• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায় (পর্ব – ৫)

গোলকচাঁপার গর্ভকেশর

অফিস যাওয়ার জন্য পার্কিং প্লেস থেকে গাড়িটাকে বার করতে গিয়ে আশিষের দৃষ্টিটা আজ বার বার দেবাঙ্গীর ফ্ল্যাটের দিকে চলে যাচ্ছিল। গতকাল ওকে দেখার পর থেকেই আশিষ একটু আনমনা হয়ে আছে। অনেক পুরোনো একটা বসন্তের আবছা হয়ে আসা দিনেরা হঠাৎ হঠাৎ এসে মনে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। সুখস্মৃতির মৃদুমন্দ বাতাসে বার বার অবশ হয়ে যাচ্ছে আশিষের মন; সারাক্ষন খালি রোমন্থন করতে চাইছে ফেলে আসা পড়ন্ত বিকেলে, নিঝুম সন্ধ্যায় দেবাঙ্গীর সাথে কাটানো ঘনিষ্ঠ মুহুর্তগুলোকে। আশিষের মন ফিরে যেতে চাইছে সেই প্রথম প্রেমের বসন্তে। কিছুক্ষন একলা থেকে মনের মণিকোঠায় বেঁধে রাখতে চাইছে দেবাঙ্গীকে। কিন্তু চাইলেই তো আর সবকিছু পাওয়া যায় না। এই যেমন অনেক চাওয়ার পরেও পরিস্থিতির চাপে দেবাঙ্গীকে একান্ত আপন করে পাওয়া হল না।
বারান্দায় বেশিক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলে পাছে মায়ের জেরার মুখে পড়তে হয় তাই গত সন্ধ্যায় বেডরুমে ঢুকে লাইট অফ করে চুপচাপ জানালার পাশে বসেছিল আশিষ। ভেবেছিল এভাবেই সন্ধ্যাটা কাটিয়ে দেবে। কিন্তু ওর ডানপিটে ছেলেমেয়ে দুটো বার বার এসে বিরক্ত করেছে, বিশেষ করে মেয়েটা। ওর তিন বছরের মেয়ে খুশি যেমন দুষ্টু তেমনই ওর খুব ন্যাওটা। অন্যান্য ছুটির দিনগুলোতে ওরা বাইরে কোথাও বেড়াতে যায়, অনেক সময় একেবারে ডিনার করে ফেরে। তবে এখন আর তার উপায় নেই, চৌপাট্টির চা দোকান থেকে ফাইভ-স্টার হোটেল, সবই এখন কিছুদিনের জন্য পুরোপুরি বন্ধ। অগত্যা, বাড়িতেই দামালপনা শুরু করেছে দুই ভাইবোন। ওদেরও কোনো দোষ দিয়ে লাভ নেই। সপ্তাহখানেক হয়ে গেল স্কুল বন্ধ, সুইমিং পুল বন্ধ। করোনার ভয়ে বাচ্চারা সবাই ঘরবন্দী। আশিষের ছেলে অর্নব তো ছোটবেলা থেকেই বেশ দুরন্ত; আজ হাত কাটছে তো কাল হাঁটু ছড়ে যাচ্ছে, একবার তো বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে নামতে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছিল। ভাগ্য ভালো ছিল তাই বেশি বিপত্তি হয়নি, তিনটে স্টিচ দিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পাওয়া গিয়েছিল। এখন দাদার পাল্লায় পড়ে খুশিও বেশ বদমায়েশ হয়ে গিয়েছে। ওদের সামলাতে গিয়ে আশিষের মায়ের একেবারে ‘নাকের জলে চোখের জলে’ অবস্থা। ছেলেমেয়েদুটোকে ছোটবেলা থেকে ওদের ঠাকুমা,দাদুই মানুষ করেছে। গর্ভে ধারন করা আর বুকের দুধ খাওয়ানো ছাড়া নম্রতাকে আর কিছুই করতে হয়নি।
দস্যিপনা করার জন্য এতক্ষন ছেলেমেয়েদের ওপর খুব রাগ হচ্ছিল আশিষের। এবার ওর সব রাগ গিয়ে পড়ল নম্রতার ওপর। আশিষের মতো একজন সুদর্শন, সুপুরুষ, ব্যাঙ্ক চাকুরের স্ত্রী হওয়ার কোনো যোগ্যতাই ছিল না নম্রতার। একে ওই শিকড়ে চেহারা, তার ওপর ভালো করে সাজগোজ করতেও জানে না। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরে নম্রতার ওই কালঘাম ছোটা ঘেমো চেহারাটা একেবারেই দেখতে ইচ্ছা করে না আশিষের।
অনেক দেখেশুনে তারপর আশিষের জন্য নম্রতাকে পছন্দ করেছিল শঙ্করলাল আর সবিতা। কারন একটাই, নম্রতার বাবা গোবিন্দলাল ওদের চাহিদামতো প্রচুর দহেজ দিতে এককথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল। গোবিন্দলালের এক ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়ে বড়, তাই পাত্রপক্ষের দাবিদাওয়া মেটাতে কোনো অসুবিধা নেই; মেয়েকে সুপাত্রে দান করতে দানসামগ্রী বাবদ যা খরচ হবে তা ছেলের বিয়েতে উসুল করে নেবে গোবিন্দলাল। ঠিক যেমন শঙ্করলাল ওর তিন মেয়ের বিয়ের যাবতীয় খরচ ছেলের বিয়ে দিয়ে উসুল করে নিতে চায়। আশিষও জানতো ওর ভবিতব্য, ওদের মতো ফ্যামিলিতে এটাই অলিখিত নিয়ম, আবহমান কাল ধরে এই নিয়মই সবাই পালন করে চলেছে; মেয়ের বিয়েতে যে টাকা বেরিয়ে গিয়েছে ছেলের বিয়েতে সেই টাকা আবার ঘরে ফিরে আসবে। তাই বাবা-মায়ের সাথে মুখ বুজে মেয়ে দেখতে চলে গিয়েছিল আশিষ।
ভারী সিল্কের শাড়ি আর হালকা কিছু গয়না পরে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল নম্রতা। জরিদার শাড়িটা ওর শরীরের খামতিগুলোকে আড়াল করে রেখেছিল তাই তখন ছিপছিপে নম্রতাকে দেখতে খুব একটা খারাপ লাগছিল না, তাছাড়া বয়সেও অনেকটাই ছোট ছিল আশিষের থেকে। তাই আশিষের না বলারও কোনো কারন ছিল না। কিন্তু সুহাগরাতে নম্রতাকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখার পর আশিষের মাথা ঘুরে গিয়েছিল; এ মেয়ে কি সুখ দেবে ওকে ? স্বামীকে সুখী করার মতো কোনো আয়োজনই তো নেই ওর শরীরে। আশিষ মুখ ফুটে কিছু না বললেও ওর হাবভাব দেখে নম্রতা সবই বুঝতে পেরেছিল। তাই কিছুদিনের মধ্যেই স্বামীকে সুখী করার বৃথা চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে উঠেপড়ে লেগেছিল শ্বশুর,শাশুড়িকে খুশি করতে। তার ফলও পেয়েছে হাতে হাতে। শঙ্করলাল আর সবিতা এখন পুত্রবধূকে চোখে হারায়। চিরকালের জাঁদরেল সবিতা, যে এতদিন রিং-মাষ্টারের মতো পুরো সংসারটাকে কন্ট্রোল করতো, যার এক কথায় শঙ্করলালের মতো বাঘের বাচ্চাও ভয়ে মেনি বেড়াল হয়ে যেতো সেই সবিতাই এখন স্বেচ্ছায় সংসারের সব দায়িত্ব নম্রতার হাতে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে অবসরযাপন করছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশিষ। বাবা-মায়ের মন রাখতে গিয়ে নিজের জীবনের সব সুখশান্তি জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে ওকে। আজ সে সব ভেবে বড্ড আফশোষ হচ্ছে ওর। নম্রতার জায়গায় দেবাঙ্গী থাকলে ওর জীবনটা একেবারে অন্যরকম হোতো।
“হ্যালো আশিষ, হাউ আর ইউ?”, ডাঃ, গোড়বোলের কুশলপ্রশ্নে গতসন্ধ্যার স্মৃতিতে চিড় ধরল আশিষের। হাত নেড়ে নিজের সুস্থতার বার্তা দিল আশিষ। সৌজন্যের হাসি হেসে ডাঃ, গোড়বোলে এগিয়ে চললেন গেটের দিকে। আশিষের চোখ আবার চলে গেল দেবাঙ্গীর ব্যালকনির দিকে। গ্রিলের গায়ে দেবাঙ্গীর অর্ন্তবাস, ভিজে জামাকাপড় আর বারান্দার কোণে চীনেমাটির গামলায় ঘন সবুজ তুলসীগাছ। মঞ্জরীর ভারে ঈষৎ নুয়ে পড়া গাছটাকে দেখে মনে হচ্ছে সদ্যস্নাত। দেবাঙ্গী নিশ্চয় স্নানের পর তুলসীগাছে জল দিয়েছে। আর একটু আগে এলেই দেবাঙ্গীর দেখা পেতো আশিষ।
“এনি প্রবলেম ?”, আবার ডাঃ, গোড়বোলের প্রশ্ন। এতো তাড়াতাড়ি হাঁটে এই বুড়ো লোকটা ! এরই মধ্যে মেন-গেটের কাছ পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এলো !
কথা না বাড়িয়ে, অল্প হেসে গাড়িতে উঠে বসল আশিষ। মনে মনে ঠিক করল কাল থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়বে ঘর থেকে। এই পার্কিং প্লেসেই অপেক্ষা করবে দেবাঙ্গীর জন্য। হয়তো দেবাঙ্গীও এখনও অপেক্ষা করে আছে ওর জন্য, হয়তো ওর কথা ভেবেই এখনও বিয়ে করেনি।
ফুরফুরে মনে গাড়িতে স্টার্ট দিল আশিষ। অপেক্ষা শুধু একটা গ্রীন সিগন্যালের। একবার সবুজ আলো দেখতে পেলেই হয়, তারপর গন্তব্যে পৌঁছাতে আর খুব বেশি সময় লাগবে না আশিষের।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।