T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় সুধাংশু চক্রবর্তী
by
·
Published
· Updated
খেলা হবে, খেলা হবে
আমি ও রবীন্দ্রনাথ’ ! কঠিন বিষয় । কিভাবে শুরু করবো ভাবছি যখন, সহসা ঘরের বাইরের তিন দিক গ্রিলে ঘেরা বারান্দা থেকে ভেসে এলো একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস । শুনে চমকে উঠলাম । বাড়িতে এখন আমি একলাই রয়েছি । তা’হলে কার ওই দীর্ঘনিঃশ্বাস !
এর পরই দূর থেকে বাতাসে ভেসে এলো মাইকে বেজে ওঠা গানের কলি, ‘খেলা হবে খেলা হবে…’। এবং তখনই কে যেন গম্ভীর গলায় বলে উঠলো, দম্ভের জালের আড়ালে বাস করে, প্রাণ শুষে নেওয়ার দল ।
চমকে উঠলাম । কে বললো ? কেন বললো ? পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখি দে্য়ালে ঝোলানো ছবি থেকে কখন বের হয়ে এসে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন গ্রিলে ঘেরা বারান্দায় । মুখে লেগে আছে বিষণ্ণতার কালো ছাপ । মনে হলো চোখের কোলেও যেন জল চিক্ চিক্ করছে ! দ্রুত উঠে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে অবাক হয়ে বললাম, গুরুদেব আপনি ! নাকি আমারই দেখার ভুল !
আমার চোখে চোখ রেখে তিনি উদাস গলায় বললেন, একদম ভালো লাগছিলো না ফ্রেমবন্দী হয়ে থাকতে । শুনতে পাচ্ছো ওই গান ? ওই গানই আমাকে বাধ্য করলো ফ্রেমছাড়া হতে । হে ঈশ্বর, একদা সমগ্র দেশে মনুষ্য জীবনই ছিলো মানবিকতায় পরিপূর্ণ । অথচ আজকের এই শহুরে জীবন হয়ে উঠেছে যেন দশ-পঁচিশের ছক । বুকের ওপর দিয়ে চলছে জুয়োখেলা ।
শুধু এই দেশেই বলি কেন ? গোটা পৃথিবীটাই যে এই একই পরিস্থত্তির শিকার হয়েছে । দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধের পরেও, এখনও পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ অমানবিক পরিবেশ, অসাম্যের গায়ের গাজোয়ারিতে প্রতিদিন অতিষ্ঠ । ঠাণ্ডা যুদ্ধ, মারণ যুদ্ধ চলছে রোজ ।
উৎকণ্ঠার ছাপ ফুটে উঠেছে তাঁর চোখে মুখে । নিদারুণ ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, আজকাল এই দেখে দুঃখ পাই যে, বড় দল ছোট দলকে পিষে ফেলে, বড়ো টাকা ছোটো টাকাকে উপবাসে ক্ষীণ করে দিয়ে একসময়ে তাকে গ্রাস করে ফেলছে । অথচ এতো কিছুর পরেও ধনী গরিব নির্বিশেষে সকলেই কেমন গলায় গলা মিলিয়ে এক সুরে গেয়ে চলেছে, ‘খেলা হবে, খেলা হবে… !’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি আরও বললেন, প্রাচীন কাল থেকে আমাদের দেশে পরের উপর নির্ভর করার ব্যবস্থা চলে আসছে । পরিবর্তে দাতা পেয়েছেন বাবু বা মশায়-এর সম্মান । এর চেয়ে বড়ো খেতাব তখন বাদশা বা নবাবরাও দিতে পারতো না । সংবাপত্রে তাদের স্তবগান বেরোতো । অথচ দ্যাখো, ইউরোপে কর্তব্যসম্পাদনেই ছিলো দাতার সম্মান । এখানকার মতো খেতাব দেবার প্রথাও ছিলো না সেখানে, আবার সংবাদপত্রেও বেরোতো না তাদের স্তবগান ।
দুঃখ লাগে এই দেখে যে, আজকাল ধনবল এবং জনবলের দৌলতে অনেকেই ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে নিজের স্তবগান গাইয়ে ছাড়ছে অন্যদের দিয়ে । একবারও ভেবে দেখে না, দেশের গরিব মানুষগুলো যাপন করছে নির্মম নিরানন্দ জীবন । ওদের জীবনে নেই কোনো সুখ, নেই কোনো আনন্দ । ওরা হঠাৎ কোনো বিপদে বা রোগের কবলে পড়লে রক্ষা পায় না ।
আর চুপ করে থাকতে না পেরে বললাম, আজকাল সকলেই কিন্তু যথাসাধ্য পরিষেবা পাচ্ছে গুরুদেব । সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিষেবার ঢালাও ব্যবস্থা রয়েছে দেশের প্রতিটি শহরে । অতএব বিপদ বা রোগের কবল থেকে রক্ষা পাবে না সেকথা ভাবার কোনো অবকাশই নেই ।
শুনে রবীন্দ্রনাথ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে । ইস্পাত কঠিন গলায় জবাবে বললেন, ভুলে গেলে কি বলেছিলাম তখন ? যা যা বলেছি, অস্বীকার করতে পারবে তুমি ?
আমতা আমতা করে বললাম, না, তা নয় গুরুদেব । তবে কিনা…
আমাকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, আমি আবারও বলছি তোমাকে । আজকের সমাজেও বড় দল ছোট দলকে পিষে ফেলে, বড়ো টাকা ছোটো টাকাকে উপবাসে ক্ষীণ করে দিয়ে একসময়ে তাকে গ্রাস করে ফেলছে । অথচ শোষিতরা কিনা সব ভুলে গলায় গলা মিলিয়ে একসঙ্গে গেয়ে চলেছে, খেলা হবে, খেলা হবে !
কুণ্ঠিত গলায় বললাম, আসলে এই গান গেয়ে সকলেই উদ্বুদ্ধ হচ্ছে গুরুদেব । আজ আমাদের প্রতি দিনই খেলতে হচ্ছে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদে । তাই ‘খেলা হবে, খেলা হবে’ গাইতে গাইতে আমরা লড়ছি আর্থিক প্রতিকূলতার বিরুধে, অতিমারির বিরুধে । এতে আমি অন্তত কোনো অন্যায় দেখছি না গুরুদেব ।
রবীন্দ্রনাথ উদাস হয়ে কিছুক্ষণ নীরব থেকে একসময় প্রায় মন্ত্রোচ্চারণের মত করে বললেন, আজকের কচিকাঁচারা মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ শিক্ষা হতে বঞ্চিত, সুষম খাদ্য হতে বঞ্চিত, অনেকেই পানীয় জল থেকে… এসবের প্রতিকারে কোনো উপায় কি নেই ? যেখানে এতো দুঃখ, এতো দৈন্য, এতো হাহাকার ও শিক্ষার অভাব সেখানে কেমন করে নির্মান হবে রাষ্ট্রীয় সৌধ !
ক্ষীণ গলায় প্রতিবাদের সুরে বললাম, সবই তো হচ্ছে গুরুদেব । তবে কিনা ধীরে ধীরে হচ্ছে । এসবই যে সময়সাপেক্ষা ব্যাপার গুরুদেব ।
– স্বাধীনতা লাভের পর তিয়াত্তর বছর অতিক্রান্ত হলো । আর কত সময় চাও তোমরা ? অথচ আমার যা-কিছু সামান্য সম্বল ছিলো তাই নিয়ে দুম্ করে কাজে নেমে পড়েছিলাম । তখন একবারও ভাবিনি, কত বড়ো দুর্গম পথে আমি অগ্রসর হয়েছি ।
ঈশ্বর যখন কাউকে কোনো কাজের ভার দেন তখন তাকে ছলনাই করেন, বুঝতে দেন না যে পরে কোথায় কোন্ পথে তাকে এগিয়ে যেতে হবে । আমার ভাগ্যদেবতাও আমাকে ভুলিয়ে নিয়ে ক্রমশ এমনভাবে আমাকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন, এমন দুর্গম পথে আমাকে টেনে নিয়ে গেছিলেন যে, আর সেখান থেকে… ।
সহসা রবীন্দ্রনাথের গলা ছাপিয়ে প্রায় কানের কাছেই মাইকে বেজে উঠলো সেই গান, ‘খেলা হবে, খেলা হবে…।’ অথচ নিরুত্তাপ গুরুদেব আপন মনে বলেই চলেছেন নিজের বক্তব্য । কাটা কাটা গুটিকতক শব্দ শুনে বোকার মত বলতে গেলাম, আমরা আজ…
রবীন্দ্রনাথ আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি বলতে চাইছো, আর্থিক দুর্গতির দিকে রাষ্ট্র দৃষ্টিপাত করেছেন । যদি মেনেও নিই তোমার কথা, তবু বলতে বাধা নেই, আজ এত দুঃখের কারণ জেনেও তোমরা সবাই চুপ করে আছো । চুপ করে থাকা ছাড়া আর কি করতে পারো ?
যে-সামাজিক পাপের ঊপর জনগণের সকল শত্রুর আশ্রয় তাকে উৎপাটন করতে তোমাদের বাজে, কেননা তার উপরে তোমাদের মমত্ব । ওই প্রশ্রয়প্রাপ্ত পাপের বিরুদ্ধে আজ তোমাদের চরম যুদ্ধ ঘোষণা করা উচিৎ ।
আমাদের কালে ওই কাজ করে দেখিয়েছিলেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী । পারো তো ভালোবাসা দিয়ে জয় করে নাও আজকের অত্যাচারিত জনগণের মন, দূর করে দাও ওদের যাবতীয় দুঃখ-শোক ।
রবীন্দ্রনাথ নীরব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন দূর আকাশের দিকে । একটা একটা করে তারা ফুটে উঠছে আকাশে । ধীরে ধীরে রাত ঘনিয়ে আসছে দেখে নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বললেন, রাত ঘনিয়ে এলো । জানিনা আর কতকাল অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকবে আজকের জনজীবন । পারো তো দূর করো এই অন্ধকার । নইলে নিজেদের মানুষ বলতেও একদিন দ্বিধা করবে তোমরা ।
– কিভাবে দূর করবো গুরুদেব ?
রবীন্দ্রনাথ ব্যথাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রায় ভেজা গলায় বললেন, শুধুমাত্র ভালোবাসা দিয়ে । অপরকে ভালোবাসতে শেখো, অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতে শেখো । তাতেই সবার মঙ্গল হবে । আরও অনেক কিছু করতে হবে তোমাদের । অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও…
দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে তন্ময় হয়ে শুনছিলাম তাঁর কথা । সহসা তিনি নীরব হতে সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকিয়ে দেখি, তিনি আবার ফিরে গেছেন ফ্রেমের ভিতর । একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম । ছবির ভিতরকার রবীন্দ্রনাথের সেই আগেকার স্নেহের দৃষ্টি কে যেন মুছে দিয়েছে ওই ঋষি সুলভ মুখ থেকে । তিনি করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কিছু একটা যেন বলছেন আমাকে অথচ আমি শুনতে পাচ্ছি না ।