T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় কাকলি দেবনাথ
by
·
Published
· Updated
রবীন্দ্রনাথ জ্যেঠু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের পাড়াতেই থাকতেন।আরে না না , ইনি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ীর রবীন্দ্রনাথ নন।ইনি মৈথেলী ব্রাক্ষ্মন।নাম এক হওয়ার সুবাদে উনি নিজেকে বিশ্বকবির সমগোত্রীয়ই ভাবতেন।আমি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনা করে ওঁর কোন্ পাকা ধানে মই দিয়েছিলাম জানি না । দেখা হলেই বলতেন, ‘এই যে বাঙালীর ছেলে। বাংলাটা ঠিকমত জানো তো ? নাকি তোতাপাখীর মত শধু ইংলিশ বুলি আওড়াও।’ আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওঁর সামনে থেকে কেটে পড়তাম।জানতাম দাঁড়ালেই উনি আমার নাম নিয়ে পড়বেন।
আমার নাম পদ্মনাভ রায় চৌধুরী।আমার পূর্বপুরুষেরা তাদের জাতীয়তাবোধের প্রমান সরূপ বংশের সবার নামের সংগে জাতীয় ফুলকে যোগ করেছিলেন।আমার বাবার নাম পদ্মপলাশলোচন,তার বাবার নাম পদ্মেশ্বর,তার বাবার নাম ছিল পদ্মকুমার।তাও ভালো তারা জাতীয় ফুল নিয়েই দেশপ্রেম দেখিয়েছিলেন। জাতীয় পশু নিয়ে দেখালে অবস্থা অন্যরকম হত।
তা যা বলছিলাম , রবীন্দ্রনাথ জেঠুর সংগে দেখা হলেই উনি আমার নামের অর্থ,সমা্স,সন্ধি,বুৎপত্তিগত অর্থ কিছু না কিছু জিগ্যেস করবেনই।
একদিন বিকেলে আমি টিউশনে যাচ্ছি। উলটোদিক থেকে দেখি, জেঠু আর তার সুন্দরী নাতনী আসছে । আমাকে দেখে হাত তুলে ডাকলেন।আমি মনে মনে আমার নামের সন্ধি, সমাস, অর্থ একবার ঝালিয়ে নিলাম । হ্যাঁ সব মনে আছে। নিশ্চিন্ত মনে ওঁর দিকে এগোলাম।কাছে যেতেই বলে কিনা, ‘এই যে পদ্মপলাশলোচনের ছেলে, বলো তো,মহাভারতে কাকে পদ্মপলাশলোচন বলা হত?’
মহাভারতের কাউকেই আমি স্বচক্ষে কখনো দেখিনি । ছবিতে যা দেখেছি তাতে ধৃতরাষ্ট্র ছাড়া সবার চোখই সুন্দর।আমি মাথা নীচু করে বললাম, ‘জানিনা জ্যেঠু।’
এই কথা শুনে ওঁর সুন্দরী নাতনী খিলখিল করে হেসে উঠল।তখন আমার অনুরাগের বয়স ।সুন্দরী মহিলারা আমার কথায় হাসলে ভালোই লাগত ।কিন্তু এ হাসি যে, সে হাসি ছিল না, পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন ।
প্রত্যেক বছর রবীন্দ্রনাথ জেঠুর তত্বাবধানে আমাদের পাড়া থেকে একটা পত্রিকা বের হত।তাতে ওনার লেখা দুটি গল্প, পাঁচটা কবিতা,একটা বিষয়ভিত্তিক আলোচনা থাকবেই থাকবে।আমার মায়ের খুব দুঃখ ছিল আমি ওই পত্রিকায় কিছু লিখি না বলে।কবে কোন ছোট বেলায় স্কুলের ম্যাগাজিনে আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম,আমার মা ম্যাগাজিনের সেই পাতাটা ফ্রেমে বাঁধিয়ে আমাদের বসার ঘরে ঝুলিয়ে রেখেছিল।কেউ বাড়িতে এলেই দেখাত আর বলত, ‘আমার ছেলের লেখা । ছোটবেলায় দারুন লিখত।
আমি সরে আসতাম । ভুল করেও কেউ যদি কবিতাটা নিয়ে আমায় প্রশ্ন করত,উত্তর দিতে পারতাম না।কারন আমার বেশ মনে আছে, কবিতাটা আমার টিউশন টিচার লিখে দিয়েছিলেন।
যাইহোক একবছর মায়ের কড়া হকুম হলো, জেঠুর পত্রিকায় আমাকে একটা কবিতা লিখতেই হবে।আমি সারারাত জেগে আনেক কষ্টে একটা কবিতা দাঁড় করালাম।পরের দিন মিটিং এ পাড়ার বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই যে যার কবিতা, গল্প নিয়ে হাজির।রবীন্দ্রনাথ জেঠু সবাইকে ভুল শুধরে দিচ্ছেন।কেউ কেউ আবার বাতিলও হচ্ছে।এবার আমার পালা । আমি এগিয়ে গিয়ে আমার লেখাটা দিলাম।আমার মা ভদ্রলোকের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল, যেন ওঁর হ্যাঁ বা না এর সঙ্গে আমার নোবেল প্রাইজ পাওয়া নির্ভর করছে।আমার ইঞ্জিনিয়ার বাবা অতটা না হলেও বার বার আড়চোখে তাকাচ্ছিলেন।রবীন্দ্রনাথ জেঠু খুব মন দিয়ে কবিতাটা পড়ে বললেন, ‘ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলে তো , বাংলাটা একটু নড়বড়ে।আমি কারেকশন করে দিলাম।চিন্তা করিস না্,ছেপে দেব।’
আমি মুখটা কাঁচুমাচু করে বললাম,-‘জ্যেঠু, ওটা আমার লেখা নয় ।ওটা, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতা।কাল নেট ঘেটে বার করেছি।’