সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে শম্পা রায় বোস (পর্ব – ২১)
by
·
Published
· Updated
আমার মেয়েবেলা
( আমার দুই বন্ধু )
আমি সারাদিন স্কুল করে, বাড়ি এসেই স্কুলের ব্যাগটা নিয়ে বসে পড়তাম। প্রথমেই রুটিন গোছাতাম। তারপর ইতিহাস বইটা বার করতাম। ইতিহাস পড়তে আমার খুব ভালো লাগত। তারপর ভূগোল বাংলা ইংরেজি,,,,,,,
পড়তে ভাল না লাগলে খাতায় মার্জিন টানতাম। কোন কোন সময় গল্পের বই পড়তাম।
কিংবা গান করতাম। এইভাবে সময় কাটত আমার সাধের বিকেলটা।
বিকেলে বেরোনো বন্ধ। সাইকেল চালানো বন্ধ। কারোর সঙ্গে গল্প করা বন্ধ। পর্দা ফাঁক করে দেখতাম সবাই কী সুন্দর খেলা করছে। কান্না পেত তখন। বায়োলজিক্যালি তখন আমি বড়ো হয়ে গেছি। বাবা কোন কোন দিন মুখের দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সাইকেলের চাবিটা দিয়ে বলত যা একপাক ঘুরে আয় । আমি বসছি বারান্দায়। মা কিছু বলবে না।
আমি সাইকেলে এক চক্কর দিয়েই চুপিসারে ঢুকে পড়তাম বাড়িতে। মা অত টের পেত না। আর তাছাড়া তখন বাবা থাকত তাই অতটা চাপ ছিল না।
তখন থেকেই আমি কেমন ভেতর ভেতর বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবতাম বড়ো জোর কী করবে মারবে ,,,
আর না হয় বাইরে বার করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দেবে। বসে থাকব বারান্দায় । যেই কারোর সঙ্গে কথা বলব মা ঠিক ঘরে ডেকে নেবে,,,,,,,
তারপর যা বলছিলাম অনেক কিছু ইচ্ছে থাকলেও সেসব আমার আর কোন দিন করা হয়নি। ছাতে শুয়ে তারা গোনা হয় নি। তখন মনের ভেতরে অনিকেত দা উঁকি দিচ্ছে। একটা অদ্ভুত অনুভূতি। কারোর সঙ্গেই অনিকেতদাকে মেলাতে পারছিনা। কেমন যেন একটা অস্থিরতা। কিচ্ছু ভাল লাগে না। নিজের জন্য নিজের সঙ্গে নিভৃতে একটু সময় কাটাব তারও উপায় নেই। একটা পরাধীন জীবন,,,,,,,,,
আমি ছোট বেলায় যেমন পরাধীন ছিলাম বিয়ের পরও মা আমাকে তেমনই পরাধীন করে রেখেছিল। বাপের বাড়ি গেলেও সেভাবে মা আমাকে কারোর সঙ্গে মিশতেই দিত না। সব সময় ঘরেই থাকতে হত। তাই আমার মা কোনও দিন আমার বন্ধু হতে পারে নি। আমার আত্মীয় স্বজন কেউ না। শুনেছি নিজের লোকেরা খুব ভালো বন্ধু হয় । কিন্তু আমার জীবনে সেরকম কিছু ঘটে নি। মনের গোপন কথা আমি অনাত্মীয় বন্ধুদেরই বলি।
######
স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কতকিছু যে ভাবতাম, কতকিছু দেখতাম!
কিন্তু একটা সময় স্যার আমাকে ঠিক খুঁজে নিয়ে যেত ক্লাসে । খাতায় অঙ্ক করতে করতে মনের মধ্যে তখন যোগ রাগের আলাপ চলত।
মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় আমরা তিন শম্পা বেশ কাছাকাছিই বসে ছিলাম। এই দুই শম্পা অংকে খুব ভাল। বলা যায় পড়াশোনাতেও খুব ভাল। এক শম্পা (ভট্টাচার্য ) আমার সামনে। আর আর এক শম্পা (মিত্র) আমার পাশে বসেছিল। শম্পা মিত্রকে বললাম, বীজগণিত আর জ্যামিতি পারব ।কিন্তু পাটিগণিতটা একটু সামলে দিস্ ভাই।
এর পর একসঙ্গে অংক করতে শুরু করলাম। মোটামুটি যখন বুঝলাম আমার পাশ নম্বর উঠে গেছে তখন শম্পা কে বললাম, আর তোর খাতা দেখব না। আমি আর তুই অংকে এক নম্বর পাব এটা হয় না। অধর্ম হবে।
অংকে পাশ করে যাব। ব্যাস্ আমি এটুকুতেই খুশি।
আমি ইচ্ছে করলে পুরোটাই ওর দেখে অংক করতে পারতাম। আর ওর মতো আমিও হয়তো ৮০|৯০ পেয়ে যেতাম। কিন্তু আমি সেটা চাইনি।
ছোট থেকেই আমার চাহিদা ছিল খুব কম। যতটুকু চাইতাম ততটুকু পেলেই খুশি হতাম। অনেক পাবার কথা কোনও দিন ভাবিই নি।
তখন থেকেই পাপ পুণ্য ধর্ম অধর্ম এসব খুব মানতাম আর বিশ্বাসও করতাম। পাওয়ার পরও আরও কত বেশি পাওয়া যায় এই চিন্তা কোনও দিন মাথায় আসে নি। আমার বাবা এবং মা যেমন ছিলেন সৎ এবং ভগবান বিশ্বাসী আমাদের দুই ভাইবোন কেও তেমন ভাবেই মানুষ করেছিলেন। আমাদের কোনও চাহিদা ছিল না বলেই হয়তো আমি মানসিক ভাবে খুব সুখী। অনেক পেয়েছি ভেবে এখন ও পর্যন্ত ঘুমের ওষুধ না খেয়ে সারে দশটা এগারো টায় ঘুমিয়ে পড়ি। এবং ভগবান কে একটা বড়ো থ্যাঙ্কু জানাই এই বলে যে, উনি আজ আমাকে যা দিয়েছেন তা আমি কোনও দিন স্বপ্নেও ভাবি নি।
কী পাইনি,,,, আমার হয়তো অনেককিছুই পাওয়ার ছিল,,,,, আমার জীবনটা আর একটু অন্য রকম হওয়া উচিত ছিল,,,,,
না এসব কোনও দিন ভাবিই না। ভগবান যা দিয়েছেন ভগবান যা করেছেন যা ভেবেছেন সবই আমার ভালোর জন্যই। তিনি আমার খারাপ কেন চাইবেন? আমাকে কত যত্ন করে সৃষ্টি করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। নিজের সন্তানের কেউ ক্ষতি চায়? তাহলে ভগবান কেন চাইবেন? আমি তো তাঁর বড়ো ভালোবাসার বড়োই আদরের। আমি কোন দিন তাঁকে অবিশ্বাস করিনি ,,,অভিযোগের আঙুল তুলি নি তাঁর দিকে । এমন ধৃষ্টতা যেন না হয় আমার । সব সময় মনে হয় যা পেয়েছি অনেক পেয়েছি। অনেকেই আমার মতো পায় না। তাহলে তারাও তো রয়েছে সেই তাঁকে বিশ্বাস করে!
####
আমি সবসময়ই বাবা কে অনুসরণ করতাম।
বাবার মতো যতটা সম্ভব সকলের উপকার করার চেষ্টা করতাম। সেই সময় আমি আবেগে ভেসে যাওয়া কতটা সহজ সরল বোকা একটা মেয়ে ছিলাম আজ সেটা বুঝতে পারি, তাও এই বয়েসে এসে। কলকাতা আমাকে সাবালক করেছে। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে একটু একটু করে আমি আমার সেই আমিটাকে হারিয়েছি। পাল্টে ফেলেছি নিজেকে। বলা যায় পাল্টাতে বাধ্য হয়েছি। না হলে যে বাঁচা যাচ্ছিল না। বার বার অপমানিত অসম্মানিত হচ্ছিলাম। আমার নতুন জন্ম হয়েছিল এই কলকাতায় এসে। কীভাবে সেই আমি থেকে আজকের আমিতে পৌঁছলাম। তার গল্প বলব আর একদিন।
#####
আমি মাধ্যমিকে অঙ্কে পেয়েছিলাম ৫০। এটাই আমার জীবনে অংকে পাওয়া সর্বোচ্চ নম্বর। এবং তারজন্য আমি সব ক্রেডিট টাই আমার বন্ধু শম্পা মিত্রকে দিতে চাই। ও না থাকলে হয়ত আমি সেবার মাধ্যমিকে গাড্ডা খেতাম।
আমাকে অংক শুরু করার আগেই বলেছিল একদম ঘাবড়াবি না। ঠিক পারবি। তুই শুরু কর। ভুল হলে আমি বলব। ধীরে ধীরে অংক করতে শুরু করলাম। অংক শেষে উত্তরটা ওর খাতা দেখে মিলিয়ে নিলাম। যেই অংক মিলতে লাগল আমারও কনফিডেন্স বেড়ে গেল। সেইদিন জীবনে শিক্ষা পেয়েছিলাম কঠিন পরিস্থিতিতে কিভাবে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়।
সারা জীবন ওকে মনে রেখেছি। ও যেন আমার শরীরের সঙ্গে মিশে আছে।
পরবর্তীতে ও হারভার্ড (Harvard) ইউনিভার্সিটি তে পড়াত।
আমার সব থেকে আপসোস,,
বড্ড আপসোস এই কারণে যে হায়ার সেকেন্ডারির পর আমার আর কোনো দিন ওর সঙ্গে দেখাই হল না। শেষ চিঠি পেয়েছিলাম ওর বিয়েতে। ও আসতে বলেছিল। কিন্তু আমার যাওয়াই হয় নি। আমাদের সময় ফোন ছিল না। তাই না চাইলেও অনেক সম্পর্কের ইতি ঘটেছে।
আর কোন দিন ওর সঙ্গে আমার দেখা হবে না। কারণ ও আমাদের সকলকে কাঁদিয়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে। আমেরিকাতেই ও মারা যায়। বড্ড কষ্ট হয় ওর জন্য। খুব ভালোবাসতাম ওকে। ওর মধ্যে কোনও অহংকার ছিল না। খুব ভাল মেয়ে ছিল। ওর অভাব আমাকে খুব খোঁচা দেয়।
আমার আর এক বন্ধু শম্পা সেও খুব ভাল। শান্ত বিনয়ী আমার এই বন্ধুটি যেন ঠান্ডা বাতাস। খুব আস্তে আস্তে কথা বলে, ধীর স্থির। আমাকে যেন বটগাছের মতো আশ্রয়ে রাখে। আমার প্রতিটি কঠিন পরিস্থিতিতে মায়ের মতো হাত বাড়িয়ে দেয়। পরম মমতায় আমার মনের ক্ষত গুলো যে কিভাবে সারিয়ে তোলে বুঝতেই পারি না।
বর্তমানে ও একটি সরকারি স্কুলের প্রধানা শিক্ষিকা।আমরা আমাদের সব বন্ধুরাই খুব মিস করি আমাদের হারিয়ে যাওয়া সেই মেধাবী মিষ্টি শম্পা কে। আমার জীবনে পাওয়ার থেকে হারানোর সংখ্যাটাই বেশি। হারাতে হারাতে এখন আর হারানোর ভয় পাই না। ভাল লাগে না কিচ্ছু। শুধু মনে হয় যে করেই হোক জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই হবে। এবং সেটা অবশ্যই হাসিমুখে,,,সব যন্ত্রণা গিলে….