সাপ্তাহিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ৪১
বিষয় – কনকাঞ্জলি / কালবৈশাখী
হাহাকার
পাগলিটা আকাশে কালো মেঘ দেখলেই আতঙ্কিত হয়ে ওঠে;
চিৎকার করে বলতে থাকে “ঝড় আসছে, বাজ পড়বে, সরে যাও,
সরে যাও।” বলতে বলতে ছুটে যায় জমির দিকে। দূরে জমিতে মানুষ
দেখলে হাত নাড়তে থাকে, আর চিৎকার করতে থাকে। এমনিতে
সারাদিন ধরে গ্রামের কোথায় কোথায় যে ঘুরে বেড়ায়; কখনও
গ্রামের হরিনাম তলার চাতালে, কখনও-বা গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তের
পাঁচুর চা-এর দোকানে। ওর গলা শুনে ছোটোরা হাসে, বয়স্করা এক
বুক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তাদের মনে পড়ে গ্রাম্য রমণী মালতীর কথা।
হরিদেবপুর গ্রামে স্বামী-পুত্র নিয়ে ছিল মালতীর সুখের সংসার।
কাঠা দশেকের একটা জমিই ছিল ওদের সম্বল। স্বামী চাষের কাজ
করে, আর ছেলে বাবাকে প্রয়োজন মতো সাহায্য করে। ছেলে সেবার
মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। লেখাপড়ায় মন্দ নয়। উচ্চমাধ্যমিক
পাশ করে কৃষি বিষয়ে পড়াশুনা করার স্বপ্ন ওর দু’চোখে। একরত্তি
ছেলে মা-বাবার নয়নের মণি।
তখন চৈত্র মাস চলছে, গ্রামের মাঠগুলো দিগন্তরেখা পর্যন্ত
সবুজ হয়ে আছে বোরোধান বুকে নিয়ে। জমির জল দেখা আর
নিড়ানির কাজ নিয়ে বাপে-ছেলেতে তখন জমিতে দাঁড়িয়ে। আর
কিছুটা বাকি, সেরে ঘরে ফিরবে। অপরাহ্নের আলো হঠাৎ করে
নিভে এলো, কোথা থেকে সারি সারি কালো মেঘ এসে হাজির হয়ে
গেল। সাথে সাথে প্রচণ্ড ঝড় আর বিদ্যুৎ চমকানি ! বছরের প্রথম
কালবৈশাখী তার সমস্ত জমানো শক্তি নিয়ে যেন উদ্যোত হয়েছে
মনের আক্রোশ মেটাতে! বাপ-ছেলেতে মিলে জমি থেকে তাড়াতাড়ি
উঠে আশ্রয় নিলো কিছুটা দূরের পাকুড় গাছটার নীচে। হঠাৎ তীব্র
আলোর ঝলকানি, সঙ্গে বিকট শব্দ! কেঁপে উঠল জমির মাটি ও
চারপাশ। গ্রামের মানুষ বলাবলি করলো কাছে-পিঠে কোথাও
বাজ পড়ল! সেদিন বাজ পড়েছিল সেই পাকুড় গাছটায়। বৃষ্টি থামার
পর উদ্বিগ্ন মালতী গ্রামের লোকজনকে ডেকে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে
এসেছিল স্বামী আর ছেলের খোঁজে। হ্যাঁ সে খুঁজে পেয়েছিল। খুঁজে
পেয়েছিল পাকুড় গাছটার নীচে দুটো আধপোড়া দেহ! বাজ পড়ে
নিথর হয়ে পড়েছিল তার নয়নের মণি আর একমাত্র অবলম্বন!
তারপর স্বামী-পুত্রহারা এক রমণীর করুণ কাহিনি।
প্রচণ্ড শোক আর আঘাতে মালতী হারিয়ে ফেলেছিল তার
স্বাভাবিক চেতনা। নিজের মনে খুঁজে চলেছে তার প্রিয় স্বামী
আর একরত্তি সন্তানকে। তাই কালবৈশাখীর কালো মেঘ দেখলে
মাথা ঠিক রাখতে পারে না মালতী । চিৎকার করে বলতে থাকে –
— “ঝড় আসছে, বাজ পড়বে, সরে যাও, সরে যাও!”