সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (ইতিহাস কথা পর্ব – ২১)
by
·
Published
· Updated
শ্রীরামপুরের কথা
বৃষপূর্ণিমার দিবা অপার আনন্দ কিবা
মাহেশে সুখের মহামেলা
স্নানযাত্রা প্রতি বর্ষে এই দিন মহা হর্ষে
মেলা পেয়ে করে সব খেলা
হারি মুচি যুগী জোলা কত বা সেখের জোলা
জাঁকে জাঁকে ঝাঁকে ঝাঁকে চলে
ঠেলাঠেলি চুলাচুলি কাঁকে কাঁকে ঝুলোঝুলি
লোকারণ্য জলে আর স্থলে
আগে পাছে পাকাপাকি আঁকা আঁকি তাকা তাকি
ঝাঁকা ঝাঁকি স্থান নাকি পায়
এসে বাড়ী যত রাড়ী কাঁকে করে ফেলে হাড়ি
হাতে পাখা কাঁঠাল মাথায়
ভদ্র যত মন শাদা পরস্পর করি চাঁদা
রুচির তরণী লয়ে ভাড়া
যাহাতে আসক্তি যাঁর সেই শক্তি সঙ্গে তার
গরবেতে গোঁপে দেয় চাড়া।।
…………….
মাহেশের বিখ্যাত রথের মেলা প্রসঙ্গে কবিতাটি লিখেছিলেন সেযুগের শক্তিশালী কবি ও সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। বিদ্যাসাগর যখন মেয়েদের স্কুল খোলবার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন প্রায় সমস্ত বাংলায়, তাঁর সাহায্যে ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন (লোকমুখে বেথুন সাহেব) যখন তৈরি করে ফেললেন আস্ত একখানা নারীশিক্ষার বিদ্যালয়, তখন সংবাদ প্রভাকর কাগজে রীতিমতো সমালোচনার ঝড় তুলেছিলেন গোঁড়া সনাতনপন্থী কবি ঈশ্বর গুপ্ত। প্রসঙ্গত বলি, বেথুন সাহেবের ইস্কুল নিয়ে তিনি লিখেছেন –
আগে মেয়েগুলো ছিল ভালো ব্রত ধর্ম কোর্তো সবে
একা বেথুন এসে শেষ করেছে আর কি তাদের তেমন পাবে
যত ছুঁড়িগুলো তুড়ী মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে
এ বি শিখে, বিবি সেজে বিলাতী বোল কবেই কবে
এখন আর কি তারা সাজী নিয়ে সাঁজ সেঁজোতির ব্রত গাবে
সব কাঁটাচামচে ধোরবে শেষে পিঁড়ি পেতে আর কি খাবে
আর কিছুদিন থাকলে বেঁচে পাবেই পাবেই দেখতে পাবে
এরা আপন হাতে হাঁকিয়ে বগী, গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে।
কিন্তু বাংলার সংস্কৃতি ও শিল্পধারা কবিতা আর ছড়ায় ফুটিয়ে তুলতে ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন অদ্বিতীয়। তাঁর কলমে তাই বারবার উঠে এসেছে শ্রীরামপুর তথা মাহেশের প্রসঙ্গ। বাংলার আবহমান ধারায় শ্রীরামপুর এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়। কী নেই সেখানে। আদ্যোপান্ত বাঙালীদের নিয়েই গড়ে ওঠা এক ইউরোপীয়ান একটি নগর। নবাব ও শেওড়াফুলীর রাজার হাত থেকে ড্যানিশ মালিকানা পার হয়ে শেষমেশ ইংরেজদের হাতে হস্তান্তর। প্রথম থেকেই একটু একটু করে বলে এসেছি সেই গল্প। কিন্তু যেটা এখনও বলব বলব করেও বলা হয়ে ওঠেনি তা হল স্বাধীনতা পূর্ব যুগে শ্রীরামপুরের স্বদেশী আন্দোলন। হ্যাঁ স্মৃতির সরণিগুলো দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা এবার এসে দাঁড়িয়েছি আধুনিক শ্রীরামপুরে। যেখানে আর ড্যানিশ উপনিবেশ নেই, কেরী সাহেব নেই, জন ম্যাক সাহেব নেই। আছে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ। নীল বিদ্রোহ আর সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকেই যেখানে সারা বাংলা জুড়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো ব্রিটিশবিরোধী আগুনের আঁচ, সেখানে কেরীর শহর আর বাদ যায় কি করে। বাদ যায়ও নি শ্রীরামপুর। প্রথমে বিখ্যাত আলিপুর ব্যোমা মামলার প্রসঙ্গ টেনে ইংরেজ রাজসাক্ষী নরেন গোঁসাইয়ের নাম না করলেই নয়। পুরো নাম নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী। শ্রীরামপুরে বনেদী গোস্বামী পরিবারের ছেলে নরেন প্রথম থেকেই ব্রিটিশবিরোধী। ইতিমধ্যে মজফফরপুরে অত্যাচারী অফিসার কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা করবার পরে কলকাতায় পুলিশের তীব্র খানাতল্লাশির পর একে একে গ্রেপ্তার হলেন অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র কানুনগো, উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়রা। জেলে বন্দী হলেন নরেন গোঁসাইও। কিন্তু ইংরেজদের তীব্র অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে শেষমেশ বিপ্লবী বন্দীদের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হতে রাজি হলেন নরেন। ইংরেজদের তীক্ষ্ণ নজরে বন্দী হন তিনি৷ খবর গেল বাকি বন্দী বিপ্লবীদের কাছেও। বিষয়টি ভালোভাবে নিলেন না তাঁরা। জেলেই তৈরি হল পরবর্তী পদক্ষেপ। নরেনকে হত্যা করা ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা নেই। অবশেষে চন্দননগরের বীর সন্তান কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু সাজিয়ে ফেললেন হত্যার ব্লু প্রিন্ট। অসুস্থতার অজুহাতে নরেনের সাথেই হাসপাতালে ভর্তি হলেন কানাইলাল। বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র ঘোষের সহায়তায় জুটেও গেল লোডেড রিভলবার। সঙ্গী হলেন বিপ্লবী সত্যেন বসু। ১৯০৮ সালের ৩১শে আগষ্ট দুজনে একেবারে সামনে থেকে রিভলবারের সমস্ত গুলি খালি করে দিলেন শ্রীরামপুরের নরেন গোঁসাইয়ের বুকে৷ লুটিয়ে পড়েন রাজসাক্ষী নরেন। তাঁকে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দিয়ে ফাঁসির দড়ি হাসতে হাসতে গলায় তুলে নিলেন বীর কানাইলালও। শোনা যায় গ্রেপ্তার হবার পরে কানাইলালের যা ওজন ছিল, ফাঁসির দিন তা আরও ১৫ পাউন্ড বেড়ে যায়। এ এক অপার আনন্দ আর তৃপ্তির ফল। এমনই ছিল অগ্নিযুগের বীর বিপ্লবীরা। শ্রীরামপুরের মাটি শুধুমাত্র বিশ্বাসঘাতকতার মাটি নয়, বীরত্বেরও মাটি। কারণ আরও কিছু বছর পরে এই মাটি থেকেই ফাঁসির দড়ি বরণ করলেন আরও এক বীর সন্তান।
তিনি ক্ষেত্রমোহন শাহ স্ট্রিটের গোপীনাথ সাহা। কলকাতার অত্যাচারী পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ডকে হত্যা করবার জন্য আদাজল খেয়ে লেগে পড়েছিল ১৯ বছরের গোপীনাথ। পারেনি। ভুলবশত আর্নস্ট ডে সাহেবকে হত্যার অপরাধে ফাঁসির দড়ি বরণ করতে হয় গোপীকে। আদালতে চিৎকার করে সে স্বীকার করে, টেগার্ড হত্যাই তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। ধন্য হয় শ্রীরামপুর, গর্বিত হয় আপামর শ্রীরামপুরবাসী। ইংরেজদের বিরুদ্ধে এক দুর্ধর্ষ জীবনপণ লড়াইয়ের পরে শহীদ গোপীনাথকে চোখের জলে বিদায় করে বাংলা ছাপাখানার শহর। আজও শ্রীরামপুরে গোপীনাথ সাহা সরণি ও স্টেশন সংলগ্ন গোপীনাথ সাহা মার্কেট তাঁর স্বল্প জীবনে বীরত্বের স্মৃতিটুকু ধরে রেখেছে যত্ন করে।