T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় দিলীপ কুমার ঘোষ
by
·
Published
· Updated
সংকোচ
ক্লাস নাইনে অনিমেষ মজুমদার ভাব সম্প্রসারণ করতে দিলেন—‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান/ সংকটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ’। চেয়ারে বসেছেন কি বসেননি, তাঁর মাথায় একটা ভাবনা এল। তাই তো! তিনি নিজেই যে আজ পর্যন্ত ‘সংকোচের বিহ্বলতা’ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। অদ্ভুত বিষয় এই সংকোচ! কারণ নেই, তবুও মানুষ কেমন সংকোচে ভোগে। তিনি কত মানুষকে দেখেছেন—যাঁরা সারা জীবনেও সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। মানুষমাত্রেই যে সংকুচিত হয়ে থাকে তা অবশ্য নয়। সংকোচ ঝেড়ে ফেলে শিরদাঁড়া সোজা রেখে দাঁড়ায় মানুষ। আর তাতেই না এগিয়ে চলে সভ্যতা।
অনিমেষবাবু আঠারো বছরের চাকরি জীবনে ইতিমধ্যে তিনটি স্কুল বদলেছেন। এটা তাঁর চার নম্বর স্কুল। দেখেছেন প্রতিটা স্কুলই আগের স্কুল থেকে কিছু না কিছু আলাদা। কিন্তু একটা জিনিস তিনি আর কোনও স্কুলেই বদলাতে দেখলেন না! স্কুলগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান বদলালেও নয়। প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা জেলায় অবস্থিত, তবু এই একটা ব্যাপারে সব স্কুলই সমান।
অথচ বিষয়টার গুরুত্ব যে কম—তা-ও নয়। তাঁর তো ছাই মাথাতেই ঢোকে না এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দিনের পর দিন কীভাবে অবহেলিত হতে পারে? তা-ও আবার এতজন শিক্ষিত মানুষের উপস্থিতিতে! যদিও তিনি নিশ্চিত—তাঁর মতো কারও কারও নিশ্চয়ই একই রকম মনে হয়। তবুও যে কেন কেউ কিছু বলেন না! এটা কি উদাসীনতা? না, সংকোচ!
“কী হল, লিখছ না কেন?” স্বদেশের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন অনিমেষবাবু।
স্বদেশ উঠে দাঁড়ায়। কিছু না বলে মাথা নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়েই থাকে।
“এত সংকোচ কীসের? বলে ফেলো।” কেউ উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকলে অনিমেষবাবু একথা বলবেনই। এটা তাঁর প্রায় মুদ্রাদোষের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
স্বদেশ থেমে থেমে বলে, “স্যর, কী লিখব…ঠিক… বুঝতে পারছি না। একটু ধরিয়ে দিন না, স্যর।”
“আর একটু ভাবো, নিজেই লিখতে পারবে।…সবার লেখা হয়ে যাক। যদি দেখি কারও লেখাই ঠিকমতো হয়নি, তবে লিখিয়ে দেব।”
অনিমেষবাবু আবার তাঁর নিজের ভাবনায় ডুবে গেলেন। ছাত্ররা জাতির মেরুদন্ড। সেই ছাত্ররা জাতি তথা দেশের জাতীয় সংগীত সঠিক ভাবে শিখবে সেটাই বাঞ্ছনীয়। অথচ তারা কী শিখছে? গাওয়ার সময় কী উচ্চারণ করছে? তারা কেন গাইছে, ”যমুনার গঙ্গা” অথবা “উচ্ছলো জলধিতো রঙ্গে”? কেন কেউ তাদের সংশোধন করে দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করছেন না?
তিনিই বা এতদিন কী করেছেন? এটা তো তাঁরও দায়িত্ব। তিনি কেন সংকোচ কাটিয়ে এগিয়ে যাননি? এখন ছাত্রদের কাছে তিনি কী ব্যাখ্যা দেবেন এই ‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান’-এর!
আর তিনি নিজের অপমান ঘটতে দেবেন না। আগামীকালই তিনি প্রেয়ার মিটিংয়ের শেষে হেডস্যরের অনুমতি নিয়ে এক মিনিট সময় চেয়ে নেবেন। ছাত্রদের উচ্চারণের ভুল ধরিয়ে দিয়ে তাদের বলবেন ভুলত্রুটি শুধরে নেওয়ার জন্য। অনেক দেরি হয়ে গেছে! তিনি আর দেরি করতে চান না। কিন্তু, ব্যাপারটা কি খুব নাটকীয় হয়ে যাবে? আগে কি কারও সঙ্গে তিনি একবার আলোচনা করে নেবেন? অনিমেষবাবু চমকে উঠলেন! আবার তাঁর মনে সেই সংকোচ! এই সংকোচ থেকে তাঁর কি আর মুক্তি নেই?
রাতে খেতে বসে তাঁকে অন্যমনস্ক দেখে অনীশ বলল, “কী হয়েছে বাবা, অন্যদিনের মতো মন দিয়ে তুমি আইপিএল দেখছ না কেন? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কী যেন ভাবছ, খেলাতে তোমার মন নেই।”
অনিমেষবাবু অনীশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “ভাবছি না রে, আসলে নিজেকে একটু আগামীকালের জন্য গুছিয়ে নিচ্ছি!”
“কেন? আগামীকাল তোমাকে কী করতে হবে?”
“কিছুই না, এই একটু…সংকোচ ঝেড়ে ফেলতে হবে।”
“দুর্, মাঝে মাঝে তুমি এমন কথা বলো না, কিছুই বুঝতে পারি না!…ঠিক আছে যাও, আমাকে বলতে হবে না!”
অভিমানে ছেলের ঠোঁট ফুলে উঠেছে দেখেও অনিমেষবাবু আর কথা বাড়ালেন না।
রাতে তাঁর স্বপ্নে এসে হাজির হলেন দুই মহাপুরুষ—বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ। তিনি দূর থেকে দেখতে পেলেন তপোবনের মধ্যে বৃক্ষছায়ায় একটা বেদীতে দু’জনে বসে রয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাতের মানসে ভক্তিপ্রণত চিত্তে তিনি সেদিকে অগ্রসর হলেন। কিন্তু তাঁদের কাছে পৌঁছনোর আগেই তিনি দেখলেন তাঁরা উঠে দাঁড়িয়েছেন। আর তাঁদের উঠে দাঁড়াতে দেখে তিনি ভিতর থেকে কেমন সংকোচ বোধ করতে আরম্ভ করলেন। আপনা-আপনিই তাঁর মাথা নীচু হয়ে গেল। তিনি অনুভব করলেন তাঁরা দু’জন তাঁর পাশ দিয়ে বাক্যালাপরত অবস্থায় চলে গেলেন। কিন্তু তিনি আর চোখ তুলে তাকাতে পারলেন না। তাঁর কানে শুধু অনুরণিত হল দুই প্রাজ্ঞজনের উচ্চারিত ধ্বনিমূর্চ্ছনা—‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্নিবোধত…’, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,…’
পরের দিন। প্রেয়ার মিটিং। ষোলোটা লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে প্রায় হাজার-বারোশো ছাত্রছাত্রী। তাদের মুখোমুখি চল্লিশের বেশি শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী। এদিনও যথারীতি সেই “যমুনার গঙ্গা” এবং “উচ্ছলো জলধিতো রঙ্গ”।
অনিমেষবাবু আগেই ভেবে রেখেছিলেন পরে-পরেই তিনি ভুলগুলো শুধরে দেবেন। সেইমতো জাতীয় সংগীত শেষ হতেই তিনি হেডস্যরের অনুমতি নেওয়ার জন্য এগোলেন। এমন সময় তাঁর চোখে পড়ল বাণীপাঠের জন্য এগিয়ে আসছে ক্লাস টেনের নেহা। তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভাবলেন বাণীপাঠ এবং নীরবতা পালনের পর বলবেন।
হেডস্যর ঘড়ি দেখে “টাইম” বলে নীরবতা ভঙ্গ করলেন। হেডস্যরের কাছে এগিয়ে যেতে গিয়ে অনিমেষবাবুর মনে কেমন একটু দ্বিধা জাগল। দ্বিধা কাটিয়ে “স্যর, একটা কথা ছিল”, বলে হেডস্যরের কাছে এসে দাঁড়ানোর আগেই লক্ষ করলেন সমস্ত ছাত্রছাত্রী সারিবদ্ধভাবে ফিরে চলেছে নিজের-নিজের ক্লাসের উদ্দেশে। অনিমেষবাবু নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলেন সেদিকে।
“কিছু বলবেন, অনিমেষবাবু?”
অনিমেষবাবু যেন ঘোরের মধ্যে থেকে বলে উঠলেন, “ন্—আ—হ্ স্যর,…আসলে…ঠিক আছে… এমন কিছু না।”
এটা কী হল? এত প্রস্তুতির পরও তিনি নিজের সংকোচ জয় করতে পারলেন না! কোথা থেকে এল এই বিহ্বলতা? সাহসে ভর করে কেন তিনি উদ্দেশ্য সিদ্ধির দিকে এগোতে পারলেন না? কোন ‘সংকটের কল্পনাতে’ তিনি এমন ‘ম্রিয়মাণ’ হয়ে পড়লেন? তিনি কি তাহলে ভীরু, কাপুরুষ? মানুষ ভুল করলে নিজের হাত কামড়ায়, আত্মগ্লানি বোধ করে। তিনি ভুল না করেও অনুশোচনা বোধ করতে লাগলেন। তাঁর মনে জাগল আত্মধিক্কার।
এরপর থেকে আর একদিনও অনিমেষবাবুর মুখে শোনা যায়নি, “এত সংকোচ কীসের?—”