T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় সুদীপ পাঠক
by
·
Published
· Updated
রবীন্দ্রজয়ন্তী ও একটা বই
আজ পঁচিশে বৈশাখ । সকাল থেকেই আকাশ এবং পুকুলি বুড়ি দু’জনেরই মুখভার । গতকাল মধ্যরাত থেকে শুরু হয়েছে প্রবল বর্ষণ আর সেইসঙ্গে গুড়ুম গুড়ুম মেঘের গর্জন ও চোখ ধাঁধানো বিদ্যুতের চমক । সেই থেকে একটানা বিরামহীন বৃষ্টি পড়ে চলেছে । কখনো ঝিরঝির করে কখনো মুষলধারায় । রাগ দুঃখ হতাশা সব যেন একসঙ্গে চেপে বসেছে পুকুলির মাথায় । অবশ্য তার সঙ্গত কারণ আছে । এই নিয়ে পরপর দু’বছর হলো তাদের নাচের স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তী স্থগিত রাখতে হলো । অতিমারি সেই যে থাবা বসিয়েছে গোটা পৃথিবীর উপর ; সেই থেকে দানবটা যেন আর নড়বার নামই করে না । আশা করা হয়েছিলো বছর ঘুরলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে । কিন্তু ফল হলো উল্টো । এখন লগ ডাউনের নিষেধাজ্ঞা বা কড়াকড়ি কমেছে বটে , তবে মারণ ব্যাধির প্রকোপ কমে তো নি , উল্টে বৃদ্ধি পেয়েছে । বিষাক্ত ছোবলের ভয়ে সবাই আতঙ্কে ঘরবন্দী । দ্বিতীয় তৃতীয় ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে ।
সুমেরু ও চিত্রা দুজনেই আই টি প্রফেশনাল । কর্মসূত্রে পরিচয় , সেই থেকে আলাপ প্রলাপ বিলাপ ; পরিশেষে শুভ পরিণয় । উভয়েই তাদের একমাত্র শিশুকন্যা সুমিত্রার মনবেদনার কথা ভালোই উপলব্ধি করতে পারে । বয়েস আট বছর হলে কি হয় সে নৃত্য অন্ত প্রাণ । সবে যখন টলোমলো পায়ে হেঁটতে শিখেছে তখন থেকেই কানে মিউজিক গেলে তালে তালে দুলতে থাকতো । তিন বছরে পা দিতে না দিয়েই তাকে ভর্তি হলো নাচের স্কুলে । অল্প সময়ের মধ্যেই দিদিমণির নজর কেড়ে নিতে সক্ষম হয় সেই পুঁচকে মেয়ে । পাঁচ বছরে প্রথম মঞ্চে অবতীর্ণ হওয়া , দলগত ভাবে । পরের বছর একক নৃত্যে ক্লাস ওয়ানের সুমিত্রা বসু সকলকে অবাক করে দিলো তার অসাধারণ পারফরমেন্স দিয়ে । সবাই তাজ্জব বনে গেছে । জনে জনে এসে তার মা বাবাকে বলে গেলো “তোমাদের মেয়ে বড় হয়ে নির্ঘাৎ ফিল্মস্টার হবে দেখো” । বলা বাহুল্য সুমেরু ও চিত্রা এসব কথায় বিশেষ পাত্তা দেয় নি । বড় হয়ে কে কি হবে সে প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভেই নিহত আছে থাক । আসল কথা হলো মনের আনন্দ , মনের প্রফুল্লতা লাভ করা । চিন্তার ঔদার্য ও শিল্পবোধ তৈরী বিকশিত হওয়া । অত্যন্ত গাদ্যিক নিরস কাজে ও জগতে যুক্ত থেকেও সেই বিরল গুণগুলি আজও বজায় রাখতে পেরেছে বোস দম্পতি । শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চাই বোধহয় ছিলো তাদের মেল বন্দ্ধনের সেতু । একত্রে লিটিল ম্যাগাজিন করা , স্ট্রীট থিয়েটার কর্মী হওয়া , ভাঁড়ারে জমা পড়েছে অনেক রসদ ।
তবে সবই থমকে গেছে এখন । এক বছরের বেশি সময় ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে তারা যেমন ক্লান্ত , অন লাইন ক্লাস করে পুকুলিরও সেই একই হাল । চিড়িয়াখানার পশুর মনে খুশি বলে কিছু থাকে কি ? যতই তাকে প্রতিদিন রাজভোগ দেওয়া হোক না কেন ! বড়দের মতো পুকুলি এখন ভার্চুয়াল জগত ও সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কে যথেষ্ঠ ওয়াকিবহাল । সব কিছু তার নখদর্পণে । ফেসবুকে তার নিজের এ্যাকাউন্ট না থাকলেও অধিকাংশ সময় মায়ের মোবাইল ফোন থাকে তার হাতে । ফল স্বরূপ যা হওয়ার তাই হয় । লাইক কমেন্ট শেয়ার সবেতেই সে পটু । সেল্ফি তুলে পোষ্ট দেওয়া তো ‘বাঁয়ে হাত কা খেল্’ । সুমেরু ভাবলো সবই যখন হাতের মুঠোয় রয়েছে তখন এ্যাডভান্টেজ না নেওয়াটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না । বুকশেল্ফ থেকে খুঁজে পেতে বের করে আনলো একটা বই । সযত্নে ধুলো ঝেড়ে পাতা উল্টে দেখলো আবছা হয়ে যাওয়া ফাউন্টেন পেনের নীল কালিতে লেখা রয়েছে :
সমুর দশ বছরের জন্মদিনে সানন্দ উপহার ।
আশীর্বাদক বাবা ।
তারিখ : ১৬/০৫/১৯৮৪ ।
অর্থাৎ সাইত্রিশ বছর আগের কথা ।
পৃষ্ঠা গুলো সব লালচে ও মুড়মুড়ে হয়ে গেছে কিন্তু এই বই কে ঘিরে স্মৃতি রয়ে গেছে অমলিন । সুমিত্রা কে কাছে ডেকে বলল
– এই দেখ বুড়ি কি অমূল্য সম্পদ উদ্ধার করেছি ।
পুকুলি সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল ।
– কৈ কৈ দেখি !
– পড় কি লেখা আছে ?
– হাস্যকৌতুক , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । এটা কিসের বই গো বাবা ?
– ইউরোপীয় শারাড্ । বাংলায় বললে হেঁয়ালি নাট্য ।
– মানে কি ?
– খেলার ছলে মুখে মুখে বানানো ছোট্ট ছোট্ট নাটক । দুই তিন কি চার জনে মিলে অভিনয় করবে এমন । যে কোনো একটা শব্দ বেছে নিতে হবে প্রথমে । ধরা যাক ‘পাগল’ । নাটকের মধ্যে সংলাপে মাঝে মাঝেই সেটা ঘুরে ফিরে আসবে । কখনো পুরোটা আবার কখনো ভাঙ্গা ভাঙ্গা । যেমন ‘পা’ অথবা ‘গোল’ । বাকী যারা দেখবে শুনবে শেষ হলে তাদের বলতে হবে লুকোনো শব্দটা কি ? না বলতে পারলে যারা অ্যাক্টিং করলো তাদের হার । কেমন আইডিয়া বলতো ?
– দারুন , ফ্যান্টাস্টিক !
– হুম্ প্রায় সোয়াশ বছর আগে লেখা , বুঝলি ?
– হোয়াট ইজ ‘সোয়াশ’ ?
– একশ পঁচিশ , হান্ড্রেড টোয়েন্টি ফাইভ । তবে এটা একশ চৌদ্দ বছর আগের ।
– গট ইট । তার মানে নাইন্টিন জিরো ফাইভ , তাই তো ।
– ভেরি গুড । সেই বছরই কুচক্রী লর্ড কার্জনের বাংলা ভাগ করার অপচেষ্টা রুখে দিয়েছিলেন এই স্থিতপ্রাজ্ঞ মানুষটি । তোরা যে টিভিতে এতো কমেডি শো , লাফটার শো এসব গিলিস ; এই বই হলো সে সবের বাবার বাবার বাবার বাবা , বুঝলি ?
– ও ব্বাবা ! তাই নাকি ?
– হুম্ এই জানবি , এতো কোনো অভভ্যতা নেই , কাতুকুতু দিয়ে জোর করে হাসাবার চেষ্টা নেই , ভাঁড়ামো করা নেই । আছে বুদ্ধির খেলা , এ হলো বিশুদ্ধ ও নির্মল হাস্যরস ।
– সেতো বুঝলাম , এবার বলো তুমি হঠাৎ এটা বের করলে কেনো ?
সুমেরু উদাস মেদুর কণ্ঠে বলে
– ছেলেবেলায় আমাদের দেশের বাড়ী করঞ্জলিতে প্রতি বছর আমরা রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে দারুন উৎসবের আয়োজন করতাম । বসতবাড়ীর বাইরে যে দরদালান সেখানে হতো কবি প্রণাম অনুষ্ঠান । আমরা খুড়তুতো জ্যাঠতুত ভাই বোনেরা মিলে নাচ গান আবৃত্তি নাটক সব কিছু করতাম । ওহ্ সে এক দুর্দান্ত ব্যাপার । হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড ! শুধু আমাদের গ্রাম নয় আসে পাশের গ্রাম থেকেও লোকজন ভিড় করে দেখতে আসতো বুঝলি ?
– করঞ্জলি কোথায় বাবা ?
– সাউথ টোয়েন্টি ফোর পর্গনাস । তুই যখন খুব ছোট ছিলিস , এই এইটুকু পুঁটলির মতো , তখন তোর মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে গিয়েছিলিস একবার তাই তোর মনে নেই । সব ঝড়ঝঞ্ঝা কেটে যাক আবার যাবো তোদের নিয়ে ।
– সেখানে এখন কারা থাকে ?
যারা ছিলো বরাবর তারাই আছে । আমার দাদা ভাই তাদের বৌ ছেলেমেয়ে সবাই । তাদের নিয়েই তো হবে আমাদের আজকের ভার্চুয়াল রবীন্দ্রজয়ন্তী !
– রিয়েল ? ওয়াও গ্রেট !
– এই দেখ বইতে মোট পনেরটা শটস্কিট আছে । টানা বছর সাতেক প্রোগ্রাম করেছিলাম আমরা ।
– তারপর ?
– তারপর আর কি এইচ এস পাশ করে করঞ্জলির পাট চুকিয়ে দিয়ে আমি কলকাতায় চলে এলাম । মানে আমি একা নয় , আমাদের ফ্যামেলী । ব্যাস সব বন্ধ হয়ে গেলো ।
– তুমি এই বই কোথায় পেলে বাবা ?
– উপহার , কে দিয়েছিলো আন্দাজ কর তো ?
– নো আইডিয়া , তুমি বলো !
– তোর ঠাকুরদা মহাশয় , অর্থাৎ আমার পিতৃদেব স্বয়ং ।
পুকুলিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুমেরু আবার বলে
– কিরে , ঘেবড়ে গেলি মনে হচ্ছে ? ওরে তোর দাদু মানে আমার বাবা । যিনি আমার আর তোর মায়ের নাম জুড়ে দিয়ে তোর নামকরণ করেছিলেন । আর তোকে প্রথমবার দেখেই বলেছিলেন “ওয়ান ডে শী উইল বার্ন দ্য ফেস ওফ্ আওয়ার কান্ট্রি ।”
– মানে ?
– মানে একদিন এই মেয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে । হা হা হা …
পুকুলিও অনুমান করতে পারে যে তার বাবা ইচ্ছে করেই বিদঘুটে ইংরেজি বলে রসিকতা করছে । তাই সেও মুখে হাত চাপা দিয়ে খিক খিক করে হাসে ।
চিত্রা এতক্ষন গৃহস্থালির কাজ সারছিল আর মধ্যে মধ্যে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখছিল কি চলছে ! বাপ-বেটির আলোচনা সবটাই তার কানে গেছে । এবার সে কাছে এগিয়ে এসে বলল
– এই যে খুব তো ফিল্মি ডায়লগ আওড়ানো হচ্ছে , তা তোমার মতলবটা কি খুলে বলতো ? দু’জনের কি ষড়যন্ত্র হচ্ছে শুনি ?
– যা হচ্ছে তাতে তোমারও পূর্ন সহযোগিতা বিশেষ প্রয়োজন হে দেবী । তুমি বিনা যে কিছুই সম্ভব নয় । এই পরিকল্পনার স্বার্থক রূপদান করতে আমরা পিতাপুত্রী তোমার স্মরণাপন্ন হলাম ।
– তুমি কি পাগল হলে ? বুড়ো বয়সে লোক হাসাবে নাকি ?
– এক্সাক্টলি , রাইট ইউ আর । রবিঠাকুর তো ঠিক এটাই চেয়েছেন । শোনো দাড়ি বুড়ো কি লিখেছেন ; এই বলে সে বই হাতে তুলে নিয়ে পড়তে থাকে : ‘আমোদ-প্রমোদ করো’ এ কথা যে বলিতে হয় এই আশ্চর্য ! কিন্তু আমাদের দেশে একথাও বলা আবশ্যক । আমরা হৃদয় মনের সহিত আমোদ করিতে জানি না । আমাদের আমোদের মধ্যে প্রফুল্লতা নাই , উল্লাস নাই , উচ্ছ্বাস নাই । তাস পাশা দাবা পরনিন্দা ইহাতে হৃদয়ের শরীরের স্বাস্থ্য সম্পাদন করে না । এ সকল নিতান্তই বুড়োমি , কুনোমি , কুঁড়েমি । দায়ে পড়িয়া , কাজে পড়িয়া , ভাবনায় পড়িয়া সময়ের প্রভাবে আমরা তো সহজেই বুড়ো হইয়া পড়িতেছি , এজন্য কাহাকেও অধিক আয়োজন করিতে হয় না । ইহার উপরেও যদি খেলার সময় , আমোদের সময় , আমরা ইচ্ছা করিয়া বুড়োমির চর্চা করি , তবে যৌবনকে গলা টিপিয়া বধ করা হয় । যতদিন যৌবন থাকে ততোদিন উৎসাহ থাকে প্রতি মুহূর্তে হৃদয় বাড়িতে থাকে , নতুন নতুন ভাব নতুন নতুন জ্ঞান সহজে গ্রহণ করিতে পারি — নতুন কাজ করিতে অনিচ্ছা বোধ হয় না ।
বিশুদ্ধ আমোদ-প্রমোদ মাত্রকেই আমরা ছেলেমানুষি জ্ঞান করি — বিজ্ঞলোকের , কাজের লোকের পক্ষে সেগুলো নিতান্ত অযোগ্য বলিয়া বোধ হয় । কিন্তু ইহা আমরা বুঝি না যে যাহারা বাস্তবিক কাজ করিতে জানে তাহারাই আমোদ করিতে জানে । যাহারা কাজ করে না তাহারা আমোদও করে না ।
পড়া শেষ করে সুমেরু মিটমিট করে চিত্রার দিকে তাকিয়ে থাকে । এর একটাই অর্থ : এবার কি বলবে বলো ? চিত্রা কপট রাগ দেখিয়ে বলে
– যা ইচ্ছে হয় তাই করো । তুমি আগাগোড়া একটা আনপ্ল্যানড্ পার্সন । এই জন্য বসের কাছে নিয়মিত কথা শুনতে হয় ।
– সত্য বচন ম্যাডাম । সেটা অফিসে এবং বাড়ীতে উভয়ত ।
এরপর আর কথা বাড়ানো চলে না । রাগের ভাবটা ধরে রাখতে গিয়েও লাভ হয় না । ফিক করে হেসে ফেলে চিত্রা বলে
– আগে থেকে বলতে কি হয় বুঝিনা ! উঠলো বাই তো কটক যাই । বাপ বেটি মিলে ড্রইং রুমটা কি সাংঘাতিক অগোছালো করে রেখেছে । কত কাজ যে এখন বাকি , উফ্ আর পারি না বাপু ।
তবে মুখে যাই বলুক না কেন চিত্রা মনে মনে দারুন খুশি হয়েছে সেটা বলাই বাহুল্য । এই বোরডামের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার এর চাইতে ভালো আর কোনো উপায় হতেই পারে না । সুমেরু পরপর কয়েকটা কাজ সেরে ফেললো ।
এক নম্বর : করঞ্জলিতে গণ্ডা কতক ফোন করে সবাইকে কনফিডেন্সে নেওয়া ।
দুই নম্বর : নির্বাচিত হেঁয়ালিনাট্য গুলির মোবাইলে ছবি তুলে হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে পাঠিয়ে দেওয়া ।
তিন নম্বর : নিজের ও চিত্রার প্রোফাইল থেকে এফ বি পোষ্ট দেওয়া । সে লিখলো : বন্ধু আজ ঠিক সন্ধ্যা ছয়টায় আমরা লাইভে আসছি । আমরা অর্থাৎ বসু পরিবার , কসবা ও করঞ্জলি সম্মিলিত । উপলক্ষ্য কবি প্রণাম । আমাদের একান্ত নিজস্ব ঘরোয়া উদ্যোগ । সকল শুভানুধ্যায়ী ও রবীন্দ্র অনুরাগীকে পাশে পেতে চাই , ধন্যবাদ ।
ব্যাস আপাতত এই পর্যন্ত । এরপর চেঁচেছুলে মনুষ্য পদবাচ্য হয়ে উঠতে হবে । দিন তিনেকের না কমানো দাড়ি নিয়ে লাইভে আসতে চাইলে চিত্রা আর রক্ষে রাখবে না । চটপট স্নান খাওয়া সেরে নিজের স্ক্রীপ্ট গুলো ঝালিয়ে নিতে হবে । শুধু চিত্রা ও সুমিত্রা নয় সুমেরুর মা সত্তর ঊর্দ্ধা অর্চনাদেবী নিজে থেকেই সামিল হয়েছেন এই আনন্দযজ্ঞে । তিনিই পৌরহিত্য করবেন বলে স্থির হয়েছে ।
তিন ঘন্টার লাইভ হলো । এমন অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যাবে তা কল্পনার অতীত ! এতো ভিউজ , লাইক , কমেন্ট এর আগে কখনো হয়নি । সবাই এ্যাঙ্করের প্রশংসায় পঞ্চমুখ । সাবলীল ভাবে কথা বলে গেলেন বৃদ্ধা । সেই সঙ্গে মাঝে মাঝেই দু’এক ছত্র কবিতা যুক্ত হওয়ায় আলাদা মাত্রা যোগ হয়েছে । খালি গলায় শুধু তানপুরা হাতে নিয়ে চিত্রা একের পর এক গানে ভুবন ভরিয়ে তুললো । আর পুকুলি ? তার কথা যতো বলা যায় ততোই কম । মনের আনন্দে কি নাচটাই না নাচলো একরত্তি মেয়েটা ! এতটুকু ক্লান্তি নেই !
তবে সব কিছু কে ছাপিয়ে মুখ্য আকর্ষণ হয়ে উঠলো কৌতুক নাট্যাভিনয় , একথা অনস্বীকার্য । মোট তিনটে হেঁয়ালি নাট্য শ্রুতিনাটক রূপে উপস্থাপিত হয় যথাক্রমে : রোগীর বন্ধু , সূক্ষ্ণ বিচার এবং অভ্যর্থনা ।
অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর পুকুলি বাপের হাত চেপে ধরে জানতে চাইলো
– আগে বল তুমি আর তোমার গ্রামের ভাই ও দাদারা কি করে এতো দিন পর এতো ভালো অ্যাক্টিং করলে ?
– কেনো এতে অবাক হওয়ার কি আছে ? তুই নাচ করলি , তোর মা গান করলো ঠাম্মি কবিতা বললো তার বেলা ?
– সেটা তো আমাদের আগে থেকেই তোলা আছে ।
সুমেরু উত্তর দেওয়ার আগেই ঠাম্মি বললো
– ঐ নাটক গুলোও তোমার বাবার তোলা আছে । কোথায় জানো দিদিভাই ? এইখানে , হৃদয়ের মনিকোঠায় ।
এই বলে বুকের বাম দিকে হাত রাখলেন । তারপর ধীর শান্ত স্বরে বললেন
– দাদাইয়ের কথা তোমার মনে নেই ?
– হ্যাঁ আছে তো ।
– থাকবারই কথা , এই তো মাত্র বছর তিনেক আগে … । তিনি ছিলেন ছেলেদের দলের প্রাণ পুরুষ । তিনি যা শিখিয়ে গেছেন তা সারা জীবনেও ভোলবার নয় । যেমন আজ তোমার বাবার কাছ থেকে তুমি যা পেলে তা তোমার মনে থাকবে চিরকাল । কারণ কি জানো দিদিভাই যাকে কেন্দ্র করে এতো কাণ্ড তিনি স্বয়ং রবি ঠাকুর ।
সুমেরু বললো
– যে যাই বলুক না কেন নাচ গান আবৃত্তি সব ছাপিয়ে আমাদের নাটকের পারফরমেন্স ইজ বেস্ট । কমেন্টে সবাই তাই বলেছে ।
সঙ্গে সঙ্গে চিত্রা বললো
– ও আচ্ছা তাই বুঝি ? বেশ , ভেবেছিলাম রাত্রে লুচি ভাজবো । এবার লবোডঙ্কা ।
– লে হালুয়া ! একি গেরো ? সত্যি কথা বলার জো নেই ?
পুকুলি জোরে হি হি করে হাসছে । অর্চনা দেবী বললেন
– বেশ তো বৌমা পরোটাই হোক না হয় আজ । সব সময় অতো ভাজাভুজি খাওয়া ভালো নয় খোকা । আমি বরং ছানাবড়ার ডালনা করি । আমার দিদিভাই খুব ভালোবাসে তাই না ?
– ওহ্ ঠাম্মি তুমি গ্রেট !
এই বলে সে গলা জড়িয়ে ধরলো ।
তিনি বললেন
– রবীন্দ্রনাথ কটা উপন্যাস লিখেছেন জানো ?
– উপন্যাস কি ?
– অনেক অনেক বড় আয়তনের গপ্পো ।
– ও আচ্ছা । না ঠাম্মি জানি না । তুমি বলো ।
– মোট তেরোটা । আর বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন মোট চৌদ্দটা ।
– সেকি কবি গুরু একটা কম লিখছেন কেনো ?
– বঙ্কিম সাহিত্য সম্রাট কিনা তাই ওনার চাইতে একটা বেশি ।
– ও তাই ?
– হুম্ , ধরা যাক এবার তুমি রবীন্দ্রনাথ পড়া শুরু করবে । প্রথমেই কি পড়বে বলো ?
– তুমি বলো ।
– ডাকঘর পড়তে পারো , আবার ছেলেবেলা পড়তে পারো । রবীন্দ্রনাথ ভোজন রসিক ছিলেন জানো তো দিদিভাই ?
অর্চনাদেবী পুকুলিকে কোলে তুলে নিয়ে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালেন । কানে ভেসে আসছে তাঁর গলা … একটা ছড়া বলি শোনো :
আমস্বত্ত্ব দুধে ফেলি
তাহাতে কদলি দলি
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে
হাপুশ হুপুশ শব্দ
চারিদিক নিস্তব্ধ
পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে ।
চিত্রা এতক্ষণে সুমেরুর পাশে সোফায় এসে বসলো । জড়িয়ে নিলো তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় । সেন্টার টেবিলে রাখা চার দশকের পুরনো হাস্যকৌতুক বইয়ের পাতাগুলো ফরফর করে উড়ছে । সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পরম্পরার এক প্রবহমান ধারা যেনো চাক্ষুষ করা যায় । দুজনেই নির্বাক , নিষ্পলক চেয়ে আছে পরস্পরের দিকে ।