• Uncategorized
  • 0

T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় সুষ্মিতা রায়চৌধুরী (নিউজার্সি)

সৃজনে শান্তিনিকেতন

যে ভ্রমণে পলাশরাঙ্গা একটা প্রেমকাব্য লেখা থাকে, যেখানে লাল মাটির রাস্তা বৃষ্টি ভেজা পায়ে আকাশের নীল রং একে দেয় সেখানেই তৈরি হয় বাঙালির “শান্তি নীড়”। শুক্রবার দুপুরেই তাই রাই উঠে বসে “শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসের” চেয়ার কারে। তিনঘন্টায় ট্রেন পৌঁছবে বোলপুর। একবছর আগে বাবা, মাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকেই মায়ের শরীর বেশ অসুস্থ। ডাক্তার বলছে অবসাদ থেকেই শারীরিক অবনতি। হার্ট কন্ডিশনও বেশ খারাপ। তাই কলেজে পড়ানো ছাড়াও একটা পার্টটাইম চাকরি করে রাই। বাবা মাসেমাসে টাকা পাঠালেও আজও তার অজানা এতগুলো বছর পর কেনো সে চলে গেল তাদের দুজনকে ছেড়ে।শেষ চিঠিটায় শুধু লেখা ছিল, “ভালোবাসা ছাড়লাম শান্তির খোঁজে”। মা-বাবার আলাপ এই শান্তিনিকেতনেই। রুপে-গুণে পটিয়সী কঙ্কনাদেবীর সবথেকে বড় আকর্ষণ ছিল গানের গলা। বাবার আবৃত্তি আর মায়ের গান জমিয়ে দিতে পারত যে কোনো আসর। রেডিওতেও এককালে অনেক প্রোগ্রাম করত মা।রাবীন্দ্রিক কলাকৃষ্টিতে দক্ষ হলেও মায়ের যেকোনো গানেই ছিল সুদক্ষ নিপুণতা। রাইয়ের বড় হয়ে ওঠার অনেকটা জুড়েই তাই রবিঠাকুর, গীতবিতান আর গীতাঞ্জলি। মাকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করা স্বত্তেও মা তাকে বলেনি বাবার চলে যাওয়ার কারণ। মা শুধু বলেছিল, “বাবাকে খোঁজার চেষ্টা করিস না”।
রাইয়ের বুক করা ছিল বাগানবাড়ি। ছোটবেলা বাবামায়ের হাত ধরে, তারপর একা, এই বাগানবাড়ি তার একমাত্র অবসর-বিনোদন। পৌঁছতেই প্রতিবারের মতন সুস্বাদু আহার পরিবেশন করা হয় তাকে। গরম ভাত, ডাল, ঝিরিঝিরি আলুভাজা, পোস্ত, দু’পিস করে রুইমাছ। চেনা টোটোকাকুকে বলে রাখা হয়েছিল স্টেশনেই।সে এসে পড়তেই দশমিনিটে রাই পৌঁছয় কোপাই নদীর ধারে খোয়াইয়ে। অস্তমিত সূর্যের বুকে যেনো আছড়ে পড়ছে বর্ষার কোপাই। এত শান্ত এত সবুজের মাঝখানে রাই আচ্ছন্ন হয়ে বসে থাকে অনাবিল আনন্দে। এই প্রথমবার বাবা ছেড়ে যাওয়ার পর মাকে নার্সের কাছে রেখে তার শান্তিনিকেতন আসা। হঠাৎ কানে ভেসে আসে একটা চেনা সুর। ঘাড় ঘোড়াতেই সে দূরে দেখতে পায় একজন মহিলা গান গাইছেন নিজের মনে। প্রৌঢ়ার গলার সুরে যেন আবেশ মাখানো এক মন্ত্রমুগ্ধ করা মাদকতা। কিন্তু শুধু গানের জন্য না, অন্যকিছু যেন বেশী আকৃষ্ট করছে রাইকে। এগিয়ে যায় রাই তার দিকে। রুগ্ন, ছোট ছোট করে চুল কাটা, ঢলঢলে সালোয়ার কামিজ পড়া ভদ্রমহিলা গান থামান রাইকে দেখে। রাই বলে “আপনার গানের সুরটা কেমন অন্যরকম চেনা লাগল।ঠিক মনে করতে পারছিনা।কিন্তু ‘চিরবন্ধু চিরনির্ভর চিরশান্তি’ গানটির এই সুরটি আমার বড্ড চেনা”।
“হ্যা, আমার বন্ধু নিজের মতন করে এই সুর দিয়েছিল এই গানে। কিন্তু তোমার তো জানার কথা নয়। এই সুর যে খুবই ব্যক্তিগত।” তারপর একটু থেমে আবার নিজেই বললেন, “কতবার বলেছিলাম ওঁকে গানের এই সুরটা সবার সামনে আনতে কিন্তু তাঁর সেই এক জেদ ছিল আমি না গাইলে এই সুর আর কেউ জানবেনা। আমার শরীর আর দিল না। গান গাওয়াও হল না আর তেমন।”
রাই বলে ওঠে, “আপনার নামটা? আপনি এত সুন্দর গান গাইতে পারেন, তাহলে গাননা কেন?”
স্মিত হেসে উত্তর দেয় রাইরঞ্জিনীদেবী, “কর্কট রোগে শরীর হেরে গেল আর বন্ধুর প্রতারণায় মন।”
রাই জানতে পারে, রাইরঞ্জিনীদেবীর প্রিয় বান্ধবী ছিনিয়ে নেয় তার ভালবাসার মানুষকে যিনি সুর সৃষ্টি করেছিলেন শুধু তার জন্য। সেদিন ক্যান্সারের খবরটা প্রথম পেয়েছিলেন রাইরঞ্জিনী। সেদিনই ছিল রেকর্ডিং। আতঙ্কে দূর্বল রাইরঞ্জিনী পৌছতে পারেননি সেদিন। প্রিয় বান্ধবীটিও ভালবাসত একই মানুষকে। সেই বোঝায় তাকে, এই অসুস্থতা নিয়ে উচিত না অন্য কারোর জীবন নষ্ট করা। তাই প্রিয় বান্ধবীর কাছে সে সমর্পণ করে তার ভালবাসা। ছেড়ে যেতে না চাইলেও মানুষটি তখন অসহায় রাইরঞ্জিনীদেবীর জেদের কাছে। ঔদ্ধত্যের অভিনয়ে ছেড়ে যেতে বাধ্য করে রাইরঞ্জিনীদেবী তাকে। তখন সে পাঁচ মাস অন্তসত্তা।
রাইয়ের বুক কাঁপতে থাকে অজানা আশঙ্কায়। তবে কি রাইরঞ্জিনী তার বাবার শান্তির আশ্রয়? এই কি তবে তার বাবার শেষের কবিতা? শেষটা যে তাকে জানতেই হবে!
“আপনার গান শোনার আরও ইচ্ছে রইলো”, বলে রাই।
“কাল এসো আমার বাড়ি”, ঠিকানা দেয় রাইরঞ্জিনী।
ফেরার পথে টোটো ছেড়ে দিয়ে রাই হেঁটে যায় অন্ধকার রাস্তায়। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে তাকে পথ দেখায় অজস্র জোনাকি। দূর থেকে শোনা যায় “সকল অহংকার হে আমার, ডুবাও চোখের জলে”। কাল গন্তব্য সোনাঝুড়ি।
সকাল এগারোটায় রাই পৌছয় শান্তিনিকেতন ভবন যা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তৈরি করেছিলেন। এটি আশ্রমের সর্বাপেক্ষা পুরনো বাড়ি । তারপর উপাসনা মন্দির। বেলজিয়াম কাচের রঙিন কারুকার্যময় নান্দনিক নকশায় নির্মিত এই উপাসনামন্দিরটি। এগিয়ে যেতেই একটা সুন্দর গন্ধ ভেসে এল নাকে। ছাতিমতলায় দাড়িয়ে তখন শিউলিস্নাত রাই। আরেকটু এগোতেই আম্রকুঞ্জের বাতাস লাগল শরীরে। পাঁচটি বাড়ি নিয়ে গড়ে উঠেছে উত্তরায়ন। উদয়ন, কোনার্ক, শ্যামলী, পুনশ্চ এবং উদীচী। এই প্রতিটি বাড়ি ঢোকার মুখেই লেখা আছে কবে কখন কি কারনে রবীন্দ্রনাথ সেই বাড়িগুলি তৈরি করেছিলেন । রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, নোবেল পুরস্কারের রেপ্লিকা, বিভিন্ন দেশ থেকে পাওয়া উপহার, বাদ্যযন্ত্র, কলম সবকিছুই ‘উদয়ন’ বাড়িটিতে সাজানো রয়েছে। রাই যেন চোখের সামনে দেখতে পায় চেনা চরিত্রের ত্রিকোণ প্রেমকাব্য।পাঠভবন ছুঁয়ে টোটো ছোটে সোনাঝুড়ি। বাউল আর সাঁওতালি ছন্দে, সোনাঝুরি, ইউক্যালিপ্টাস, অমলতাস গাছগুলির দিকে তাকিয়ে থাকে রাই। হস্তশিল্প, কাঁথাকাজ, চামড়ার ওপর বাটিকের কাজ, গালা শিল্প, তাঁত শিল্প, যা নান্দনিক সব পাওয়া যায় সোনাঝুড়িতে। ঈশান কোণে তখন মেঘ জমেছে আবার। রাই বুঝতে পারলেও শান্ত করতে পারছে না নিজের মন। একটা ছোট সাদা বাড়ির সামনে টোটো এসে থামে।
বাগান পেরিয়ে দরজার সামনে আসতেই স্থির হয়ে যায় রাইয়ের সমস্ত অনুভূতি। দরজার একপাশে সরে দাঁড়িয়ে রাই দেখে বাবার হাসি। রাইরঞ্জিনীর হাতটা ছুঁয়ে বসে আছে অনিমেশ আর অন্যহাত বিলি কাটছে ছোটছোট চুলের মধ্যে।উঠে দাড়ায় বাবা,দরজার দিকে তাকিয়ে বলে, “কেউ কি এলো”!
চকিতে সরে যায় রাই। বাবা এখনও অনুভব করতে পারে তার উপস্থিতি। বাঁশির স্নিগ্ধ সুরে ভরে যায় ঘর। বাবা বাঁশি বাজাতে পারে জানত না রাই।
কিন্তু বেশিক্ষন না। হঠাৎ শ্বাসকষ্টে থেমে যায় সব।
“রাই কষ্ট হচ্ছে? একটু দাঁড়াও ডাক্তার ডাকি”। বাবার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে রাইরঞ্জিনী।
রাই প্রথম উপলব্ধি করে তাদের দুজনের নামের শুরুটা এক। বেরিয়ে আসে সে কিছু না বলে।
বাগানবাড়িতে ফিরে ফোন করে সে মাকে। শুধু একটা নাম উচ্চারণ করে সে, “রাইরঞ্জিনী”। অন্যদিকের দীর্ঘনিশ্বাসে সবটা স্বচ্ছ, পরিষ্কার। শুধু একটা উত্তর পাওয়া বাকি। “আমার নামটার সাথে ওনার নামের এতো মিল কেন”?
কঙ্কনাদেবী বলতে থাকেন বিস্তারিত।ভালবাসার মরিয়া জেদে তাঁর প্রিয় বান্ধবীর ভালবাসাকে নিজের করে নিলেও পিতৃহীন করেননি তাদের সন্তানকে। প্রথম থেকেই অনিমেশ ভালবাসত রাইরঞ্জিনীর গান। রাইরঞ্জিনীর গানে বিরাজ করতেন ঠাকুর আর তা ছিল শুধু অনিমেশের জন্যই। না কোনও উচ্চাশা, না কোনও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তাগিদ।রবি প্রেমেই নিমজ্জিত তাদের সমস্ত চেতনা, উপলব্ধি। রাই তাদের হৃদয়রক্তরাগে প্রস্ফুটিত একমাত্র ধ্রুবতারা। কিন্তু কর্কট রোগের আস্ফালনে থাবা বসায় স্বার্থপর বন্ধুত্ব। অনিমেশের নতুন সুরে রবীন্দ্রসঙ্গীত পায় এক নতুন দিক। কঙ্কনাদেবীর ভালবাসায় প্রলোভন ছিলো সেটাই। কিন্তু বিয়ের পরে ভালোলাগাটুকু দিলেও, সেই সুর আর বাধেননি অনিমেশ তার জন্য। অসুস্থ রাইরঞ্জিনীর অনুরোধে তাদের সন্তানকে মায়ের নাম দেয় কঙ্কনাদেবী। অনিমেশকে তিনি বলেছিলেন দত্তক নিতে চান এক অনাথ শিশু, রাইয়ের আসল পরিচয় গোপন থাকে চিরকাল। অনুশোচনা না প্রিয় বান্ধবীর প্রতি কর্তব্য তা সঠিক জানা নেই। কিন্তু এত বছর ধরে গীতবিতানে লুকিয়ে রাখা রাইরঞ্জিনীর শেষ চিঠিটা হঠাৎই হাতে আসে অনিমেশের। যে আম্রকুঞ্জে প্রাণ বেঁধেছিল গুরুদেবের দুই উপাসক, তাদের আলাদা করে এমন সাহস কার! কঙ্কনার থেকে অনিমেশ রাইকে আলাদা করে না কিন্তু ফিরে যায় তার প্রতিশ্রুতির কাছে। যে সুর বাঁধা হয়নি, হয়ত সেই সুরের নবজন্ম দিতে। সমস্ত প্রেমে, বিচ্ছেদে একমাত্র আশ্রয় রবিঠাকুর। অব্যাহতি এবার ছাতিমতলায়। শেষ নিশ্বাসটুকুতে শান্তি পায় অপেক্ষারা।
“রাই, আমি খুব ভালবেসেছিলাম অনিমেশকে। তাই তাকে মুক্তি দিলাম। কিন্তু তুইও কি চলে যাবি আমায় ছেড়ে….”। ফোন নামিয়ে রাখে রাই। ঠাকুরের সৃষ্টিতে ভুল-ঠিকের মাপকাঠি যে ভীষণ গৌণ। হয়ত অসমাপ্ত সমাপ্তিতেই লেখা থাকে চিরসুন্দরে মোড়ানো চিরকালীন কথারা। দেয়া-নেয়া, মিলন-বিরহ, রাগ-অনুরাগে, আনন্দ বেদনার সুগাম্ভীর্যে মুড়িয়ে ভালবাসার রসে রঞ্জিত করে রবিঠাকুর যেন বেঁধে দিয়ে গেছেন এই প্রেমকাব্য। রাই সেখানে কাব্যসিক্ত এক গীতমালা। তার অনাদর হয়নি কোথাও।
বৃষ্টি নামে আবার। অদ্য শেষ রজনি এখানে। আগামীকাল দুপুরেই ফেরার ট্রেন। বর্ষার শান্তিনিকেতনে রাইয়ের চোখের জল দেখতে পায় না কেউ। নাই বা হল বসন্ত তবুও একটা প্রশান্তিতে ভরে যায় রাইয়ের মন। এখানে হঠাৎ করেই বৃষ্টি হাসে মেঘে, ঝিরিঝিরি হাওয়ার আলিঙ্গনে দূর হয় ক্লান্তি।
‘শুকতারা’ ‘অরূন্ধতী’ পথ দেখায় রাতে। হাওয়াতে ভেসে বেড়ায় মিষ্টি-মধুর শব্দ, শীতল জলে ফোটে ‘পদ্ম’। সবুজ বাগিচায় নীল ভোমরা গুন গুন গান গায়, বাতাসে আসে জংলী ফুলের সুবাস আর আশ্রয় পায় প্রেমবৈচিত্র।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।