অমল সবেমাত্র স্নান সেরে বেরিয়েছে। বাথরুমের দরজার পাল্লাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে দামি সাবানের গন্ধ ডাইনিং-এর বাতাসকে সুরভিত করে তুলেছে।রান্না ঘর থেকে কড়াই আর খুন্তির অবিরাম সংঘর্ষের টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে।পড়ার ঘর থেকে মেঘলার একটানা পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
শোবার ঘরে ঢুকে প্যান্টটা পরতে পরতে অমল উচ্চ কণ্ঠে বলল -“আমার স্নান হয়ে গেছে-এবার ভাত দিলে হয় যে।”
মেঘলার পড়ার শব্দ ক্ষণিকের জন্য থেমে গেল।রান্নাঘরে কড়াই় আর খুন্তির সংঘর্ষের সাময়িক বিরতি ঘটল। রান্না ঘর থেকে অলকার কথা ভেসে এল-“ভাত রেডি আছে-বসে গেলেই হল।তবে বলছি যে-ভিজা গামছা পরেই খাওয়া হবে,নাকি প্যান্ট শার্টটা পরে খাওয়া হবে!”
গেঞ্জিটায় মাথা গলাতে গলাতে অমল ভাবতে লাগল-কথাটা স্বাভাবিকভাবে বলল,নাকি একটু খোঁচা মারল? ঠিক খোঁচাই মেরেছে। না হলে ভিজা গামছার কথা বলল কেন? সহজ ভাবে বললেই তো পারত-পোশাকটা পরে নাও, ভাত দিচ্ছি।’
ভিজা পাজামা ,গেঞ্জি, গামছা,ইত্যাদি হাতে নিয়ে ছাদের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অমল তিক্ত কন্ঠে বলল -“ভিজা গামছা পরেই খাব ,না কী করব সেটা আমার ভাবনার বিষয়। নিজের ডিউটিটা ঠিক ঠিক করলেই তো হয় ; কেবল অপরের উপর খবরদারি করা শোভা পায় না।”
রান্না ঘরে খুন্তিটা বোধহয় জোর আঘাত করল কড়াইটাকে-টং শব্দে ডাইনিং-এর ফ্যানটা কেঁপে উঠল। অমল থেমে গেল। রান্না ঘরের দরজায় অলকার ঘামে ভেজা ভেজা মুখ দেখা গেল। আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বলল- “আমাকে ডিউটি শেখাতে হবে না। আমার ডিউটি আমি ঠিক ঠিকই করি।ওভার ডিউটিও করতে হয়। আমাকে জ্ঞান না দিয়ে বরং নিজের ডিউটিটা ঠিক ঠিক করতে শেখা দরকার। এতটুকুও সাহায্য করার দিকে নেই কেবল কথা শোনানো।”
অমলের পা দুটো সিঁড়ির ধাপে থমকে গেছে। ভিজা পোশাক থেকে টস টস করে জল ঝরে পড়ছে। চোখ দুটো গোল গোল করে অমল বলে উঠল -“আমার ডিউটি আমি করি না তো কি লোকে করে ?আমার বদলে বাজার করতে যায় কে?একদিনও আমার বদলে অফিসে ডিউটি করতে যায় কী ? এই যে ভিজা পোশাক ছাদে মেলতে নিয়ে যাচ্ছি-এটা কার কাজ?কার ডিউটি আমি করছি?বলে কিনা-’ওভার ডিউটিও করি’! এই তার নমুনা।”
অলকার কন্ঠে রাগ মিশ্রিত বিস্ময় -“নিজের ভিজা পোশাক নিজে শুকোতে না দিলে কী আমি দেবো ? আমার কী আর কোনো কাজ নেই ? আমি কী কারও দাসী-বাঁদি নাকি !”
অমল বিড়বিড় করে বলল- ” দাসী-বাঁদি হবে কেন-মহারানী ! আমি হলাম দাসানুদাস-গোলাম!”
অলকা ফোঁস করে উঠল -“কী ! আর একবার শুনি।”
অমল মৃদু কন্ঠে বলল-” যা বলেছি আশা করি কানে গেছে।এখন ভাত না পেলে আমার দেরি হয়ে যাবে। এমনিতেই তো ‘লেট রানিং’ বলে আমার একটা সুনাম আছে-সুনামটা আর বাড়তি দিতে চাই না।”
অলকার উত্তর শোনার অপেক্ষা না করে অমলের থমকে থাকা পা দুটো আমার সচল হল। ভিজা পোশাক মেলে ক্লিপ এঁটে দিল।
নীচে নেমে এসে দেখল-ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা ভাতের থালা থেকে সাদা বাষ্প বাতাসে মিশে যাচ্ছে।কাছে দাঁড়িয়ে আছে মেঘলা।
ফ্যানের স্পিড সর্বোচ্চ সীমায় থাকা সত্ত্বেও অমল আরও স্পিড বাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে মেঘলাকে বলল-” কিরে তুই পড়া ছেড়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে ! এখনই খিদা লেগে গেল?”
মেঘলা শুকনো মুখে বলল -“আমার এখন খিদা লাগেনি-মাতৃ আদেশ পালন করছি।”
অমল চেয়ারে বসতে বসতে অবাক হয়ে তাকাল মেয়ের মুখের দিকে- নয় বছরের মেয়ের মুখে এ কী কথা !
মেঘলা বলল -“মা বলল যে ‘পড়া ছেড়ে পাহারা দে ,না হলে বিড়াল এসে ভাত খাবে ; তখন বিড়াল এঁটো ভাত খাইয়েছি বলে আমার নামে নালিশ হবে।’ তাই ভাত পাহারা দিচ্ছি।”
অমল বিস্মিত হয়ে বলল-“এই গরম ভাত আমিই খেতে পারব কিনা সন্দেহ-বিড়াল মুখ দেবে কী করে ! আর নালিশ জানাবই বা কার কাছে ? যাদের কাছে নালিশ জানাতাম তারা তো আজ পনেরো দিন হল মেয়ের বাড়ি গিয়ে হাওয়া খাচ্ছেন।”
মেঘলা হাসিমুখে বলল-” দাদু দিদার কথা বলছ বুঝি ?”
–“তা না হলে কী আর পুলিশের কথা বলছি !”
–“তা গেলেই তো হয় পুলিশের কাছে — কে বারণ করেছে ?”
ডাল আর শুক্তোর বাটি টেবিল উপর রাখতে রাখতে অলকা বলল।
” ঘরের কথা নিয়ে পরের কাছে ছুটে যাব -এমন আহাম্মক আমি নই “-বলতে বলতে ভাতে হাত দিয়ে ‘উহুহু’ করে চিৎকার করে উঠল অমল। মেঘলা প্রাণ খুলে হাসতে নিজের ঘরে চলে গেল।
অলকা আবার রান্না ঘরে চলে গেল। কড়াই খুন্তির সংঘর্ষের শব্দ ভেসে এল।
মিনিটের কাঁটাটা পাঁচের ঘরে চলে এল। গরম ডাল ভাতে ঢেলে মাখার চেষ্টা করল অমল,কিন্তু ডালের গরমে ভাত আরও গরম হয়ে উঠল।মাখা তো দূরের কথা হাতের আঙুল ছোঁয়াতেও পারল না। অমল অসহায় বোধ করল। রান্নাঘরের দরজার দিকে বার কয়েক তাকাল।
মুখোমুখি সামনের চেয়ারটায় অলকা বসেনি আজ।প্রায় প্রতিদিনই খাওয়ার সময় কাছে এসে বসে।বাবা এই সময় পেপার পড়েন, মা রান্নায় সাহায্য করেন বা অবশিষ্ট রান্না শেষ করেন। অমলা কাছে বসে ‘এটা নাও -ওটা নাও’ বলে চাপাচাপি করে। কোন্ কোন্ দিন মেঘলা কাছে এসে ‘এটা খাইয়ে দাও ,ওটা খাইয়ে দাও’ বলে আবদার করে।অনন্যা খাইয়ে দিতে বলে না-কাছে দাঁড়িয়ে মজার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।অমল জিজ্ঞাসা করে-“তুই হাসছিস কেন রে ?”
মেঘলাকে প্রায় টেনে নিয়ে পড়ায় বসিয়ে দেয়। আজ অনন্যা টিউশন থেকে এখনও ফিরে আসেনি। মা বাবা বাড়িতে নেই। মেঘলাও কাছে এসে আবদার করছে না।মেঘলা কেন আসছে না-কে জানে?
ভাত কিছুটা ঠান্ডা হতেই অমল খাওয়া শুরু করল।না হলে দেরী হয়ে যাবে। খেতে খেতেও বার বার তাকাচ্ছে রান্না ঘরের দিকে।মাঝে মাঝে আলতো টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে -অনেকক্ষণ লড়াই করে কড়াই আর খুন্তি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এখনও রান্না বাকি আছে কী ? কিন্তু রান্না বাকি থাকলেও তো এসে বসে। তবে কী..?
তবে কী গতকালের ঝগড়াটা মনে রেখেছে? কিন্তু গতকাল বিকালের ঘটনাটাকে কী ঝগড়া বলা চলে ? না ,ওটা ঝগড়া নয়-কথা কাটাকাটি মাত্র। সেই রাগ অলকা এখনও মনের মধ্যে পুষে রেখেছে নাকি? মনে রাখার মতো বিশেষ কিছু তো বলা হয়নি ,আর যদিও মুখ ফস্কে বলা হয়ে গেছে–সে তো অলকাও বলেছে। প্রতিটি কথার উপযুক্ত জবাব দিয়েছে।তাহলে আজ এখনও রাগ দেখানোর কী আছে !
ঘটনার সূত্রপাত গতকাল বিকালে। অফিস থেকে ফিরে টিফিন ইত্যাদি সেরে অমল বসেছিল মেঘলার পাশে। মেঘলা টিভিতে কার্টুন দেখছিল -বাবাকে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে খুব খুশি।
অনন্যা যথারীতি টিউশনিতে।
অলকা দু’কাপ চা নিয়ে এসে বসেছিল।অলকা খুব ভালো চা করে।এক চুমুক দিয়ে তৃপ্তির শব্দ তুলেছিল অমল। প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল অলকার মুখের দিকে। লাজুক হেসে মুখ নিচু করেছিল অলকা।অমলের মনের মধ্যে খুশির বাতাস বইতে শুরু করেছিল।
অমল জানে – বৃষ্টি ,মানে পাশের বাড়ির বৌ-টির সঙ্গে অলকার খুব ভাব। দুজনে প্রায় সমবয়সীও বটে।পরিচয়টা অনেক আগে থেকেই ছিল- পাশাপাশি বাড়ি হওয়ার পর পরিচয়টা ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়েছে।বিকালে তো বটেই কাজের ফাঁক-ফোঁকর পেলেই দুজনকে একসঙ্গে দেখা যায়। ফিসফিস করে কী সব কথা বলে -আর হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ে! এছাড়াও টিফিন কৌটোর আনাগোনা তো আছেই। তাই বৃষ্টির গয়না কেনাটা অলকারই প্রথম জানার কথা। কিন্তু কথাটা তাঁকে কেন জানাচ্ছে- অমল ঠিক বুঝতে পারছে না।
অলকার পরের কথাতেই উদ্দেশ্যটার খানিকটা আভাস পেয়ে যায়। অলকা মৃদুস্বরে বলেছিল-” ওর দুল জোড়া বেশ সুন্দর। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। দেবে ওরকম এক জোড়া কিনে?”
অলকা আবদারের সুরে বলেছিল- “তা থাক, ওগুলো পুরানো হয়ে গেছে। দাও না কিনে ।”
বাবা আর কার্টুন দেখছে না দেখে মেঘলা চ্যানেল বদল করে চলছিল।
অমলের কন্ঠে বিরক্তি ফুটে উঠেছিল-” দাও না কিনে বললেই কী করে কিনে দেবো! টাকা কোথায়?’
অলকা তবু হাসি হাসি মুখ করে বলেছিল-” আমার কিছু টাকা আছে ,তুমি হাজার কয়েক দিলেই হয়ে যাবে।”
অমল হয়তো অকারণে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল- খালি কাপটা হাত থেকে পিছলে পড়ে গিয়েছিল-ফেটে গিয়েছিল কাপটা।মেঘলা অবাক চোখে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।
অমল বলেছিল-” টাকা কোথায় পাব -যে তুমি চাইলে আর হাজার কয়েক দিয়ে দিলাম! অপরের দেখে চলতে যেও না, নিজের সামর্থ্য বুঝে চলতে হবে। নিজের যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাই ভালো।”
অলকা বলেছিল-” সামর্থ্য বুঝেই চলি। কোনোদিন কিছু চেয়েছি তোমার কাছে ? জানি তো তোমার সামর্থ্য কম –ঘরের লোনটা এখনও…”
সামর্থ্য তুলে কথা বলায় অমলের খুব গায়ে লেগেছিল। কথার মাঝখানেই বলেছিল -“চাইতে হবে কেন ? না চাইতেই তো সব কিছু দিয়ে দিই তা আমার সামর্থ্য কম হোক আর যাই হোক।”
অলকার কন্ঠে বিস্ময়ের সুর- “কী দাও তুমি আমাকে !খাওয়া পরা ছাড়া কিছুই তো দাওনি। যা দিয়েছেন আমার বাবা।”
গলার জোর বাড়ছিল অমলের -“দিই নি তো দিইনি ,দিতে পারব না।কয়েক হাজার তো দূরের কথা কয়েকশ’ টাকাও দিতে পারব না ।”
গলায় জোর এনেছিল অলকাও -“দিতে পারবে না, নাকি দিতে চাও না? তোমার টাকা তুমি না দিতে পার, আমার তো জোর নেই ।তবু বলছি যে ,সংসারে দাসী- বাঁদি থাকলেও খাওয়া পরা বাদে বেতন পায়।”
অমল প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল-” বেতন চাইছ আমার কাছে ! নিজের সংসারের কাজ করছ আর বেতন চাইছ ! কই আমি যে কাজ করি আমি তো সংসারের কাছে বেতন চাইনি।” অলকা বলেছিল -“আমি বেতন চাইনি -কয়েক হাজার টাকা চেয়েছি মাত্র , তাতেই এত রাগ!”
মা-বাবার কথা কাটাকাটি দেখে মেঘলা টিভি বন্ধ করেছিল। দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। অমল আর কিছু বলার আগেই অলকাও মেঘলার পিছনে পিছনে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।
ব্যাস ,তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত অলকা সরাসরি আর কথা বলেনি। অবশ্য অমলও বলেনি। যা কথা হয়েছে দুই মেয়ের মাধ্যমে অথবা শুনিয়ে শুনিয়ে।
ভাত প্রায় শেষ হওয়ার মুখে। মিনিটের কাঁটা আরও এক ঘর পেরিয়ে চারে পৌঁছেছে। কাঁটাটা ছয়ে পৌঁছালে বেরিয়ে যেতেই হবে ,না হলে ’লেট রানিং’ আখ্যা জুটবেই ।
খেতে খেতে অমল ভাবল আজ মেঘলা একবারও তো কাছে এল না –খাইয়ে দিতে বলল না! অমল গলা তুলে ডাকল-” মেঘলা, এখানে আয় ।”
মেঘলা প্রায় ছুটে চলে এল। এতক্ষণ যেন ডাকের অপেক্ষা করছিল। আর এসেই বলল -“বাবা ,খাইয়ে দাও।”
তখনই বাটিতে গরম কিছু নিয়ে অলকা এল। বাটিটা টেবিলে রেখে সামনের চেয়ারে বসে পড়ল। অমল চোরা চাহনিতে অলকার দিকে তাকাল। তরকারির এক টুকরো আলু মেঘলার হাঁ করা মুখে চালান করে দিল। সদ্য আনা বাটিটার দিকে তাকিয়েই অমলের চোখ দুটি খুশিতে চকচক করে উঠল।মুখ থেকে আপনা-আপনি বেরিয়ে এল-“রুই পোস্ত!”
মেঘলা বলল -“বাবা, আমাকে রুই পোস্ত খাইয়ে দাও।”
অলকা যেন আপন মনে বলল-“বিক্রি করতে এনেছিল একজন ,দেখলাম -বেশ ভালোই।”
এক টুকরো মাছের কাঁটা ছাড়িয়ে অমল কিছুটা খাইয়ে দিল মেঘলাকে -বাকিটা নিজের মুখে পুরল।পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করার জন্য চোখ বন্ধ করল।
কয়েক সেকেন্ড পরে অলকার মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল-” অপূর্ব !খুব সুন্দর রান্না করেছ। দারুন! “