• Uncategorized
  • 0

T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য

গীতবিতান

“মাসিমা কেমন আছেন ?”
বছর সত্তরের বৃদ্ধা , আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে একগাল হাসলেন “ওমা এ যে আমাদের জগু । কবে ফিরলে ?”
মাসিমার ফর্সা গালগুলো আগুনের তাপে লাল হয়ে গিয়েছে । একদিকে গরম তেলে বেগুনি , চপ ভাজছেন আর আমার সঙ্গে কথা বলছেন । অবশ্য শুধু আমি নয় দাঁড়িয়ে থাকা গ্রাহকদের সঙ্গেও কথা বলছেন । “ কি রে ভানু তোর মা কেমন আছে ? পাল বৌদি , ছেলে ফিরল ? মিনুদি একটু দাঁড়াও গো এইবার লঙ্কার চপটা ভাজব ।”সবাই ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে আছে ।
মাসিমার রান্না হাত চমৎকার ছিল । কলেজ জীবন আমার মাসিমার বাড়িতেই কেটেছে । একদম অজগন্ড গ্রাম থেকে শহরে পড়াশুনো করতে এসেছিলাম ।মাসিমার একতলার এক কামরার ঘরে ভাড়া থাকতাম ।আমার নাম শুনে বলেছিলেন “জ্যোতির্ময় !”ছোট কোন নাম নেই তোমার ?
আমি আমতা আমতা করে বলেছিলাম “ বাড়ির লোক আমায় জগু বলে ডাকে ।”
মাসিমা একগাল হেসে বলেছিলেন “বেশ বেশ এই নামটাই ভালো । আমিও তো তোমার মাসিমা । তোমায় জগু বলেই ডাকব।”
বহুদিন হয়েছে মাসিমা দুপুর বেলায় ছেঁচকি , ঘণ্ট , চুনো মাছ পাঠিয়ে দিতেন ।সঙ্গে উপরি পাওনা ছিল রবি ঠাকুরের গান । বৈশাখের তপ্ত দুপুরে , রান্নাঘর থেকে ভেসে আসত মাসিমার সুরেলা গলায় “ এসো হে বৈশাখ ।”মনে হত মাসিমা যেন গরমটাও উপভোগ করছেন ।শুনেছিলাম বিয়ের আগে নাকি রীতিমতো গানের চর্চা করতেন । পাড়ার অনুষ্ঠানে গান গাইতেন । বিয়ের পর সব বন্ধ । শ্বশুরবাড়িতে সঙ্গীত চর্চা কেউ পছন্দ করত না ।
সংসারে খুব যে বৈভব ছিল তা নয় । কিন্তু এমন আন্তরিকতার ছোঁয়া আমি কোথাও পাইনি । অনেক মাসে বাড়ি ভাড়ার টাকা দিতে দেরি হয়ে যেত । মাসিমা কোনোদিন তার জন্য বিদ্রুপ করেননি ।একেকদিন বিকেলে কলেজ থেকে ফেরার সময় শুনতে পেতাম জানলার ধারে বসে একমনে গাইছেন “ বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা / বিপদে আমি না যেন করি ভয় ।”
মাসিমার দুই ছেলে ছিল । বড় ছেলে তখন ডাক্তারি পড়ছে । ছোট ছেলে ইলেভেনে । একমাস বাড়ি ভাড়া দিতে পারিনি বলে দুই ছেলে মিলে খুব শাসিয়ে ছিল ।সন্ধ্যে বেলায় শুনেছিলাম দুই ছেলেকে খুব বকাবকি করছেন । পরে এসে ওরা ক্ষমা চেয়ে গিয়েছিল । মেসমশাই পাটনাতে এক প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করতেন । মাসে দুমাসে একবার করে আসতেন । পরে শুনেছিলাম মেসমশাই নাকি পাটনাতে দ্বিতীয় সংসার পেতেছেন । তারপর আর কোন সম্পর্ক ছিল না ।
মাসিমার সব চপ আজ শেষ । “কি রে জগু দাঁড়িয়ে কেন ঘরে আয় । তা প্রায় দশবছর পর এলি এদিকে ।” কলেজ পাশ করে স্কলারশিপের টাকায় পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট করতে দিল্লি চলে যাই । ওখানেই একটি কলেজে অধ্যাপনার কাজ পাই । আমার মোবাইল চুরি হয়ে যাওয়াতে সব ফোন নম্বর হারিয়ে যায় । এতদিন পর এই শহরে একটি সেমিনারে আমন্ত্রন পেয়ে এসেছি ।
মাসিমার ঘর ঠিক যেন আগের মতই আছে । বরং বলা চলে আগের থেকে অনেকবেশি মলিন হয়ে গিয়েছে । একেক যায়গায় প্লাস্টার খসে পরেছে । দরজা দিয়ে মাসিমার ঘরে ঢুকেই দেওয়ালে চোখ আটকে গেল । মাসিমার বড় ছেলের ছবিতে মালা পরানো ।
অবাক হয়ে তাকালাম । মাসিমা বিছানায় বসলেন “ তুমি যে বছর এখান থেকে গেলে সেই বছর বাইক অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল । আর এক বছর হলে ডাক্তারি পাশ করত । তোমাকে ফোন করে ছিলাম । পাইনি ।
একজন অল্প বয়সী মহিলা প্লেটে জল মিষ্টি নিয়ে এলো । মাসিমা আমার গায়ে হাত দিয়ে বললেন “ বউমা, এই আমাদের জগু, বলেছিলাম না তোমায় ।খুব ভালো ছিল পড়াশুনোতে ।
মহিলাটি স্মিত হেসে চলে গেল । দেখলে বোঝা যায় সন্তান সম্ভবা । “ মাসিমা আপনি এই বয়সে এভাবে কাজ করছেন ?”
জগু তুমি বলতে না আমার রান্না খুব ভালো । তাই ভাবলাম ঘরে বসে থেকে কি হবে ? যদি দুটো পয়সা আসে । ছোট ছেলেটা ভালো চাকরী করত । কিন্তু হঠাৎ ছাঁটাই হয়ে যায় । নতুন চাকরি খুঁজছে কিন্তু এই মন্দার বাজারে কে দেবে চাকরি ? আর বউটাও নমাসের পোয়াতি । যে কোনোদিন … বলে থামলেন ।
“জগু তুমি বিয়ে করেছ ? কোথায় থাকো এখন ? চাকরি করো ? কিছুই তো জানি না ।”
“না আমি বিয়ে করিনি । দিল্লিতে থাকি । কলেজে পড়াই ।”
মাসিমা মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন “ ওমা আমাদের জগু এত বড় মানুষ হয়ে গেছে ! তাও দেখো মাসিমাকে ভোলেনি ।”
“মাসিমাকে কি করে ভুলব ? আমার যে আরও আগেই আসা উচিত ছিল ।” জড়িয়ে ধরলাম মাসিমাকে । মায়ের গায়ের গন্ধ পেলাম অনেকদিন পর ।মাসিমা পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন “ জগু তুমি আজ দুটো ডাল ভাত খেয়ে যেও ।”
আমি না করতে পারলাম না । মাসিমার হাতের অমৃত রান্নার কথা মনে পড়ল । “ মাসিমা আজ একটা আবদার করব !”
মাসিমা অবাক হয়ে বললেন “আমার কি তেমন কিছু আছে দেওয়ার মতো !”
“ মাসিমা আপনার গলায় একটা গান শুনব।”
মাসিমার চোখে মুখে খুশি ফুটে উঠেছে “ বহুযুগ এমন আবদার কেউ করেনি । জগু তুমি সত্যি শুনতে চাও !”
বাক্স থেকে একটি পুরনো প্লাস্টিকের প্যাকেট বার করলেন । “ বাক্সে ঢুকিয়ে রেখে দিয়েছিলাম । এরা কেউ এর কদর বোঝেনি । শোকে দুঃখে বিপদে আমায় সাহস জুগিয়েছে এই একজন মানুষ । ওনার লেখা কথাগুলো জীবনের প্রতি পরিস্থিতিতে এত মিলে যায় কি করে বলো তো !
মাসিমার কোলের উপর মলিন একটি ‘গীতবিতান’।মাসিমার চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে গীতবিতানের প্রথম পাতা । প্রথম পাতায় রবি ঠাকুরের ছবি । চোখের জল মুছে মাসিমা বললেন “ ইস ছবিটা ভিজে গেল । মুখে হাসি আনবার চেষ্টা করে বললেন “ আমার বিয়ের আগে কিনেছিলাম । তখন কত দাম ছিল যেন ! দুটাকা । বিয়ের পর বইটা নিয়ে এসেছিলাম । আমার হারমোনিয়ামটাও চেয়েছিলাম , বাবা দেয়নি । বিয়ের পর নাকি বাপের বাড়ির কোন জিনিসের উপর মেয়েদের অধিকার থাকে না ।”মাসিমা হঠাৎ জোরে হেসে উঠলেন “ আমি গীতবিতানটা একপ্রকার ঝগড়া করেই নিয়ে এসেছিলাম ।এটা ছাড়া মনেহয় এত বড় জীবনটা কাটাতে পারতাম না ।”
আকাশে আজ পূর্ণিমার চাঁদ । চারিদিকে অদ্ভুত জ্যোৎস্না । কত যুগ পর আজ মাসিমার বাড়ির ছাদে উঠলাম । সামনের স্ট্রীট লাইটের আলো ছাদের এক কোনায় পরেছে ।সেখানে মাসিমা চুপ করে বসে । সামনে গীতবিতান খোলা ।মাসিমা একমনে গাইছেন “ আরো আরো, প্রভু, আরো আরো / এমনি ক’রে আমায় মারো ।”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।