শ্রীচরণেষু গুরুদেব,
শুরুতেই জানিয়ে রাখি, আপনাকে খুশি করার জন্য কোন কথা আমি বলতে পারব না। সরাসরি বলি, আপনাকে আমি কোন দিনই পছন্দ করতাম না। একেবারে ছোটবেলায় পাঠ্য বইতে ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে’ অথবা ‘আমাদের ছোট নদী’ মুখস্থ করেছি ঠিকই, স্কুলের অনুষ্ঠানে আবৃত্তিও করেছি, কিন্তু আমার শিশুমনে ওসব কোন দাগ কাটেনি, তাই ভালবাসাও হয়ে ওঠেনি। বাড়িতে আপনার একটা ছবি ছিল, যেমন থাকে সব বাঙালি বাড়িতে। আপনার জন্মদিন এলেই সেটাকে ঝেড়ে মুছে মালা, চন্দনে সাজানো হত। আমিও বায়না করে দু চারটে চন্দনের ফোঁটা আঁকতাম। নিজেকে বেশ বড় বড় মনে হত ওটুকু করতে পেরে। তার বেশি কিছু নয়।
একটু বড় হয়ে পাড়ার ক্লাবে রবীন্দ্রজয়ন্তীর উৎসবে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেলাম। আমরা বলতাম ফাংশন। পাড়ার পিসি, দিদিদের তত্ত্বাবধানে চলত রিহার্সাল। পড়া ফাঁকি দেওয়ার মহা সুযোগ পাওয়া যেত। রিহার্সালে যা শিখে এলাম বাড়ি ফিরে প্র্যাকটিস না করলে চলে? তাই ওই ক’টা হপ্তা রাতদিন বোতাম টেপা টেপ রেকর্ডারে ক্যাসেট চাপিয়ে আপনার গান বাজাতাম। আসলে কিন্তু সবই পড়া ফাঁকি দেওয়ার ছল। সেই ছল করতে করতেই মুখস্থ হয়ে গেল ‘ধানের শীষে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির খেলা’ থেকে ‘আমরা নতুন যৌবনেরই দূত’ অথবা ‘জল দাও, আমায় জল দাও’। কখনও বা নিজের মনে গেয়ে উঠেছি, ‘ওকে ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, ছিঃ / ও যে চণ্ডালিনীর ঝি‘
আপনি বুঝি তখন ভেবেছিলেন সে’সব আপনাকে ভালোবেসে? এমন বোকা আপনি? তখন গিটার নিয়ে স্পটলাইটের নীচে বসে রাহুল রয় গাইছেন ‘বস এক সনম চাহিয়ে, জিন্দেগীকে লিয়ে’, ওই ছেড়ে কেন শুনব বলুন তো আপনার ‘ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে’? কীসের সঙ্গে কী! ওই বয়সে এসব পোষায়, আপনিই বলুন? কিন্তু ওই যে, আপনার নামে কয়েকটা দিন লেখাপড়াতেও ফাঁকি দেওয়া যায়। মাফ হয়ে যায় সাত খুন!
হ্যাঁ, তো যা বলছিলাম। এসব করতে করতেই, বুঝলেন, হৈহৈ করে এসে পড়লেন সুমন। এসে গেল ‘তোমাকে চাই’ আর ‘পেটকাটি চাঁদিয়াল’। পাগল হলাম। উন্মাদ হলাম। গায়ে গায়ে এসে পড়লেন নচিকেতা, শিলাজিত, তারপর একের পর এক ব্যান্ড। তাদের শুনছি আর পাশাপাশি শুনে চলেছি পিঙ্ক ফ্লয়েড, ডিপ পার্পল, ব্যাকস্ট্রিট বয়েজ, বয় জোন। সমান তালে চলেছে হার্ড রক, মেটাল, হিপহপ থেকে ব্লুজ, জ্যাজ, পপ। চন্দ্রবিন্দু থেকে সহজ মা। মাটির গানের টান বড় প্রবল। শুনছি বাউল, ঝুমুর, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়ার পাশাপাশি রাজস্থানি মান্দ, বিহার ইউপি-র কাজরী। সঙ্গে আছে পঞ্জাবের মাটির গন্ধ মাখা গান। সুরে ডুবেছি, সুরেই ভেসেছি। কেঁদেছি হেসেছি। সেই মুভির ডায়ালগের মত, ‘ফ্রম স্যান্টানা টু সুফিয়ানা’ — বাদ পড়েনি কিচ্ছু। শুধু আপনার কথা কানে এলেই ছিটকে সরে গেছি অন্য কোথাও। বাদ পড়েছেন কেবল আপনি।
এমন সময় একদিন হঠাৎ করেই আমার হাতে এসে গেল আপনার যাবতীয় সৃষ্টির পুরো একটা সেট। নাটক, গল্প, উপন্যাস, কবিতা – সব মিলিয়ে সে তো এক বিরাট ব্যাপার! পড়লাম। অস্বীকার করব না, হেমনলিনী, বিনোদিনী, লাবণ্য, বিমলা অথবা অমিত, মহেশ, মহেন্দ্র, নিখিলেশ — নারী পুরুষ নির্বিশেষে আপনার সৃষ্ট চরিত্ররা আমাকে ভাবিয়েছে। তবু তারপরেও আপনাকে দিন যাপনে বুনে নিতে পারলাম না। এভাবে ভালোবাসা হয়, বলুন?
অতঃপর, সময় গড়িয়েছে সময়ের মত। আপনাকে ভাললেগেছে, ভালোবাসা হয়ে ওঠেনি।
তারপর এই তো সেদিন, গত বছরের কথা, আপনার জন্মদিনটি কেটেছিল ভরা লকডাউনে। সঙ্গী ছিল অতিমারীর আতঙ্ক। হাওয়ায় ভাসছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার কথা। একদিকে বিশাখাপত্তনমের কাছে বিষাক্ত গ্যাসে এগারো জনের মৃত্যুর খবর আসে। জানা যায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পথে লুটিয়ে পড়েন হাজারেরও বেশি মানুষ। অন্যদিকে খবর আসে রেলের চাকায় পিষে গিয়েছে ষোল জন পরিযায়ী শ্রমিক। লকডাউনে হেঁটে নিজের গাঁয়ে ফেরার পথে রেলের লাইনে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। ছবিতে দেখি রেলের লাইনে ছড়িয়ে থাকা রক্তমাখা রুটির টুকরো। সেই উথালপাথাল সময়ের মাঝেই, গুরুদেব, এসে গিয়েছিল আপনার জন্মদিন। বাইরে বেরোনোর হুকুম ছিল না বলে অনেকেই ঘরে বসে পালন করেছিলেন দিনটি। গানে, কবিতায়, ললিতকলায় শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন তাঁরা আপনাকে। ছবি আর ভিডিওতে ভরে উঠেছিল সোশ্যাল মিডিয়া।
আমি কিছুই করতে পারিনি, জানেন? ইচ্ছেও হয়নি। আসলে আমার রাগ হচ্ছিল। ওই মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে না পারার অক্ষমতায় নিজের ওপরেই রাগ হয়েছিল আমার। রাগ হয়েছিল আপনার ওপরেও। এত ফুল পাখি চাঁদ কোথা থেকে আসে? খিদে চোখে পড়েনা? রোগ, মৃত্যু, রক্ত দেখতে পান না? কেন?
কিছু মানুষ বললেন এমন দুঃসময়ে, আতঙ্কের কথা না বলাই উচিত। যা কিছু কষ্ট দেয়, সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বরং নিজে আনন্দে থাকা আর সকলকে আনন্দে রাখা জরুরী — সে যেখানে যাই ঘটুক না কেন। আমি তাঁদের যুক্তি বোঝার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। চোখের সামনে থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারলাম না রেল লাইনে পড়ে থাকা রক্তমাখা রুটির টুকরোর ছবি। আমি পারলাম না সকলকে আনন্দ দিতে, নিজে আনন্দে থাকতে। হয়তো আমারই ভুল। আমিই সৃষ্টিছাড়া।
আপনার জন্মদিন চলে গেল। অতিমারীর রয়ে গেল। নিজের মর্জি মত কমল, আবারও বাড়ল। মাঝখানে ঝড়ের তাণ্ডবে তছনছ হল সব। মরল মানুষ। এই সবের মাঝে জীবন তাঁর আশ্চর্য রূপ দেখাল, যেমন রূপ আর কখনও দেখায়নি সে। যেমন রূপে তাকে কল্পনা করিনি কখনও। একে একে খসে পড়ল স্বজন, বান্ধবদের মুখোশ। স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানী মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে চেনা বন্ধুর মুখোশ খুঁজতে খুঁজতে অবসাদের অতলে ডুবতে থাকলাম। ধরে রাখার চেষ্টা করতে করতেই কখন যেন সব হারিয়ে পৌঁছে গেলাম খাদের কিনারায়, একটি পা বাড়িয়ে দিলাম অতল শুন্যতায়। আরেকটি পা তুলে নেওয়ার মুহূর্তেই ঘটে সেই অঘটন। কে যেন আমার কানে কানে বলে গেল
‘শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।‘
থমকে দাঁড়ালাম। এ যে আমারই কান্নার ভাষা! আপনি জানলেন কেমন করে? বলুন? আপনি উত্তর দিলেন না। কেবল নিজের মনে বলে চললেন,
‘ওগো তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে!
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে!’
চুপ করুন গুরুদেব, দোহাই! আমার গভীরে গোপনতম যে আকুতি, এভাবে তাকে শব্দে আঁকতে কে বলেছে আপনাকে? একা ছেড়ে দিন আমায়। আপনি কিন্তু চুপ করলেন না। আজীবন আপনাকে দূরে সরিয়েছি, ঝেড়ে ফেলেছি। আপনিও সরে গেছেন নীরবে। এখন কেন এমন আঁকড়ে ধরলেন বলুন তো? আপনারই জন্য আমার আর পা তুলে নেওয়া হল না, জানেন? অবসন্ন শরীর, ক্লান্ত মন নিয়ে বসে পড়লাম ওখানেই, ওই খাদের কিনারে। অনবরত আমার কানে এসে আছড়ে পড়তে লাগল আমারই না বলা সকল কথা, অনুচ্চারিত সকল বেদনা।
‘সে চলে গেল, বলে গেল না’… আমি নিজেরই কথা শুনলাম। শুনেই গেলাম। কত দিন… কত যুগ…
খাদের কিনারা থেকে ফেরা এতই সহজ নাকি? পথ নেই। পথ হয়না। এ পথ যে একমুখী!
‘আমি তোমারই বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিব বাস,
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী…’
এমনও হয়? গুরুদেব, এভাবেও ফেরা যায়? স্বপ্ন নয়, কল্পনা বিলাশ নয়, বাস্তবেও এমন হয়? অবশেষে ছুঁয়ে দিলেন আপনি আমাকে। এতদিনে ভালোবাসা…
আচ্ছা গুরুদেব, আপনাকে বুঝতে গেলে বুঝি অনেক জন্ম পার করে আসতে হয়? খাদের কিনারে না পৌঁছলে বুঝি চেনা যায় না আপনাকে? বড় দেরী করে ফেললাম কি? তেমন করে ভালবাসার সময় পাব কি আর? আরও আগে কেন এভাবে এলেন না গুরুদেব? আপনি কে? আপনি কি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা? আপনি কি অন্তর্যামী? আপনি কি সেই সর্বজ্ঞ ঈশ্বর? কেমন করে জানলেন আমার গোপনতম অনুভূতি?
আশা ছিল এ’বছর সময়টা অন্যরকম হবে। অতিমারী বিদায় নেবে, জীবন কিছুটা হলেও স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পাবে। এবার ভালোবেসে আনন্দে গানে পালন করব আপনার জন্মজয়ন্তী। কিন্তু এবার যে আতঙ্ক আরও গভীর হল! আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ফিরল অতিমারী! এক মুঠো প্রাণবায়ু, এক বিন্দু রক্তের জন্য ছটফট করতে করতে পোকামাকড়ের মত মরে যাচ্ছে মানুষ। আবারও মৃত্যু, গুরুদেব… আবারও। শুধুই কি অতিমারী? না, গুরুদেব। মানুষ ভাতেও মরছে। অভাবের তাড়নায় তিলে তিলে মরছে। লকডাউনে সর্বস্বান্ত হয়ে মরছে।
একি! আপনার চোখে জল, গুরুদেব? আরও একটু বাকি আছে যে! কিছুটা চোখের জল বাঁচিয়ে রাখুন তাঁদের জন্য যাঁদের ঘর ভেঙে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বাড়ির মেয়েদের টেনে রাস্তায় নামিয়ে যথেচ্ছ অত্যাচার চালান হচ্ছে। শিশু বা কিশোর, রেহাই পাচ্ছে না কেউ। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনছেন গুরুদেব, আপনার বাংলায় আজ মানুষ মানুষকে মারছে। ক্ষমতার লোভেই হোক অথবা দম্ভে, আজ বাংলার কিছু মানুষ হত্যার উল্লাসে মেতেছে। এখন আপনিই বলুন, এমন সময় কী দিয়ে আপনার পুজোর অর্ঘ্য সাজাই?
কবিগুরু, আপনাকে আমরা গুরুদেব বলি। গুরুই তো পথ দেখান। এই অন্ধকার সময়, আজ যদি আপনি থাকতেন আমাদের মাঝে, কীভাবে মানুষকে মনুষ্যত্ব চেনাতেন গুরুদেব? কীভাবে তাঁদের মানবতায় ফেরাতেন? আজ বড় জানতে ইচ্ছে করে, এমন সময়ে আপনি কী বলতেন?