• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অসিত কর্মকার (পর্ব – ১৭)

যুদ্ধ যুদ্ধ

সতেরো

প্রায়শ্চিত্তের সব আয়োজন সারা।
মানুষটার পেশ করা ফর্দ অনুযায়ি সবকিছু কেনাকাটা হয়েছে। ব্যবস্থাও করা হয়েছে যথাযথ। এসবে এতটুকু কার্পণ্য আর ত্রুটি রাখেনি মুকুন্দ পোদ্দার। এক লপ্তে এতগুলা মানুষকে স্বধর্মে ফিরিয়ে আনা চাট্টিখানি কৃতিত্ব নয় মনে করে মুকুন্দ পোদ্দার। আর পাঁচজনের প্রশংসা আর সাধুবাদ তাকে উদ্বুদ্ধ করছে অহং এর দাবিদার হতে। তার আত্ম অহংকার প্রকাশের আরও একটা বড় কারণ হল, এতবড় আয়োজনের পুরো টাকাটাই ধরতে গেলে তারই দেওয়া। হিসেব কষে এগোচ্ছে মুকুন্দ পোদ্দার। এতগুলো মানুষকে স্বধর্মে ফেরাতে পারায় তার মনে আশার আলো, তার সমর্থিত রাজনৈতিক দল সামনের নির্বাচনে সলিড এতগুলো ভোট পাচ্ছেই। সামনের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে পাখির চোখ করে ঘুঁটি সাজাচ্ছে সে। নিজের দেশ, ভিটেমাটি হারানোর যন্ত্রণা, দুঃখকষ্ট তার বুকের ভেতর যেমন গাঁথা হয়ে আছে তেমনি এই রুইদাসপাড়ার মানুষগুলোর মনেও আছে। বিশেষ করে বয়স্ক দয়াল আর দশমীবুড়ির মনে। এই মানুষগুলোর মন অতীতচারী করে তুলতে চায় মুকুন্দ পোদ্দার। যে প্রতিশোধ নেওয়া হয়নি, যে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা যায়নি, যে কষ্টযণ্ত্রণা মন থেকে চিরদিনের জন্য উপড়ে ফেলা যায়নি, শুধু সময়ের ধর্ম মেনে ছাইচাপা আগুন হয়ে আছে তাকে উস্কে দিতে হবে। সে কাজে দয়াল আর দশমীবুড়ি হবে তার তুরুপের তাস। আর ওই পাড়ার যারা এপারের মাটিতে জন্মেছে তাদের ওপার সম্পর্কে বাপঠাকুর্দার মুখে শোনা ভাষা ভাষা জ্ঞান, কিংবা আদৌ কোনও ধারণা নেই। হৃদয়ের টান তো দূরের কথা। এসবই ওদের মনে জাগিয়ে তুলতে হবে। তবেই না স্বধর্মের প্রচার প্রসার এদেশের মাটিতে আরও বেশি করে বিস্তৃত হবে। স্বপ্ন দেখে মুকুন্দ পোদ্দার, খন্ডিত দেশ আবার জোড়া লাগবে। অখন্ড সোনার বাংলা হবে। আর তার ক্ষমতায় থাকবে তার প্রিয় রাজনৈতিক দল। সেই সুদিন আনায় তারও যে কিঞ্চিৎ হলেও অবদান থাকবে তা ভেবেই ইদানিং বড় সুখ অনুভব করছে মুকুন্দ পোদ্দার।তবে সে মনে মনে এই গোঁসাইমানুষটাকেও ধন্যবাদ দেয়। এই মানুষটা উদ্যোগী না হলে এতবড় একটা মহৎ কাজ হয়ত কোনও দিনই সম্পন্ন করা হত না। এভাবেও যে ধর্ম খোয়ানো মানুষগুলোকে ফের স্বধর্মে ফেরানো যায় সেটাই তো জানত না মুকুন্দ পোদ্দার! হোক না তা গোঁসাইমানুষটার মনগড়া প্রায়শ্চিত্তের বিধান। মনে মনে বিদ্রুপের হাসি হেসে মুকুন্দ পোদ্দার ভাবে, এই পান্ডববর্জিত ম্লেচ্ছদের দেশে কে এমন ধর্মের ধ্বজাধারী আছে যে এই গোঁসাইমানুষটার বিরোধিতা করবে!তাছাড়া এসব ছোটলোকদের ধর্ম অধর্ম নিয়ে কে আর অত মাথা ঘামাতে যাচ্ছে! স্বধর্মে ফিরতে পেরে পরকালের নরকবাস থেকে মুক্তি দেওয়া হল, ঘরও দেওয়া হল মানুষগুলোকে, বিনিময়ে আনুগত্য হিসেবে ভোটগুলো চাই। এটাই তো পরিষ্কার হিসেব!
রুইদাসদের নয়াবসতির বাইরের ছোট্ট একফালি জায়গায় চাঁদোয়া টানিয়ে হরিনাম সংকীর্তনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সঙ্গে গীতাপাঠ। বেদিতে মালাচন্দনে সাজানো যত দেবদেবির ফটো আর মূর্তি। রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি সকলের নজর টানছে। পাড়ার সবাই খুব ব্যস্তসমস্ত। দয়াল আর দশমীবুড়ি সদা সজাগ, যেন কোথাও কোনওরকম ভুলত্রুটি না ঘটে। মানুষটার নির্দেশ মতো সবকিছু যেন ঠিকঠাক সুসম্পন্ন হয়।
ভোর থেকে কীর্তন আর ধর্মগ্রন্থপাঠের সঙ্গে মানুষটার নানা মন্ত্র উচ্চারণে নদীর পার মুখরিত। একটু বেলা বাড়তে সেখানে মুকুন্দ পোদ্দার সপার্ষদ হাজির। হাজির পুলিশও। পাঁচ গ্রামের কিছু গন্যমান্য ব্যক্তি আর সাধারণ মানুষও উপস্থিত। এই সাধারণ মানুষগুলোর মধ্যে গুঞ্জন উঠছে, এভাবে স্বধর্মে ফেরা যায় কিনা তা নিয়ে। অনেকে বলছে, এটা স্রেফ বেইমানি করা হল। অনেকে ছোটলোকদের কারবার বলে বিদ্রুপ করছে। কিন্তু ওরা বিরোধিতায় সরব হচ্ছে না। সেই মনের জোর বা সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রয়াস ওদের মধ্যে নেই। নিতান্তই সাধারণ ওরা। দেনা আর দারিদ্রে জর্জরিত জীবন ওদের। মুকুন্দ পোদ্দারদের কাছে আজীবনের খাতক।
মানুষটার কথামত তিথি গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান মেনে বসতির মানুষগুলো দলবেঁধে নদীতে স্নান করে প্রায়শ্চিত্তকর্ম সম্পাদন শেষে নয়া বসতিতে নতুন করে জীবন শুরু করেছে।
একমাত্র পারু বাধা দিতে গিয়েও ব্যর্থ হল। গলার ক্রুশ সে খুলে ফেলতে চায়নি। গোময় গোমূত্র মুখে নিয়ে সে নিজেকে শুদ্ধ করতেও রাজি হয়নি। ক্রুশটা হাতে নিয়ে সে বলেছিল, এটাই আমার ধর্ম। আমি আমার ধর্ম নিয়ে এই পুরনো বসতিতেই থেকে যাব। তোমরা নতুন বসতির মানুষরা এসো না কোনওদিন এই বসতিতে।
পারুর কোনও কথাই মানা হল না। জোর করে তার গলা থেকে ক্রুশ খুলে নেওয়া হল। টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে নদী থেকে স্নান করিয়ে আনা হল। তারপর সবার সঙ্গে প্রায়শ্চিত্তকর্মে বসিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু কোনও মন্ত্র সে মুখ ফুটে উচ্চারণ করল না। মানুষটা বলেছিল, ঠিক আছে, ঠিক আছে, মনে মনে কইলেই হইব।
গোময় গোমূত্র একটু জিহ্বার ডগায় ছোঁয়াতেই হল তাকে। দয়াল আর তার বলবান ভাইয়েরা মিলে জোর করে পারুর কোমরে মানুষটার দেওয়া তাবিজটা পরিয়ে দিল। পারুর শত বাধা, প্রতিবাদ, চিৎকার সবই অখন্ড নামসংকীর্তনে ঢাকা পড়ে গেল।
ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে একদিন সকালে মিশনবাড়ির ফাদার গ্যাব্রিয়েল এলেন ওদের বসতিতে। দেখলেন, সব ঘরগুলো মহাশূন্য, ভাঙ্গাচোরা ।উঠোনের মাঝখানে প্রভু যীশুর মূর্তিটা একা দাঁড়িয়ে। ফাদারের সঙ্গে আসা লোকটি হাত উঁচিয়ে দয়ালদের জন্য তৈরি নতুন বসতি দেখিয়ে দিল। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে নতুন বসতির দিকে এগিয়ে চলল। বসতির কাছে এসে দাঁড়ালেন ফাদার গ্যাব্রিয়েল। ডাক দিলেন, দয়াল, ও দয়াল!
একটু বাদে দয়াল ধীর পায়ে বসতির বাইরে বেরিয়ে এল। একরাশ লজ্জা সংকোচ বিড়ম্বনা গ্রাস করেছে তাকে। শত চেষ্টা করেও সে ফাদারের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছে না। হাত দুটো বুকের কাছে জড়ো করে নিচু গলায় বলল,আপনি আমাদের ক্ষমা করুন ফাদার। আমরা আবার আমাদের ধর্ম ফিরে পেয়েছি। এতদিনের পাপের জীবন থেকে আমাদের মুক্তি ঘটেছে।
ইটস অল রাইট, ইটস অল রাইট, দয়াল। প্রভু যীশু তোমাদের মঙ্গল করুন। শান্ত উদার কন্ঠে বললেন ফাদার।
নদী আপন বেগে বয়ে চলেছে। ওপারে অনন্ত মাঠঘাট, সবুজের বিস্তার। সেদিকে তাকিয়ে থাকতেথাকতে মন উদাস হয়ে ওঠে ফাদারের।ভাবেন, কতই না বৈচিত্রময় এই পৃথিবী, এই মানবজীবন!

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *