• Uncategorized
  • 0

T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় বিনীতা দত্ত

আমারে তুমি অশেষ করেছ

ছোটবেলায় যখন প্রথম গান শিখতে শুরু করি,তখন শিখেছিলাম,”আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি ….”। তখন গানের সব কথার মানে বুঝতাম না, কিন্তু মাষ্টারমশাই খুব যত্ন করে শেখাতেন।তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গাইতাম।গানের কথাগুলো আর সুরের ওঠা-পড়া খেলাটা খুব ভাল লাগতো।তারপর ধীরে ধীরে শিখলাম-“নৃত্যের তালে তালে…”।মাষ্টারমশাই বুঝিয়ে দিলেন, এটা নটরাজ অর্থাৎ মহাকাল শিবের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ।এই গানটির তিনটে ভাগ আছে,ভাগ তিনটের তাল,লয় আলাদা।আমার মনে হতো,গান গুলোতে যেন কেউ নেচে উঠছে!আমারও নেচে উঠতে ইচ্ছে করতো।কিন্তু আমি তো নাচ জানি না।শুধু অবাক চোখে অন্যদের নাচ দেখি।খুব ইচ্ছে হয় নাচতে,”শ্রাবণের ধারার মতো…”।কিন্তু আমার তো অতটা দক্ষতা নেই যে,নিজেই নাচের ভঙ্গিগুলো শিখে ফেলতে পারবো।সুতরাং….।
তারপর পড়তে শুরু করলাম রবীন্দ্রকবিতা, না,ভুল বললাম,ছড়া।নাকি ছড়ার আঙ্গিকে শ্লেষ!”বর এসেছে বীরের ছাঁদে বিয়ের লগ্ন আটটা…..”। ছোটরা সবাই বেশ হাত -মুখ নেড়ে আবৃত্তি করে, মজাদার কবিতা। কিন্তু এর গভীরে যে সূক্ষ দর্শন রয়েছে, তা বুঝি কিছুটা বড় হয়ে। হাসির ছলে লেখা হলেও আমাদের ভারতীয় সমাজে কন্যাপক্ষের প্রতি বরপক্ষের নিপীড়ণের এও এক চিত্র।
আমাদের স্কুলের লাইব্রেরিটা ছিল বইয়ে ঠাসা। তাতে ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রায় সব বই। ক্লাস থ্রি থেকেই লাইব্রেরিয়ান দিদিমনি নিজে বেছে ক্লাশ অনুযায়ী বই দিতেন। আমি তো বাড়ি এসেই ইউনিফর্ম না পালটেই বই পড়তে শুরু করে দিতাম। “পেটে খেলে পিঠে সয়”, “গুরুমশাই”, “আমার ছেলেবেলা” এসব পড়তে পড়তে তন্ময় হয়ে যেতাম। এক অদ্ভুত আনন্দ পেতাম। যেন অন্য এক জগৎ। রবীন্দ্রনাথের বইয়ের মধ্যে যেন অন্য এক রূপকথার জগৎ। না, সেখানে রাজা রানি নেই, কিন্তু তার চেয়েও ঝলমলে, তার চেয়েও মনোমুগ্ধকর শব্দ আর ভাষার জগৎ আমাকে মোহাবিষ্ট করে রাখত।
আমার বোন, ছোট থেকেই নাচ শেখে, নানা রকম নাচের সঙ্গে যুক্ত।তাই, টেপ রেকর্ডারে (তখনও সি ডি, মোবাইল আসে নি) প্রায় সারা দিন (পরীক্ষার সময় ছাড়া) ধরে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজতো, তার সঙ্গে চলতো নাচের প্র্যাকটিশ। বার বার শুনে শুনে শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা, শাপমোচন, চন্ডালিকা, বাল্মিকী প্রতিভার গান প্রায় মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল।শ্যামার উত্তীয়ের “আমারও পরানও যাহা চায়” শুনে আমার খুব কষ্ট হত। উত্তীয়ের আত্মত্যাগ ভেবে গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে আসত। আর যে শ্যামা এত কষ্ট করে বজ্রসেনকে বাঁচাল, সে শেষ পর্যন্ত শ্যামাকে আঘাত করে দূরে সরিয়ে দিল, উত্তীয়ের কথা জেনে। কিন্তু শ্যামার কী-ই বা করার ছিল, সে তো উত্তীয়কে ভালবাসতো না, তাকে আত্ম বলিদানের জন্য শ্যামা বাধ্যও করে নি। শ্যামার কথা ভেবে আমার খুব দুঃখ হত। রবীন্দ্রনাথ কেন শ্যামার উপর অবিচার করলেন? রাজনর্তকী বলে? সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা কম বলে? শ্যামার কী কিছুই প্রাপ্তি ছিল না? তার ভালবাসা এতই তুচ্ছ? কী জানি!রবীন্দ্রনাথের উপর আমার এজন্য অভিমান হয়।আসলে,যাকে ভালবাসি,শয়নে,স্বপনে রাখি,তার উপরেই তো অভিমান করা যায়।রবীন্দ্রনাথ তো আমার কাছের মানুষ,উপলব্ধিতে, মননে।
চন্ডালিকায় দেখি, জাতপাত তুচ্ছ হয়ে যায়, মানুষই সেখানে বড়। তখন কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। এই গানটা যেন আজকের দিনের জাতপাত, ধর্ম, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মনুষ্যত্বের জয়ধ্বজা উড়িয়ে দেয়। – “যে মানব আমি, সেই মানব তুমি কন্যা, সেই বারি তীর্থ বারি, যাহা পূর্ণ করে তৃষিতেরে।“
যখন বড় হয়ে শাপমোচন নৃত্যনাট্য দেখি, তখন দেখি অসুন্দরের মধ্যে সুন্দরের প্রকাশ!বাহ্যিক কুরূপের কাছে মানসিক সৌন্দর্য্য বিকশিত হয় পূর্ণতা নিয়ে।ভালবাসা জয়ী হয়।
গল্পগুচ্ছ যখন পড়তে শুরু করি, তখন আমি স্কুলের শেষ ধাপে। ছুটি, পোস্টমাস্টার, সমাপ্তি, কাবুলিওয়ালা….আরও সব গল্প পড়ে আশ্চর্য হয়ে যেতাম। বিভিন্ন ধরনের গল্প যেন সমাজের বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন মানুষ, সমাজ জীবন, সব কিছুর ছবি যেন ক্যানভাসে আঁকা! অজান্তেই তিনি কখন আমার হয়ে গেছেন, আমি বুঝতেই পারিনি।কিন্তু অদ্ভুত এক ভালোলাগায় আপ্লুত হয়ে ছিলাম। তার পর বাড়ির আলমারিতে রাখা সাজানো রবীন্দ্র রচনাবলী টেনে নামিয়ে পড়তে শুরু করলাম-গোরা, নৌকাডুবি, স্ত্রীর পত্র…..।কিন্তু সত্যি বলছি, ওই বয়সে আমি সব বুঝতে পারিনি, তবে চেষ্টা করেছি। স্ত্রীর পত্রের মৃণাল কিন্তু আমায় মুগ্ধ করেছিল। ওই সময়ে, একজন গৃহবধূর ওই রকম প্রতিবাদ আমায় অবাক করেছিল। এখানে রবীন্দ্রনাথ আমার অন্তরাত্মার সঙ্গে এক হয়ে যান। হয়ে যান আমার রবীন্দ্রনাথ। কারণ, ছোটোবেলা থেকেই আমি একটু একরোখা, বেয়াড়া (অন্যদের চোখে)। তাই মৃণালের মধ্যে আমি যেন নিজেকেই দেখতে পাই। আর গোরা? সে শেষে যে ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি হয়, তা যেন নির্মম পরিহাস হলেও, অতি বাস্তব। বাস্তবে এই ধরনের ঘটনা ঘটতে আমি কিন্তু দেখেছি। তাতে বোঝা যায়, ওই সময়ে রবীন্দ্রনাথের দর্শন, মানবজীবন সম্পর্কে ধারণা কতটা স্পষ্ট ছিল।
বারবার মুগ্ধ হই, যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনি।“যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙ্গলো ঝড়ে”, যেন ভালবাসার ঝড় হয়ে এসেছিল, আমার জীবনে, আমি জানতেই পারিনি, অবহেলায় তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি। আবার, আমার একজনকে খুব ভাল লেগেছিল, অথচ, কোনোদিন তাকে বলা হয়ে ওঠেনি। আমার মনের গভীরে শুধু সুর বাজতে লাগলো-“তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম”। গানটা যেন রবীন্দ্রনাথ আমার অনুভূতির কথা ভেবেই লিখেছেন।তারপর, জীবনের কালস্রোতে যখন সে-সব কথা বিস্মৃতির অতলে, তখন যদি বেজে ওঠে কোথাও-“তুই ফেলে এসেছিস কারে মন,মনরে আমার…”, তখন আবার স্মৃতিগুলো জেগে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ যেন অলক্ষ্যে পুরানো ছবির অ্যালবামটা খুলে দেন।
দুদিন ধরে, আকাশে মেঘ করছে, বিকেলের দিকে ঝড় উঠছে, মাঝে মাঝে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামছে। আমার গোলাপী ফুলে ভরা করবী গাছটা বৃষ্টির জল পেয়ে ডালপালা নাড়িয়ে যেন নাচছে, আমি মুগ্ধ হয়ে জানালায় স্থির দাঁড়িয়ে দেখি, আকাশ-বাতাস যেন অস্ফুটে গাইছে-“বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি…..”।মার্চে (বসন্তে)আমার বাড়ির গেটের ওপরটা হলুদ অ্যালামুন্ডা আর বোগেনভিলিয়ায় ঢেকে থাকে। আমার মনে হয়, “বসন্তে আজ গাঁথল জয়ের মালা….”। সত্যিই ফুলগুলো যেন জয়ের মালা । না, ধন গৌরবের নয়, আমার মতো এক নির্গুন মানুষের জন্য নয়, আনন্দের। জীবনের সব দুঃখগুলো ছেঁকে নিয়ে আনন্দের গলায়, সমস্ত হারগুলোকে মুছিয়ে দিয়ে, ছোট্ট ছোট্ট জয়ের গলায় মালা পরায়।
আর হ্যাঁ, মার্চেই তো দোল আসে। করোনা? তাতেই বা কী? আমরা মাস্ক পরেই সপরিবারে পাড়ায় বাচ্চাদের সঙ্গে আবির নিয়ে খেললাম। অদৃশ্য, অশ্রুত অথচ প্রবল ভাবে সেখানে উপস্থিত রবীন্দ্রনাথ।“রাঙিয়ে দিয়ে যাও…..”। পাশের বাড়ির যারা ভয়ে বাড়ির বাইরে আসতে পারছিল না, তাদের ডেকে ডেকে বার করলাম (অবশ্যই মাস্ক সহ)। আমরা দল বেঁধে গাইতে লাগলাম-
“খোল দ্বার খোল, লাগলো যে দোল
স্থলে জলে বনতলে লাগলো যে দোল……..”।
আমার দাদা আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করেছে। সে অতিশয় শান্ত, ভদ্র মেয়ে, নাম জিন সেড। ইভানস্টোন-এ থাকে। জায়গাটা শিকাগো শহর সংলগ্ন।জিন মাঝে মাঝে কলকাতায় আসে। তো, একবার ওর শখ হয়েছে শাড়ি পরার। আমার দিদি ওকে নিয়ে শাড়ি কিনতে গেল। একটা উজ্জ্বল রানি কালারের শাড়ি জিনের পছন্দ হল। আমার গম্ভীর অধ্যাপক দাদার ওই রকম চড়া রঙের শাড়ি পছন্দ হল না। যাই হোক, ওই শাড়িটা যখন জিন পরলো, আমরা তার থেকে চোখ ফেরাতে পারি না। ফর্সা রঙে, ওই রঙের শাড়ি, যেন চারদিককে আলো করে রেখেছে! আমরা ভারতীয় বিশেষ করে বাঙালিরা এই রঙটা খুব পছন্দ করি। আমার মনে আবার সেই রবীন্দ্রনাথ!মনের ভিতর তিনি উঁকি ঝুঁকি্ দিলেন। মনে হল – “আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী, তুমি থাকো সিন্ধু পারে…..”।
যখন আমার খুব আনন্দ হয়, তখন গলা ছেড়ে গাই – “মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি…..”। যখন শুনি,কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়- “আনন্দধারা বহিছে ভুবনে”, তখন চোখ বন্ধ করে রাখি, মনে হয় আমার চারদিকে যেন আনন্দ রাগে ঝরনা বইছে।আমার মন সেই ঝরনায় অবগাহন করে। যখন তুমুল বৃষ্টি নামে, তখন বৃষ্টির সাথে গলা মিলিয়ে গাই-“আজি ঝরো ঝরো মুখর ভাদর দিনে”। যখন প্রেমে আচ্ছন্ন হই, তখন গুনগুন করে গাই-“আমি তোমার প্রেমে হবো সবার কলঙ্কভাগী”। যখন রাতের ট্রেন প্রচন্ড গতিতে ছুটে যায় গন্তব্যের দিকে, আর আমি হই যাত্রী, তখন মনের মধ্যে বেজে যায়, “দূরে কোথাও দূরে দূরে, আমার মন বেড়ায় যে ঘুরে ঘুরে”।
কিন্তু না, এই করোনা কালে সত্যি বলছি, গাইতে পারবো না, “মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান”। হে রবীন্দ্রনাথ, ক্ষমা করে দিও। আমার মনে, গানে, জাগরণে, অনুভূতিতে তুমি সদাই যেন আবহ সঙ্গীত হয়ে বেজে যাও, আমারই সত্তার অংশ হয়ে। তাই তুমি আমার কাছে বিশ্বকবি নও, একান্তই তুমি আমার, আমার রবীন্দ্রনাথ।আর, তাই তো হাজার দুঃখ-কষ্ট-অভিমান কাটিয়ে তুমি আবার আমাকে ফিরিয়ে নাও তোমারই কাছে,
“আমারে তুমি অশেষ করেছ
এমনি লীলা তব।
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ
জীবন নব নব।“
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।