• Uncategorized
  • 0

সম্পাদিকা উবাচ

প্রতিবাদী বিশ্বের, নতুন স্বরায়ণের পঞ্চাশের অন্যতম কবি শঙ্খ ঘোষে ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বর্তমান বাংলাদেশের চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, কিশোর ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক এবং রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ।১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলো। ভারত-পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের মধ্যে আবার আরও কিছু ভাগাভাগির শিকার হলো, যেমন পাঞ্জাব ভেঙে হলো দুই টুকরা। এক টুকরা থাকল পাকিস্তানে, আরেক টুকরা ভারতে। পাঞ্জাবি ভাষা দুই অংশের পাঞ্জাবিদের জন্যই রয়ে গেছে। দেশভাগের ভেতর দিয়ে বাংলাও ভাগ হয়ে গেল। দুই বাংলাতেই মাতৃভাষা বাংলা। রাজনীতির বাটখারায় কত কী হয়! দেশভাগকেন্দ্রিক যত মানুষ এপার-ওপার হলো, শঙ্খ ঘোষের পরিবার তাদের একটি।
দীর্ঘ দিন বাঙালির সংস্কৃতিতে জীবন যাপন করেছেন যিনি, চান না চান যিনি আইকন হয়ে উঠেছেন প্রায়, তাঁকে নিয়ে কোনও কোনও বাঙালি যে শ্লেষ-পরায়ণ হবেন এ আর নতুন কথা কী ! তবে সত্যি কথা এই যে শঙ্খবাবু নিজের যে রীতি তৈরি করেছেন তা নিতান্ত বাইরের নয়। এ ভেতর থেকে গড়ে ওঠা। তা কারোর পছন্দ হতে পারে, নাও পারে। শঙ্খ ঘোষ তাঁর সমকালে বাঁচেন, কিন্তু সমকালের ফ্যাশনে ঢুকে পড়েন না। সেই ফ্যাশনের ছাঁচ থেকে নিজেকে সযত্নে সরিয়ে রাখতে জানতেন। এটাই তাঁর স্টাইল। এটা তিনি বজায় রাখতে পেরেছেন প্রথম থেকেই।
১৯৫৪ সাল। জানুয়ারি মাস। কলকাতার সেনেট হলে কবি সম্মেলন। দরজার সামনে দাঁড়ানো ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে নামী কবিদের কবিতা শুনছেন। কিন্তু ঠিক করে ফেলেছেন, মোটেই কবিতা পড়বেন না। অস্বস্তি হচ্ছে যে। ভিড় , মঞ্চ, অনুষ্ঠান কবি আর পাঠকের মাঝখানে যে কাঁপুনি তৈরি হয়, তা নষ্ট করে দেয় সব। তাই ঠিক করেছেন নামী কবিদের দেখে, তাঁদের বলা শুনেই পালাবেন। তাঁর নাম ডাকার আগেই চলে যাওয়া চাই।
ঘটল তার বিপরীত৷ সুভাষ মুখোপাধ্যায় দেখে ফেললেন, ইশারায় ডাকলেন। তরুণ কবি শঙ্খ ঘোষ ইশারাতেই তাঁর সুভাষদাকে ‘না’ বললেন। কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে ঠেকানো গেল না ! আসন ছেড়ে কবিকে ধরতে তিনি এগিয়ে এলেন। অগত্যা শঙ্খও বেরিয়ে পড়লেন পাশের মুরলীধর সেন লেনে। শুরু হল রোমহর্ষক লুকোচুরি খেলা কবির পেছনে কবি। শঙ্খের পিছনে সুভাষ। কিছুটা পশ্চিমে এগিয়ে শঙ্খ দেখেন তখনও পেছনে সুভাষদা, সমানে ধাওয়া করছেন। অগত্যা আর একটু দ্রুত পা এগিয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত তরুণ শঙ্খই জিতলে। পালাতে সক্ষম হলেন৷ সে দিনের সেই সেনেট হল নেই, সুভাষ মুখোপাধ্যায় নেই, তরুণ কবিদের লাজুকতা নেই আছে চার পাশে অজস্র সভা, আত্মপ্রকাশের আয়োজন, ফেসবুকের ছবি। তবে এখনও আছেন শঙ্খ ঘোষ আছেন তাঁর শব্দ ও নৈঃশব্দ্য নিয়ে আমাদের হৃদয়ে আমাদের জীবনে৷
বাঙালি ভদ্রলোকের বিশেষ কতগুলি বৈশিষ্ট্য তাঁর কথায়বার্তায় জীবনযাপনে মিশে গেছে তৈরি করেছে তাঁর নিজস্ব স্টাইল স্টেটমেন্ট৷
এককালে বাংলা কবিতায় বিষ্ণু দে-র অনুগামীদের বৈষ্ণব বলা হত, অনেকেই শঙ্খবাবুর স্টাইলকে কৌতুক করে ‘শঙ্খীয়’ বলেন। সেই বলার মধ্যে কৌতুক যেমন থাকে তেমনই কারও কারও উচ্চারণে থাকে শ্লেষ।
রবীন্দ্রনাথকে কী ভাবে পড়তে হবে তা প্রতি মুহূর্তে শেখান যিনি, সেই শঙ্খ ঘোষের “নির্বাচিত ভাষণমালা” বইয়ের প্রথম প্রবন্ধটিই (বা ভাষণ) রবীন্দ্রগান নিয়ে: “পুরোনো-সব বন্ধুরা মিলে পুনর্মিলনে বসা হলো একদিন, সন্ধ্যাবেলায়, বিদ্যুৎবিভ্রাটে সেদিন ঘর ছিল অন্ধকার।… এঁদের মধ্যে কেউ বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কাছে তিনি পান না কিছু! কেউ-বা বলেন, পড়েননি তিনি রবীন্দ্রনাথ।… যখন প্রস্তাব হলো গানের, অনিবার্যভাবে গলায় উঠে এল রবীন্দ্রনাথেরই গান।… সবারই গলায় একে একে গুন্‌গুনিয়ে উঠল সুর, রবীন্দ্রনাথেরই সুর:— সাম্প্রতিকের সঙ্গে তাঁর ঘোষিত ব্যবধান এক মুহূর্তে উড়ে গেল কোথায়।” রচনাটির মধ্যপর্বে মন্তব্য করেছেন তিনি: “রবীন্দ্রনাথের গান নিজেকে রচনা করে তুলবার গান। এ এক বিরামহীন আত্মজাগরণের আত্মদীক্ষার গান… ।”
যাদবপুর পর্বে তাঁর ছাত্ররা অনেকেই ‘দুর্দান্ত’ কবি। ছাত্রদের সেই বে-হিসেবিপনার অতিকথা খোশগল্প হয়ে ছড়ায়। প্রয়াত কবি জয়দেব বসু তাঁর খুবই প্রিয় ছাত্র। এই জয়দেব নাকি স্যার-কে মাঝে মাঝে খুবই জ্বালাতেন। একদিন নাকি সবাইকে ঘর থেকে বাইরে বের করে শঙ্খবাবুকে বলেছিলেন, স্যার একবার শালা বলুন। কেউ নেই, বলুন স্যার। এই গপ্পোকথা অনুযায়ী শিক্ষক শঙ্খবাবু তা বলেননি, মৃদু হেসেছিলেন।
জয়দেব নাকি আবডালে তাই বলতেন ‘শান্ত বড়ো স্বাভাবিক নয়’। শঙ্খ ঘোষের কবিতার পদ এই ভাবে যাদবপুরী জয়দেব নিজের মতো ‘পান’ করে (গিলে ফেলে) ব্যবহার করতেন। যাদবপুরের ঝিল , লবি, করিডর জানত শঙ্খবাবু তাঁর ছাত্রদের আশ্রয় দেন, প্রশ্রয়ও। কিন্তু নিজের স্টাইল বদল করে নয়।
তাঁকে অক্লেশে অনেক কথা বলা যায়, ছেলেমেয়েদের পারস্পরিক পেছনে লাগা তাঁর সামনেই ঘটানো যায়। তিনি মজাই পাবেন। অংশগ্রহণ করবেন না। চাইবেন তাঁর ছাত্ররা ভিন্ন রুচির অধিকার নিয়ে গলা ফাটাক কিন্তু মনান্তরে যেন না যায় । এটাই তো রুচির সমগ্রতা। তবু তাঁর ছাত্রদের মনান্তর হত। আর স্যার মন খারাপ করে কবিতায় লেখেন তাঁর প্রিয় অনুজদের কথা ,
‘কোনো কোনো রোববার সকালবেলায় মনে হয়
এই হয়তো এসে পৌঁছবে জয়দেব, আসবে তারাপদ
ওদের বনিবনাও হবে আবার’।
তাঁর বইয়ের ঘরে ছড়ানো ছেটানো বই, রোদ। তিনি জানেন স্বাধীনতা, দেশভাগ, অতিবাম আন্দোলন, বামেদের ক্ষমতা দখল, বাংলা মাধ্যম স্কুলের অবক্ষয়, দায়িত্বজ্ঞানহীন দাবির আস্ফালন, পরিবর্তন, পুঁজির বিশ্বায়নএ সবের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে বাঙালি জীবন। তিনি এই সব কিছুর ভেতরে শামিয়ানা খাটিয়ে জেগে ছিলেন। নিজের মতো করে বলেছেন, চুপ করে থেকেছেন। সমকালে থেকেও আরেক রকম জীবনের আদর্শ সাধারণ বাঙালির সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন।
ছন্দের মোহময় কারুকার্যে কবিতাকে তিনি করে তুলেছেন সুচারু এবং শৈল্পিক। কবির বিখ্যাত ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ তিন লেখেন—
‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্যে গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।’
(মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে/ শঙ্খ ঘোষ)
কবিতায় সংহত আবেগের আত্মমগ্ন কবিতা রচনা করলেও শঙ্খ ঘোষকে শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদী কবি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কবির প্রতিবাদ কখনো মৃদু, কখনো ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে উচ্চকিত। তিনি সময়ের দগদগে ক্ষত চিহ্নিত করেই কবিতা রচনায় ব্রতী হয়েছেন। কোচবিহারে খাদ্য-আন্দোলনের মিছিলের ওপর পুলিশের গুলি চালনার, কিশোরী হত্যার প্রতিবাদে শঙ্খ ঘোষকে লিখতে হয়েছিল :
‘নিভন্ত এই চুল্লিতে তবে
একটু আগুন দে।
হাতের শিরায় শিখার মতন
মরার আনন্দে।’
(যমুনাবতী/ শঙ্খ ঘোষ)
যমুনাবতী’ কবিতায় একদিকে উঠে এসেছে ব্যর্থ শাসক-শোষকের প্রতি কবির তীব্র ঘৃণা। আবার অন্যদিকে দৃঢ় প্রতিবাদও । শঙ্ঘ ঘোষের কবিতায় দুটি ধারা প্রবহমান। আলোচক ড. শিশির দাশের মতে, ‘একটি ব্যক্তিমুখী, এর নির্জনতা সন্ধানী ব্যক্তিসত্তার আত্মকথা, সংকেতময় ভাষায় ও প্রতিমায়, মৃদুকোমল ছন্দস্পর্শে অনুত্তেজিত কণ্ঠস্বরে এই কাব্যধারা বিশিষ্ট; অন্যধারাটি চারপাশের জগতের অসঙ্গতি, সমাজের বৈষম্য ও অমানবিকতার প্রতিক্রিয়ায় বিচলিত ও ক্রুদ্ধ এক ব্যক্তিমনের প্রতিবাদের ধারা, তা মূলত বিদ্রূপে ও ব্যঙ্গে, কখনো স্পষ্ট ও তীব্র, কখনো বেদনায় ও যন্ত্রণায় গভীর।’ শঙ্ঘ ঘোষের কবিতার বোধ বহুরৈখিক। তবে ভাষারীতি কথ্য। অর্থাত্ কবিতার ভাষা সরল হলেও ভাবটা জটিল এবং বহুমাত্রিক। সংবাদপত্রের একটি তথ্য দিয়ে তিনি রচনা করে-
প্রতিদিন ভোরের কাগজে
বর্বরতা শব্দ তার সনাতন অভিধার নিত্যনব প্রসারণ খোঁজে।
(কাগজ : জলই পাষাণ হয়ে আছে)
কবি শঙ্ঘ ঘোষ কবিতায় অলংকার প্রয়োগে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। নানান অনুষঙ্গে কবির অলংকারসমৃদ্ধ কয়েকটি পঙিক্ত তুলে ধরা যেতে পারে—
‘একমুঠো বাঁচবার মতো প্রাণ খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হই’ (খণ্ডিতা)
‘মনের মধ্যে ভাবনাগুলো ধুলোর মতো ছোটে
যে কথাটা বলব সেটা কাঁপতে থাকে ঠোঁটে’ (অন্যরাত)
‘তুমি প্রেয়সীর মতো ব্যথা তুলে তর্জনী তুলে শাসন তুলেছ—’ (পিলসুজ)
গবেষক তপোধীর ভট্টাচার্যের মতে, ‘রবীন্দ্রনাথপরবর্তী প্রজন্মে জীবন সম্পর্কে সংশয় ও অবসাদ যখন আধুনিকতার ক্ষয়িষ্ণু রূপ সর্বত্র প্রকট করে তুলছিল, সৃষ্টি ও মননের পথ হারিয়ে যাচ্ছিল আঁধিতে। পণ্যায়নপুষ্ট বিকারের সঙ্গে আপস-রফায় আবিল হয়ে যাচ্ছিল বাংলা সাহিত্য। সেই সন্ধিক্ষণে যিনি … নির্ভীক নন্দন-যোদ্ধা হিসেবে আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন আজও, তিনি শঙ্খ ঘোষ।’ (শঙ্খ ঘোষ : সৃষ্টি ও নির্মাণ)।
শতাধিক বইয়ের লেখক প্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সময় সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৭৭ সালে ‘বাবরের প্রার্থনা’ র জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেেমি পুরস্কার পান তিনি। পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার। ১৯৯৯ সালে কন্নঢ় ভাষায় লেখা নাটক অনুবাদের জন্য দ্বিতীয়বার সাহিত্য অ্যাকাডেমি সম্মান পান। ওই বছরই দেশিকোত্তম সম্মানে ভূষিত করা হয় তাঁকে। ভারত সরকারের তরফে কবিকে পদ্মভূষণ ও জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত, আপোষহীনতার মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন । তাই তো কবিকে বারে বারে সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে লড়তে দেখা গিয়েছে। কখনও কলমে, কখনও বা প্রতিবাদে সশরীরে সামমিল হয়ে। আর সেই সঙ্গে লালন করে গিয়েছেন তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কবিদেরকে।
তুমিই তো বলেছিলে “যেতে পারি তবে কেন যাব” তবে কেন কথা রাখলে না…
ঈশ্বরের অস্তিত্ব মুছে যাওয়ার নয়৷ তাঁর অস্তিত্ব সদা সর্বদা বিদ্যমান৷ তিনি যে বিশাল সাহিত্যের ভান্ডার রেখে গিয়েছেন আমাদের জন্য, তাকে আগলে রাখাই আমাদের পরম কর্তব্য এখন৷ আর আমরা তা নিজেদের তাগিদেই আগলে রাখব সারাটা জীবন ৷
প্রণাম জানাই ঈশ্বরের চরণে৷
পড়তে থাকুন৷ লিখতে থাকুন৷ সুস্থ থাকুন৷

রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।