সাপ্তাহিক গল্প নেই-তে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – ১৬

গল্প নেই – ১৬

তিনি চলে গেলেন। পৌঁছে গেলেন শঙ্খ ঘোষ থেকে এক অন্য আমিতে। যেখানে কারও ক্ষমতা হবে না এ কথা বলতে যে লোকটার নাম শঙ্খ রাখাটাই ভুল হয়েছে। অক্সিজেনহীন মাথা নাড়িয়ে বলতে পারবে না, ‘তুমি কেমন কবি? তুমি দেখতে পাও না?’
একথা শোনার পর নিশ্চয়ই কবির নিজের কবিতার কথা স্মরণ করে এই ভাবনা এসেছিল, ‘কি আমার পরিচয় মা?’
একটি শিশুর জন্মের পরে বাড়ির লোকজন অনেক ভাবনায় অনেক আদরে নাম রাখে। সেই নামকে ভুল বলার মতো ক্ষমতা নিয়ে যে পশ্চিমবঙ্গে একদিন এমন চেতাবনি দেবার মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটবে তা হয়ত বুঝতে পারেননি বাড়ির লোকেরা।
পরের কথা,‘তুমি কেমন কবি?দেখতে পাও না?’
যিনি বলেছেন তিনি জানেন না যে কবি দেখতে পান। সেইজন্যই তো যখন কোচবিহারে খাদ্যের দাবিতে মিছিলে নিহত হয় একটি মেয়ে,তখন তিনি শুধু দেখেন না বলেনও সেই সত্যের কথা।
কেননা তিনি মনে করতেন সত্যি বলা ছাড়া আর কোন কাজ নেই কবিতার।তাই তো মেয়েটি যমুনাবতী হয়ে বলে,‘নিভন্ত এই চুল্লিতে মা/একটু আগুন দে/আরেকটুকাল বেঁচেই থাকি বাঁচার আনন্দে।’
এক দশকে সংঘ ভেঙে যায় বলেছিলেন যে কবি তিনি দেখেছিলেন এর দশকের আগেই মানুষের স্বপ্নও ভেঙে যায়।তাই সত্যের কাছে দায়বদ্ধ কবিকে বলতেই হয়,‘দেখ খুলে তোর তিন নয়ন/রাস্তাজুড়ে খড়গ হাতে/ দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন’।
অমনি যেন আগুনে ঘি পড়ল।ইদানীং মহামারীর সময় যখন আমাদের সময় কাটছে আতঙ্কে। চিন্তাভাবনা বেসামাল। তখন তা আরও বেশি গুলিয়ে দেওয়ার কথা শুনতে হচ্ছে প্রতিনিয়তই। এমনকি অক্সিজেন নিয়েও।তখন বিনা অক্সিজেনের একটি মাথা যা খুশি তাই বলতেই পারে।এটাই স্বাভাবিক।এটাই কাম্য।
তাই বুঝি এত যে সব বুদ্ধিজীবী যাঁদের মন কোন কথায় মাথা নাড়বে তা এখন জনমানসে উপহাসের বিষয় হয়ে গিয়েছে, তাঁদের কণ্ঠে সেদিন কোন শব্দ শোনা যায়নি। সুবিধাভোগীদের এই এক সমস্যা।ইচ্ছে থাকলেও সব কথা বলা চলে না।
তখন দেখেছি অনেকে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল ফেসবুকের সেওয়ালে।তারা ছিঃ ছিঃ করেছেন।প্রতিবাদ করেছেন।সেই অর্থে এইসব মানুষদের আমজনতার অনেকেই চেনেন না।
শুনেছি অনেকের কাজ ছিল বিখ্যাত কবি লেখকদের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করা। আমার কখনো যাওয়ার কথা মনে হয়নি। তাঁদের প্রতি যে শ্রদ্ধা ছিল তা একলব্যের মতো। তবে এই একলব্য একটু অন্যরকম। যে কখনো নিজের বুড়ো আঙুল কেটে গুরুদক্ষিণা দেওয়ার কথা ভাবেনি।
তাই কবিবন্ধু উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায় যখন একটি পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছে প্রকাশ করল তখন নির্বাহী সম্পাদক হয়ে ওঁর সঙ্গে রইলাম। পত্রিকাটির নাম দেওয়া হল ‘অন্য একলব্য’।
বাংলা সাহিত্যে অসংখ্য লেখকের বিভিন্ন বিষয়ে অনেক লেখার কাছে আমি সবসময় নতজানু। তাই কোনো লেখককে গুরুর আসনে বসিয়েছি কেবলমাত্র তাঁর লেখার জন্যই। তিনি বয়সে আমার অনুজ হলেও।
লেখক হিসেবে কাউকে কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের তকমা দিয়ে চিহ্নিত করা যায় না।মনে আছে আমাকে অফিস লাইব্রেরি থেকে সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার বই নিতে দেখে একজন সহকর্মী বলেছিল ‘তুই আমাদের কবির কবিতার বই পড়বি?’
এই কথার কোন উত্তর হয় না।
যিনি যমুনাবতীর কথা লিখেছিলেন সেই শঙ্খ ঘোষ মরিচঝাঁপি বা নন্দীগ্রামের সময় চুপ করে থাকেননি।তার অর্থ এই নয় যে তাঁর মতো একজন কবি দলদাস হয়ে গেলেন।
যাঁরা এমন একচক্ষু বিশিষ্ট হয় বুঝি তাঁরা আসলে কবি ও মানুষ নয়।তাঁরা ওই একটি চোখ নিয়ে ছুটতে থাকেন সন্ধানে।কোথায় লোভনীয় মাসোহারা ও পুরস্কার পাওয়া যায়।
যখন শুনেছিলাম তুমি কেমন কবি? তখন কবির কণ্ঠে কোন প্রতিবাদ না শুনে খারাপ লেগেছে।ফলে একটা ভুল করেছি যাঁরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন,তাঁদের কারও কথার উত্তরে বলেছি,‘এটা নিজেদের মধ্যে একটু চড়াম চড়াম হয়েছে। এ নিয়ে আপনারা এত চিৎকার করছেন কেন?’
পরে একথা বলার জন্য নিজের ভিতরে ভিতরে অনুতপ্ত হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল এ কথা না বলাই উচিত ছিল। তিনি যে সত্যদ্রষ্টা। তাই বঞ্চিত মানুষের জন্য তার কলম গর্জে উঠলেও নিজের বিষয়ে নিরুত্তাপ। এমনই তো হওয়া উচিত।
এ জীবনে কত কিছু শেখার বাকি রয়ে গেল। আমি তো তাঁর বাড়িতে যাব না। তবে আমি যে একটা অন্যায়বোধ নিয়ে ছটফট করছি কি করে এর হাত থেকে রেহাই পাব?
সুযোগ হল একদিন। মদনমোহন অগ্রবালের শতবর্ষ পালনের অনুষ্ঠানে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেলাম হিন্দি ভাষার পঞ্চাশ দশকের কবি ‘নওয়াল’জীর কাছ থেকে।
গেলাম ভারতীয় ভাষাপরিষদে।তিনি আমাকে সামনের সারিতে নিয়ে বসালেন। একটু পরেই দেখি শঙ্খ ঘোষ এসে বসলেন আমার পাশের খালি চেয়ারটিতে।
এই সুযোগ। আমি প্রণাম করতে গেলাম।তিনি আমার হাত দুটো ধরলেন।
তবু জোর করে প্রণাম করলাম। মনে মনে বললাম,‘আমাকে ক্ষমা করুন।’
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।