• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৯)

আমার কথা 

৩৩
আসল কথাটা হল গরিব মানুষের মুক্তির লড়াই। মুক্তি কিসের থেকে? দারিদ্র্যের থেকে। যত না আর্থিক দারিদ্র্য, তার অনেক বেশি চিন্তার দারিদ্র্য। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম মুক্তি বলতে বুঝেছিলেন রামা কৈবর্ত ও হাসিম শেখের মুক্তি। গরিব হিন্দু আর গরিব মুসলমান কে এক ব্র্যাকেটে রেখে তিনি দেখিয়েছিলেন আলাদা করে হিন্দু ও মুসলমান এর মুক্তি নেই। গরিব মানুষের জাত পাতের গন্ডি ভাঙা লড়াই নতুন দিন আনবে। বঙ্কিম তো বললেন। আমরা শুনবো কি?
৩৪
ওই যে আমাদের রবীন্দ্রনাথ বলে বসেন আমরা নই বাঁধা নই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে। ত্রাসের দাসত্বের কথা বলেন। এই ত্রাসের কথাটা অনেক ভাবে মনে করান। বলেন ভয় আমি পাব না। আমি ভয় করব না। বলেন বিপদে আমি না যেন করি ভয়। সুতরাং ভয়ের আবহ কিন্তু আছেই। কিন্তু ভয়কে জয় করার চেষ্টায় ওঁর লেগে থাকা। একেবারে শেষের দিকের কবিতায় ভয় দেখানো মুখটাকে মুখোশ বলবেন।
এই ভয় থেকে উত্তীর্ণ একটা জগতের স্বপ্ন দেখে রবীন্দ্র সাহিত্যের চরিত্র গুলোও। ভয় দেখানোর বাস্তবতা থাকে। আবার তার থেকে উত্তরণের লড়াইটাও থাকে।
নিকোলাস কোপার্নিকাস ( 1473 – 1543) ওই ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর বইতে যে কথা লিখবেন, তা না লিখে তিনি সরে যান নি। কিন্তু বইটা প্রকাশ করলেন নিজের মৃত্যু শয্যায়। যাতে ভেতরের কথাগুলো চাউর হবার পর ভয় দেখানো মালিক তাঁর টিকির খোঁজ না পায়। তিনি পৃথিবীকে গোল আর চলনশীল দেখালেন। বললেন সূর্য কেন্দ্রিক বিশ্বের কথা। বই বের হয়ে গেলে কোপার্নিকাস আর শরীরে নেই। ভয় দেখানোর মালিক তখন কাকে আর সাজা দেবে?
৩৫
গালিলিও গালিলেই ( 15.2.1564 – 08.01.1642) ছিলেন উঁচু দরের বিজ্ঞানী । হান্স লিপারসে নামে এক চশমা শিল্পী একটা নলের দুপাশে দুটো লেন্স লাগিয়ে দূরের জিনিসকে কাছে দেখার খেলনা তৈরি করেছেন শুনে তিনি নিজেই লেন্স এর ফোকাস দূরত্ব বিষয়ক অঙ্ক কষে টেলিস্কোপ বা দূরবীন বানান। আর সেই দূরবীনে আকাশ দেখা তাঁকে পেয়ে বসে। তিনি দেখতেন গ্রহ নক্ষত্রের চলন। দেখতেন আর সেই নিয়ে অঙ্ক কষতেন।
সেই সময় চালু ধারণা ছিল যে পৃথিবী স্থির আর সূর্য তার চার দিকে ঘুরছে। এর বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে অনেক কথা বলা হলেও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ পৃথিবীর নিশ্চলতার পক্ষে ছিলেন বলে, অনেক বোদ্ধা ব্যক্তিও সব বুঝে শেষমেশ পৃথিবীকে দাঁড় করিয়ে, অন্য সকল গ্রহ নক্ষত্রকে তার চার দিকে ছুটিয়ে মারতেন। চার্চের ভয়ে, আর পিঠের চামড়া বাঁচাবার দায়ে এ কাজ তাদের করতে হত।
নিকোলাস কোপারনিকাস ছিলেন বিজ্ঞানের অধ্যাপক। ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৪৭৩ সালে তিনি জন্মেছিলেন, আর ১৫৪৩ এর ২৪ মে তারিখে তিনি মারা যান।
নিকোলাস কোপারনিকাস বুঝতে পেরেছিলেন যে পৃথিবী স্থির আর সূর্য তার চার দিকে ঘুরছে, এই মতটা একেবারে ভুলভাল। একেবারেই অন্তঃসারশূন্য। কিন্তু সেটা স্পষ্ট ভাবে সোজা সরল ভাষায় পাঁচ জনের সামনে বুঝিয়ে বলার জমানা ছিল না। তাই চার্চের কোপের ভয়ে, উৎপীড়িত হবার ভয়ে, কোপারনিকাস তার দীর্ঘ গবেষণাসঞ্জাত উপলব্ধি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন একেবারে নিজের মৃত্যু শয্যায়। সে বইয়ের নাম দ্য রেভোল্যুশনিবাস অরবিয়াম কোয়েলেস্টিইয়াম De revolutionibus orbium coelestium (On the Revolutions of the Celestial Spheres), । সেই বইএর কপি গিয়ে পড়েছিল এক পাদ্রি সাহেব জিওর্দানো ব্রুনোর ( 1548 – 1600) হাতে। তিনি সেই বই পড়ে নিশ্চিত হলেন যে সূর্যকে ঘিরেই পৃথিবী ঘুরছে। আর সেই কথা তিনি প্রকাশ্যে বলা শুরু করে দিলেন। চার্চ জিওর্দানো ব্রুনোকে ধর্মদ্রোহী বিবেচনা করে প্রাণদণ্ড দেন। পাদ্রি সাহেবকে খুঁটিতে বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। মারার আগে তাঁর জিভ কেটে নেওয়া হয়ে ছিল যাতে পুড়তে পুড়তেও উপস্থিত জনতার সামনে বৈজ্ঞানিক সত্য প্রকাশ করে দিতে না পারেন।
গ্যালিলিও দেখতে পেয়েছিলেন বৃহস্পতি গ্রহকে ঘিরে তার উপগ্রহ গুলি ঘুরছে । প্রথম দিন তিনি তিনটি উপগ্রহ দেখেন। সেগুলির নাম ইউরোপা, আইও আর ক্যালিস্টো। পরদিন তিনি দেখেন গ্যানিমিড, যেটি বৃহস্পতির সর্ব বৃহৎ উপগ্রহ।
গ্যালিলিও বিবেচনা করলেন যদি বৃহস্পতিকে ঘিরে তার চার চারটি উপগ্রহ ঘুরছে, এটা চোখে দেখা যায়, দেখানো যায়, তাহলে পৃথিবীই তাবৎ মহাবিশ্বের কেন্দ্রে এই কথা বলার যুক্তি কি? গ্যালিলিও পৃথিবীর গতিশীলতার সপক্ষে আর সূর্য কেন্দ্রিক চলনের সপক্ষে বললেন।
তাঁর বিরুদ্ধেও নেমে এল চার্চের আঘাত। কারাদণ্ড ।
৩৬
জিওর্দানো ব্রুনো ছিলেন পাদ্রি । কিন্তু মনে মনে তিনি ছিলেন খাঁটি বিজ্ঞানী । আর কিঞ্চিৎ একরোখা। যা মনে ভাবতেন, তা বলতে দ্বিধা করতেন না। কোপারনিকাস জানতেন পৃথিবী সূর্যের চার দিকে পাক খাচ্ছে, এমন কথা বললে ধর্মধ্বজীরা সেটাকে ভালো চোখে দেখবে না। চার্চের প্রতিশোধ স্পৃহাটি যে কেমন, তা সম্বন্ধে কোপারনিকাসের ভালোই ধারণা ছিল। ১৫৪৩ সালে কোপারনিকাসের মৃত্যু শয্যায় তাঁর গবেষণা সঞ্জাত উপলব্ধির কথায় সমৃদ্ধ পুস্তক দ্য রেভোল্যুশনিবাস অরবিয়াম কোয়েলেস্টিইয়াম De revolutionibus orbium coelestium (On the Revolutions of the Celestial Spheres), প্রকাশ পায়। নিকোলাস কোপারনিকাস ছিলেন বিজ্ঞানের অধ্যাপক। ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৪৭৩ সালে তিনি জন্মেছিলেন, আর ১৫৪৩ এর ২৪ মে তারিখে তিনি মারা যান। কোপারনিকাস যাতে চার্চের কোপানলে না পড়েন, তাই তিনি সাবধানতার বশে এই রেভোল্যুশনিবাস বইটি মৃত্যুকালে প্রকাশ করেন। রেভোল্যুশনিবাস বইটি কোপারনিকাস চার্চ এর বড় পাণ্ডাকে উৎসর্গ করেন। সেটাও কোপারনিকাসের হিসেবি চাল। রেভোল্যুশনিবাস যাতে নিষিদ্ধ না হয়, সেই কথা ভেবে তাঁকে এই কাজ করতে হয়েছিল। বইটি গিয়ে পড়ে জিওর্দানো ব্রুনোর ( 1548 – 1600) হাতে। তিনি রেভোল্যুশনিবাস পড়ে ধরে ফেলেন রেভোল্যুশনিবাস এ আসলে আগুন আছে। কোপারনিকাসের গবেষণা জিওর্দানো ব্রুনোর মনে ধরে ছিল। সে কথা তিনি প্রকাশ্যে বলায় চার্চ ব্রুনোকে মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞা দেয়। বিজ্ঞানী ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মারে। আর জিভ কেটে দেয়, যাতে মরতে মরতেও বিজ্ঞানী জন সমক্ষে সত্যভাষণ না করে যেতে পারেন।
কিন্তু এত করেও বিজ্ঞানের সত্যকে ঠেকানো যায় নি। সত্যকে ঠেকানো যায় না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।