চক্রবর্ত্তী – ১

|| এক ||

রবীন্দ্র রসায়নে রবীন্দ্র কক্ষপথে

‘অ্যাকা নবরতন ক্ষিতিমোহন’ – রবীন্দ্রনাথের বড়োদাদা দ্বিজেন্দ্র নাথের দরাজ সার্টিফিকেট ক্ষিতিমোহনের প্রতি | ‘অ্যাকা নবরতন ক্ষিতিমোহন’ – এই যে অভিধা ক্ষিতিমোহনের নিজস্ব উপার্জন | এই উপার্জনের ব্যাখ্যা এই প্রবন্ধের মধ্যে অনালোচিতই থাকবে | রবীন্দ্রনাথ এই নবরতনকে পাওয়ার জন্য কতখানি ব্যাকুল এবং ক্ষিতিমোহনও রবীন্দ্র রসায়নে কতখানি সম্পৃক্ত হয়ে রবীন্দ্র কক্ষপথে এলেন তার কিঞ্চিৎ পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা মাত্র এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য |
তপোবনের আদর্শে একটি আধুনিক শিক্ষাদানের উপযোগী বিদ্যালয় স্থাপনের ইচ্ছা তখন রবীন্দ্রনাথের সমস্ত অন্তর জুড়ে | জগদীশ বসুকে লেখা চিঠি এর সাক্ষ্য বহন করে :
“শান্তিনিকেতনে আমি একটি বিদ্যালয় খুলিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতেছি | সেখানে ঠিক প্রাচীন কালের গুরুগৃহবাসের মত সমস্ত নিয়ম | বিলাসিতার নামগন্ধ থাকিবে না – ধনী দরিদ্র সকলকেই কঠিন ব্রহ্মচর্য্যে দীক্ষিত হইতে হইবে | উপযুক্ত শিক্ষক কোন মতেই খুঁজিয়া পাইতেছি না |”
ঐ বছরই অর্থাৎ ১৯০১ সালের ২২ ডিসেম্বর ( বাংলা ৭ পৌষ ১৩০৮ ) গুটিকয়েক মাত্র ছেলেকে নিয়ে শান্তিনিকেতন আশ্রমে একটি আবাসিক বিদ্যালয়ের উদবোধন হল | ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রতিষ্ঠা উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ যে সংগীত রচনা করলেন তার মধ্যে দিয়ে বিপদ, মৃত্যু , দুঃখ-কষ্ট জয়ের অভয়মন্ত্রের সুরটি ছড়িয়ে দিলেন |
“মোরা সত্যের পরে মন আজি করিব সমর্পণ |
জয় জয় সত্যের জয় |
মোরা বুঝিব সত্য , পুজিব সত্য , খুঁজিব সত্যধন |
জয় জয় সত্যের জয় |
যদি দুঃখে দহিতে হয় তবু মিথ্যা চিন্তা নয় |
যদি দৈন্য বহিতে হয় তবু মিথ্যা কর্ম নয় |
যদি দণ্ড সহিতে হয় তবু মিথ্যা বাক্য নয় |
জয় জয় সত্যের জয় |
এই অভয় মন্ত্রটা রবীন্দ্র রসায়ন বুঝতে যথেষ্ট সাহায্য করবে |
এরপর বেশ কয়েকটা বছর গড়িয়ে গেলো | ইতিমধ্যে কনিষ্ঠ পুত্রের মৃত্যু গতিরোধ করলেও গতিহীন করতে পারল না | যোগ্য শিক্ষকের সন্ধান চলছিলই | ১৯০৭ সালের শেষের দিকে ভূপেন্দ্রনাথ সান্যালকে লেখা চিঠিতে এই কথার উল্লেখ আছে | – “শক্ত লোক চাই – সত্য লোক চাই |” ১৯০৮এর ২ জানুয়ারি ( বাংলা ১৭পৌষ ১৩১৪ ) তাঁকে আবার লিখলেন , “কর্তব্যবায়ুগ্রস্ত লোক জগতে দুর্লভ নয় ; কিন্তু যথার্থ ভক্তিসরস গভীর অন্তঃকরণের লোকের জন্য আমি হাৎড়ে বেড়াচ্চি- আপনাকে তেমন লোক আর একটি দিতে পারলে আমার বড় পরিতৃপ্তি হত |”
রবীন্দ্রনাথ তেমন একটি লোকের সন্ধান পেয়ে গেলেন | অজিত কুমার চক্রবর্তীকে লেখা চিঠিই এই সাক্ষ্য বহন করে – ” এই ছেলেটির কাছ থেকেই ক্ষিতিমোহনের কথা আমি প্রথম শুনি | তাঁর সাহিত্যানুরাগ ও বিদ্যাবুদ্ধির কথাতেই যে আমি উৎসাহিত হয়েছি তা নয় , এর মধ্যেও ওই লোকপ্রেমের সংবাদ পেয়েছি , ইনিও ওই বালকটির সঙ্গে গ্রামে কাজ করে ফিরেচেন- লোকসেবার উৎসাহ তাঁর পক্ষে যেরকম স্বাভাবিক সেইটে জেনেই আমি তাঁকে বোলপুরে আবদ্ধ করতে এত উৎসুক হয়েছি | সুশিক্ষিত সুযোগ্য এম. এ . ডিগ্রীধারী বেতন দিলেই পাওয়া যায় , কিন্তু যে জিনিসটা পুঁথিগত নয় , সেটা আমাদের দেশে কতো দুর্লভ তা তো জানো |
ক্ষিতিমোহনবাবুর সম্বন্ধে আর একটি কথা শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি | তিনি যদিও প্রাচীন শাস্ত্রজ্ঞ তথাপি তিনি অত্যন্ত উদার | তিনি বলেন এই ওদার্য তিনি শাস্ত্র হতেই লাভ করেছেন | হিন্দুধর্মকে যাঁরা নিতান্ত সংকীর্ণ করে অপমানিত করেন তাঁদের মধ্যে এঁর দৃষ্টান্ত হয়তো কাজ করবে | অন্তত ছাত্রদের মনকে সংকীর্ণতামুক্ত করতে পারার পক্ষে ইনি অনেকটা সাহায্য করতে পারবেন |”
‘এই ছেলেটির ‘ – যাঁর কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিমোহনের কথা প্রথম শুনলেন তাঁর পরিচয় নেবার যথেষ্ট প্রয়োজন আছে | ছেলেটি কালীমোহন ঘোষ | রবীন্দ্র কক্ষপথে ক্ষিতিমোহনের আসার পথে কালীমোহনই প্রধান সহায় |
পূর্ববঙ্গে চাঁদপুরে ছিল কালীমোহনের পৈতিক বাড়ি | দেশ যখন বঙ্গভঙ্গ রোধের আন্দোলনে মাতোয়ারা , তখন রবীন্দ্রনাথ স্বদেশ প্রেমের গান ও ছেলেদিকে নিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে রাখী পরিয়ে দিচ্ছেন | স্বদেশ প্রেমের সেই ঢেউ আছড়ে পড়ল পূর্ববঙ্গে | স্বদেশ প্রেমের ঢেউ উত্তাল করে তুলল পূর্ববঙ্গবাসীদের | আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কালীমোহন ঘোষ নামে এক যুবক | কালীমোহন গ্রামে-গঞ্জে বক্তৃতা দিয়ে ফিরতে লাগলেন | ঘুরতে ঘুরতে এসে উপস্থিত হলেন বিক্রমপুরের সোনারঙ গ্রামে | আন্দোলনের সূত্রেই পরিচয় হলো ক্ষিতিমোহনের সঙ্গে | কালীমোহনের মাকেই ক্ষিতিমোহন মা বলে ডাকতেন | অপরদিকে কালীমোহনের মা তাঁর নিজের বড়ো সন্তানটিকে হারিয়ে ক্ষিতিমোহনকেই সন্তানরূপে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন | একইসঙ্গে মনে রাখতে হবে ক্ষিতিমোহন যখন নিজের মা দয়াময়ী দেবীকে হারালেন তখন সম্পূর্ণরূপে মা মা বলে কালীমোহনের মাকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন | কালীমোহনের মা সেই আহ্বানে পূর্ণ সম্মতি জানিয়েছিলেন |
যাইহোক পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরি সারাদিন বক্তৃতা দিয়ে ঘুরে দুই বন্ধু যখন ক্লান্ত শরীরে সোনারঙ গ্রামে ফিরতেন ক্ষিতিমোহন জননী সস্নেহে তাদেরকে আহারে বসিয়ে হাওয়া করতেন | মাতৃস্নেহে দুই যুবকের ক্লান্তি নিমেষে দূর হয়ে যেত |
তারপর দুজনের শুরু হতো রবীন্দ্র সাহিত্য পাঠচর্চা | রাত অধিক হলে ক্ষিতিমোহনের মা একপ্রকার জোর করেই পাঠচর্চায় নিবিষ্ট দুই সন্তানকে শুতে পাঠাতেন | এই প্রসঙ্গে বলে নিই তখন কারুরই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হয়নি | যেটুকু হয়েছে সেটুকুর মাধ্যম রবীন্দ্র সাহিত্য |
ক্ষিতিমোহন প্রথম রবীন্দ্র কাব্যের নাম শুনলেন কালীকৃষ্ণ মজুমদার নামে এক তরুণ জ্ঞান রসিকের কাছে | এর কিছুদিন পর বিপিন দাশগুপ্ত নামে আর এক তরুণের কাছে পেলেন রবীন্দ্র কাব্যের স্বাদ | গঙ্গার ঘাটে শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে বিপিন দাশগুপ্ত শোনাতেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা | রবীন্দ্রনাথের ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যের ‘চিরদিন’ কবিতাটা শুনিয়ে বিপিন দাশগুপ্ত ক্ষিতিমোহনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কবিতাটি বোধগম্য হলো কিনা ? ক্ষিতিমোহনের উত্তর অর্থাৎ ব্যাখ্যা বিপিন দাশগুপ্তকে নিশ্চয় সন্তুষ্ট করেছিল , নচেৎ দেশে ফিরবার সময় রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ এবং আরো কয়েকটা বই পড়তে দিয়ে যেতেন না |

( চলবে )

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।