T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় মেরী খাতুন
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা
মহান কবি ও সাহিত্যিক,গানের তরীর কর্ণধার রবীন্দ্রনাথের একটি অন্যতম পরিচয় হলো তাঁর দার্শনিক চিন্তায়।দর্শণ তাঁর কাছে জীবনদর্শন।বড় নিকট থেকে জীবনকে দেখা ও জীবনের সত্যকে জানা।এই দর্শন ও অন্বেষণের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার উন্মেষ।জীবনের একটি বড় অংশই তাঁর কেটে গেছে হাতে করে বিদ্যালয় গড়ে তুলতে,আর হাতে ধরে শেখাতে।তাঁর সংবেদনশীল মন বুঝেছিল যেখানে রসের অভাব সেখানে শিক্ষাও অসম্পূর্ণ,বাস্তব প্রয়োজন,পরিস্থিতির প্রতিকূলতা ও মনের আনন্দ এই তিনে মিলে যাতে সার্থক শিক্ষার বিকাশ হয় সেই প্রচেষ্টায় ছিল তাঁর সারাজীবন।
শিক্ষার হেরফের,শিক্ষার সমস্যা,জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়,আশ্রমের রূপ ও বিকাশ ইত্যাদি রচনা এবং ব্রম্ভাচর্য বিদ্যালয় স্থাপন,বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা,শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা অন্যদিকে ভ্রমণ কথা,ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের বিরাট সম্ভার,শিক্ষা বিষয়ক বাংলা ইংরাজি বিবিধ প্রবন্ধের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষাচিন্তাকে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন।
দেশের প্রচলিত শিক্ষার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের মন শিশুকাল থেকেই বিদ্রোহ করেছে।প্রকৃতির সাহচর্য শিক্ষার ক্ষেত্রে মানুষের কাছে অন্ন জলের মতোই অপরিহার্য।এই কথাই ছিল তাঁর শিক্ষানীতির মূল কথা।তিনি বলেছেন—-“যে দেশের সামাজিক শিক্ষাশালায় বাঁধা প্রথা হইতে একচুল সরিয়া গেলে পথ হারাইতে হয়, সে দেশে মানুষ হইবার পক্ষে গোঁড়াতেই একটা প্রকান্ড বাঁধা।”
বড় বড় অট্টালিকার ইঁট কাঠের সম্ভার–“বিদ্যালয়,মহাবিদ্যালয়,বিশ্ববিদ্যালয় পাতার মতো পাতা পড়াইয়া বস্তা বোঝাই করিয়া ডিগ্রিধারী মানুষ তৈরি করিতেছে।”পাঠ ও পরীক্ষার সংকীর্ণ বৃত্তের মধ্যে যে শিক্ষা আবদ্ধ রবীন্দ্রনাথ সেই শিক্ষাকে ‘শক্তিহ্রাসকারী নিরানন্দ শিক্ষা’বলে অভিহিত করেছেন।এই প্রসঙ্গে তাঁর একটা উক্তি—“সব জিনিসকে বই-এর মধ্য দিয়া জানিবার একটা অস্বাভাবিক অভ্যাস আমাদের মধ্যে বদ্ধমূল হইয়াছে।পাশে যে জিনিসটি আছে তাকে জানিতে হইলে বইয়ের মধ্য দিয়া জানিতে হয়।তুচ্ছ বিষয়টুকুর জন্যও বই নহিলে মন আশ্রয় পায় না,বই-এর ভিতর দিয়া জানাকেই আমরা পান্ডিত্য বলিয়া গর্ব করি,জগতকে আমরা মন দিয়া না ছুঁইয়া বই দিয়া ছুঁই।”
তাঁর শিক্ষাচিন্তায় শিক্ষাবস্তুটি যান্ত্রিক ছিল না।তিনি বলতেন আত্মবিশ্বাস ও আত্মোপলব্ধিই হবে শিক্ষার ফল।তাঁর মতে শিক্ষার জন্য যেমন চাই উন্মুক্ত পরিবেশ,তেমনি শিক্ষার দ্বার যেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্য সমানভাবে খোলা থাকে।সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো সব রকমভাবে পৌচ্ছে দেবার জন্য তিনি শান্তিনিকেতনের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রীনিকেতন।সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার করতে না পারলে অজ্ঞানের অন্ধকারে দেশের অর্ধেক লোক ঢাকা পরে থাকলে শিক্ষার প্রকৃত রুপটি যে অপ্রকাশিত থেকে যাবে এই সত্যটি উপলব্ধি করেছিলেন।
——রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তায় আমরা জাতীয় শিক্ষানীতি প্রবর্তনের উল্লেখ দেখতে পাই।তাঁর মতে জাতীয় শিক্ষা আন্তর্জাতিক শিক্ষার পরিপূরক।তাঁর শিক্ষাচিন্তায় এই দুই স্তরের সমন্বয় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। ‘বিদ্যাসমন্বয়’ প্রবন্ধে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয়ের কথা বলেছেন।জাতীয় বিদ্যালয় প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন—“জাতীয় বিদ্যালয় যে কেবলমাত্র আমাদের ছাত্রদের শিক্ষা দিয়া কল্যাণ সাধন করিবে তাহা নহে।দেশের মাঝখানে একটি পূজার যোগ্য মহৎ ব্যাপারের উপস্থিতিই লক্ষ্যে অলক্ষ্যে আমাদিগকে মহত্বের দিকে লইয়া যাবে।”
রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব ঐতিহ্যের প্রতি পরম বিশ্বাসী ছিলেন।তিনি তাঁর শিক্ষা-পরিকল্পনাকে বিদেশী ছাঁচে গড়ার চেষ্টা করেননি।দেশের প্রাচীন সংস্কৃতি ও কৃষ্টিধারাকে তিনি তাঁর শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মূর্ত করবার ব্রত গ্রহণ করেছিলেন।জগতের ইতিহাসকে স্বতন্ত্র দৃষ্টিতে দেখা,স্বাধীন গবেষণার দ্বারা কোন কিছুকে যাচাই করার মত মানসিকতা আমাদের নেই।মহাসত্যের কোন মূর্তি কিভাবে দেখা যায় শিক্ষিত হয়েও মানুষ তা আবিষ্কারের চেষ্টা করে না—–
“ভয়ে ভয়ে যাই ভয়ে ভয়ে চাই।
ভয়ে ভয়ে শুধু পুঁথি আওড়াই।”
শিক্ষা তথাকথিত শিক্ষিত সমাজকে এইভাবে পরাভূত করেছে।
——প্রাণশক্তির উৎস সেই পরম সত্যকে জানার মধ্য দিয়ে নিজেকে উপলব্ধি করাই শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত।সৌন্দর্যানুভূতি ও রসোপলব্ধি সৃজনমূলক প্রচেষ্টা,মানবপ্রেম এবং সর্বোপরি অতীন্দ্রিয় সর্বব্যাপী পরম শক্তির উপলব্ধি সমন্বিত শিক্ষায় হবে প্রকৃত শিক্ষা।রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তায় এই সব বক্তব্যের উল্লেখ আছে।
তিনি বলেছেন—-“মানুষ যদি শিক্ষার নীচে চাপা পড়িয়া যায়,সেটাকে কোন মতেই মঙ্গল বলিতে পারি না।আমাদের যে শক্তি আছে তাহাতে মনোবিকাশ হইবে।আমরা যাহা হইতে পারি তাহাই সম্পূর্ণ রূপে হইব–ইহাই শিক্ষার ফল।আমরা চলন্ত পুঁথি হইব। অধ্যাপকের সজীব নোটবুক হইয়া বুক ফুলাইয়া বেড়াইব—–ইহা গর্বের বিষয় নহে। “
——-রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তায় মানবসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের কথায় বারবার বলা হয়েছে।অধ্যাপকদের শিকল বাঁধা দাঁড়ের পাখির মত বুলি আওড়ানো যেন শিক্ষার্থীর শিক্ষালাভের ফল না হয়। দ্বিধা বর্জিত হয়ে যেন নিজেকে লাভ করতে পারে।তারা যেন অস্থি মজ্জার মধ্যে উপলব্ধি করে—–
“সর্বং পরকাং দুখাং সর্বমাত্মকাং সুখম্।”
—শিক্ষার্থীর মন যেন কখনও উপকরণের দ্বারা আবদ্ধ বা আচ্ছন্ন না হয়।কারণ উপকরণের মধ্যে অমৃত নিহিত থাকে না,চিত্ত যখন সমস্ত উপকরণকে জয় করে আপন সত্তাকে লাভ করতে পারে তখনই অমৃত লাভ হয়।
——রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা শুধু তত্ত্ব ভিত্তিক না তার বাস্তব প্রতিরূপ কিছু আছে?এই বিষয়টি আলোচনা করলে দেখা যায় যে আমাদের গোটা শিক্ষা কাঠামোর মধ্যে আদর্শের বুলি যাই হোক বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শকে তেমন রূপ দেওয়া হয় নি।তাঁর স্বপ্নাদর্শের মূর্তরূপ শান্তিনিকেতনে বর্তমানে তাঁর শিক্ষানীতি কতটা অনুসৃত হচ্ছে সে সম্পর্কে শিক্ষাবিদ ও পন্ডিতেরাও একমত নন।যদিও দেশের অন্যান্য পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষেত্রে তাঁর শিক্ষানীতির সম্পূর্ণ প্রয়োগ হয়তো সম্ভব নয়,তবুও সর্ব অবস্থাতেই শিক্ষানীতির আদর্শ মানুষকে অসত্য থেকে সত্যে নিয়ে যাওয়া,অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যাওয়া,মৃত্যু থেকে অমৃত লোকে নিয়ে যাওয়া।
“তুমি নন্দন-কল্পতরু যে,তুমি অক্ষয় বট,
বিশ্ব জড়ায়ে রয়েছে তোমার শত কীর্তির জট।”
——-কাজী নজরুল ইসলাম।