এতো সুদর্শন কোনো পুরুষকে এর আগে কখনও এভাবে চোখের সামনে দেখেছে বলে মনে পড়ে না ত্রিবেণীর। প্রথম দর্শনেই নারীমনের মনিকোঠায় স্থান করে নেওয়ার মতো চেহারা। বলিষ্ঠ শরীর, তামাটে রঙের কোঁকড়ানো চুল, কাঠবাদাম রঙের চোখ, টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁট, আর দু’তিন দিনের না কামানো দাড়ি যা পুরুষালী গালের সৌন্দর্য্য আরও কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছে। স্থান, কাল ভুলে দরজার বাইরে দাঁড়ানো মানুষটাকে বিভোর হয়ে দেখতে থাকে ত্রিবেণী।
“গুড মর্নিং”, কচি গলার অভিবাদনে এবার টনক নড়লো ত্রিবেণীর। সুপুরুষ একা নয়, সাথে একটি বছর পাঁচেকের মেয়েও রয়েছে।
“গুড মর্নিং। আই অ্যাম সেবেস্টিয়ান উইলসন।” ত্রিবেণী কিছু বলার আগেই নিজের পরিচয় দিলেন মধ্য ত্রিশের সুদর্শন ভদ্রলোক। তারপর সাবলীল ইংরেজিতে যা বললেন তার মানে দাঁড়ায়, ভদ্রলোক দেবাঙ্গীর কলিগ। কিছুক্ষন আগে দেবাঙ্গীর ফোন পেয়ে মিসেস রিন্দানীর অবস্থা সম্পর্কে অবগত হয়েছেন। এবং তৎক্ষনাৎ ছুটে এসেছেন দেবাঙ্গীর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে।
দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো ত্রিবেণী। বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো সেবেস্টিয়ান উইলসন। কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে দেবাঙ্গী ড্রয়িংরুমে চলে এসেছে। দেবাঙ্গীকে দেখতে পেয়ে সেবেস্টিয়ান দ্রুতপায়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল, শক্ত করে ধরে ফেলল ওর হাতদুটো। চোখ থেকে নেমে আসা কান্নার বিন্দুগুলো দেবাঙ্গীর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। নরম হাতে দেবাঙ্গীর চোখের জল মুছে দিল সেবেস্টিয়ান।
“হাই, আই অ্যাম অ্যাডেলিনা উইলসন, ইউ ক্যান কল মি পামকিন।”, এবার নিজের পরিচয় দিল বাচ্চা মেয়েটা। সেবেস্টিয়ানের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে এবার পামকিন-কে ভালো করে দেখলো ত্রিবেণী। সেবেস্টিয়ানের মতোই তামাটে রঙের কোঁকড়ানো চুল মেয়েটার, কাঠবাদাম রঙের চোখের মনি। এ সেবেস্টিয়ানের মেয়ে না হয়ে যায় না। কিন্তু এর মা কোথায় ? মড়া বাড়ি তাই আসেনি ? তাহলে এই বাচ্চা মেয়েটাকে এখানে পাঠালো কেন ? তাহলে কি সেবেস্টিয়ানের স্ত্রী অসুস্থ ? মিসেস রিন্দানীর মতোই শয্যাশায়ী ? না কি… ? সেবেস্টিয়ান ডির্ভোর্সী ???
ত্রিবেণী আর কিছু ভাবার আগেই আবার কলিং বেল বেজে উঠল। দেবাঙ্গীর কাছ থেকে একটু দূরে সরে গেল সেবেস্টিয়ান। ত্রিবেণী এগিয়ে গেল দরজার দিকে। বাসু সাকলানি সস্ত্রীক দাঁড়িয়ে আছেন দরজার বাইরে। এবার ত্রিবেণীর মুক্তি। মিসেস সাকলানিকে গত রাতের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে দেবাঙ্গীর কাছে বিদায় চাইলো ত্রিবেণী। চোখ ভরা জল নিয়ে মাথা নেড়ে সন্মতি জানালো দেবাঙ্গী। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো ত্রিবেণী। বদ্ধ করিডরে কোনো হাওয়া-বাতাস নেই, তবুও মনটা বেশ ফুরফুরে লাগলো ওর। লিফট ব্যাবহার না করে ও সিঁড়ি দিয়েই নেমে এলো নীচে। বাউন্ডারি ওয়ালের পাশে থাকা বড় বড় নিম আর দেবদারু গাছ স্নিগ্ধ, বিশুদ্ধ বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছে রাজগৃহ হাউসিং সোসাইটির কম্পাউন্ডে। ত্রিবেণীর সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। ও ভেবেছিল ঘরে ফিরে কিছুক্ষন ঘুমিয়ে নেবে, কিন্তু সেবেস্টিয়ানকে দেখার পর থেকে ওর সেই ইচ্ছাটা চলে গিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে ঘরে ফিরেই এক কাপ কড়া করে কফি বানাবে। ঘুম কাটাতে কফি অব্যর্থ। তারপর ভালো করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে, লক্ষনৌ চিকনের কাজ করা দুধ সাদা সালোয়ার-কামিজটা পরে আবার ফিরে আসবে দেবাঙ্গীর কাছে। এবার ভালো করে আলাপ করবে সেবেস্টিয়ানের সাথে। রাত জাগার ক্লান্তিতে পা দুটো ভারি হয়ে গেলেও মনটা এখন বেশ হালকা লাগছে ত্রিবেণীর।
দিবাস্বপ্নে ভাসতে ভাসতে ‘ডি’-বিল্ডিং-এর দিকে ধীরপায়ে এগিয়ে চলল ত্রিবেণী।
________
খবরের কাগজে প্যানডেমিক আর লকডাউনের খবর ছাড়া আর নতুন কোনো খবর নেই। তবুও রোজকার মতোই নিয়ম করে সংবাদপত্রের প্রথম থেকে শেষ পাতার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিল আদিত্য শিন্ডের চোখ। আর চোখ যতই এগোচ্ছিল ততই মনটা একটু একটু করে ভরে উঠছিল আতঙ্কে; আদিত্য শিন্ডের ডায়াবেটিস আছে তার ওপর হার্টের অবস্থাও তেমন ভালো নয় সোজা কথায় কো- মরবিডিটির জন্য একবার করোনায় ধরলে আর রক্ষে নেই, একেবারে প্রাণ নিয়ে তবেই ছাড়বে। ওর যদি এখন কিছু হয়ে যায় তাহলে সুরভি আর নিকান্তির কি হবে ? কিশোরী নিকান্তির সাথে একেবারে জলে পড়ে যাবে ভোলেভালা সুরভি। স্ত্রী আর কন্যার কথা ভেবে আদিত্য শিন্ডের আতঙ্ক আরও বেশ খানিকটা বেড়ে গেল, বুকের ভেতরটা কেমন ধড়ফড় করতে শুরু করলো, মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে। খবরের কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো শিন্ডে সাহেব। মধ্য সকালের ঝলমলে রোদে ঝকঝক করছে চারপাশ, নিমগাছে এসেছে কচি সবুজ পাতা, চেনাজানা পাখিদের সাথে দু-একটা নাম না জানা পাখিও নেচে বেড়াচ্ছে গাছের ডালে ডালে; এই প্রকৃতিকে দেখে কে বলবে ওদের চারপাশে এতো ভাইরাসের ভিড়, এতো রুগ্ন মানুষ, এতো মৃত্যু… রবিবারের ক্রোড়পত্রটাকে আলাদা করে রেখে খবরের কাগজের বাকি পাতাগুলো সুন্দর করে ভাঁজ করে পুরোনো কাগজ রাখার জায়গায় রেখে দিলো আদিত্য, এই সব মন খারাপ করা খবর আর না পড়লেও চলবে, তার চেয়ে বরং কিছুক্ষন বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকা ভালো। খবরের কাগজটাকে পড়ার আগেই সারফেস স্যানিটাইজার দিয়ে স্যানিটাইজ করেছিল তবুও এখন একবার দু’হাতের তালুতে বেশ ভালো করে হ্যান্ড স্যানিটাইজার লাগিয়ে নিয়ে জানালার কাছে এসে নিমগাছের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকলো আদিত্য শিন্ডে।
রাজগৃহ হাউসিং সোসাইটির ‘সি’ বিল্ডিং-এর তিনতলায় মধ্যবিত্তের সাধ্য অনুযায়ী সাজানো-গোছানো একটা দু’কামরার ফ্ল্যাট রয়েছে আদিত্য শিন্ডের। নীচের পার্কিং প্লেসে রয়েছে অফিসে যাওয়ার জন্য পুরোনো স্কুটার আর সপরিবারে ঘুরতে যাওয়ার জন্য চার আসনের চারচাকা। আধা-সরকারী অফিসের দশটা-পাঁচটার চাকরি, শান্তশিষ্ট অঙ্কে কাঁচা, দাঁত উঁচু বছর চৌদ্দোর মেয়ে, সংসারের ভারে ভরন্ত শরীরের পড়ন্ত যৌবনা স্ত্রী, অসুখ-বিসুখ, অভাব-অভিযোগ, চাওয়া- না পাওয়া নিয়ে পিতৃতান্ত্রিক পরিবার শিন্ডে সাহেবের।
আনমনা হয়ে গাছের ডালে বসা পাখিদের কলকাকলি শুনছিল আদিত্য। এমন সময় রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা একটি অতি পরিচিত সুগন্ধে মনটা আনচান করে উঠল ওর, মনে পড়ে গেল আজ এখনও ব্রেকফার্স্ট করা হয়নি। সপ্তাহের অন্যান্য দিনগুলোতে সবার কাজের তাড়া থাকে তাই চটজলদি পাওভাজি বা কান্দাপোহা বানিয়েই জলখাবারের পর্যায় ইতি টানে সুরভি। কিন্তু রবিবারের ব্যাপারটাই আলাদা, ওইদিন তিনজনে একসাথে বসে গল্প করতে করতে ব্রেকফার্স্ট করে তাই সান ডে-র মেনুতে থাকে পুরি, সবজি নয়তো স্টাফড পরোটা। এখন যদিও লকডাউনের জন্য কারও কাজের তেমন তাড়া নেই তবুও সুরভি সেই আগের রুটিন মেনেই কাজকর্ম করে যাচ্ছে।
টাটকা মেথিশাকের সুগন্ধ আদিত্য শিন্ডের পা দুটোকে টেনে নিয়ে চলল রান্নাঘরের দিকে আর তখনই ওর চট করে মনে পড়ে গেল গত তিন চার দিনে ও তো বাজারমুখো হয়নি, এমনকি রোজকার দুধ পাঁউরুটিও রাজকমল স্টোর্স থেকে হোম ডেলিভারি নিয়েছে। তাহলে সুরভি কোথা থেকে এতো টাটাকা শাক পেলো ? তার মানে ওর কথা অমান্য করে বাইরে বেরিয়েছে ? ব্যাপারটা সরেজমিনে দেখবার জন্য দ্রুতপদে গ্যাস ওভেনের দিকে এগিয়ে গেল আদিত্য।