উপনিষদ বলছে, প্রাণেরও নাকি প্রাণ আছে, চোখেরও নাকি চোখ আছে। তাহলে আমার চোখ দিয়ে আমি যা দেখি, সেই দৃশ্যমান পৃথিবীর বাইরে আমার চোখ কি তখন অন্য কিছু দেখে বা যে প্রাণ আমাকে ধারন করেছে আবার অন্য দিক দিয়ে দেখতে গেলে যাকে আমি ধারন করে আছি, সে কি অন্য কিছুতে সমাগত বা উপগত?
এর কোনো ধারণাই আমাদের পাড়ার শ্রীদাম মুদির নেই। আমারও ছিল না। কিন্তু অলস মস্তিষ্কে খুন্নিবৃত্তির বাইরে, বেশ কিছু কথা ঘাই মারে, তাই আর কি! এর বেশি এগোতে পারিনি বা চেষ্টাও করিনি। যাই হোক শ্রীদাম বড় যত্নে ডাল, চাল, চিনি মাপে দাঁড়িপাল্লায়। এতটুকু ভুলচুক হবার জো নেই। সকালের আলোয় পিঠ তাতিয়ে আমি প্রায়শঃই ওর হাতের নিপুন কৌশল দেখি। দুটি পাল্লার মধ্যে কি সুন্দর সখ্যতা। কেউ কাউকে ছড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে না আর করলেও শ্রীদাম কি এক জাদু কাঠির ছোঁয়ায় সব সমান করে দেয়।
ফি সকালবেলা ওর দোকানের বাঁশের বেঞ্চিতে গিয়ে বসি। যদি আমাদের সব কাজের কারন থাকে তাহলে এক্ষেত্রে কারনটা দু’তরফা। আমার দিকটা আগে বলি, বিনে পয়সায় খবরের কাগজ মুখস্ত করা। লক্ষ্মী কড়াইয়ের বিজ্ঞাপন দিয়ে শুরু করে নামী কোম্পানির জুতোয় শেষ। এর মাঝে যা কিছু তার কোনো মানে নেই। এর সাথে সবচেয়ে বড় কারন যেটা, তা হলো শ্রীদাম আমার কবিতার একমাত্র অমনোযোগী শ্রোতা। মানে মনোযোগের ভানটা এক্ষেত্রে নেই। এবার আসি আমাকে সহ্য করার শ্রীদামের কারণ, প্রধান ও একমাত্র কারণ আমি নাকি বেশ কটা পাশ দিয়েছি আর তাই আমার সাথে গা ঘেঁষাঘেষি করলে ও এদিক সেদিকের কথা জানতে পারে। আর একটা কথা বলে রাখি শ্রীদাম আর আমার সব কিছুই উল্টো একমাত্র জুতো ছাড়া। শুনেছি তেলে জলে মিশ খায় না। কিন্তু তেলেরও তো ভেসে থাকার জন্য জল লাগে। না হলে তার একমাত্র ভবিতব্য তো, পোড়া। এবার এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কে তেল আর কে জল ভাবিনি কখনো।
বেলা একটু ডাগরডগর হলে, কেনাবেচা কমে আসে নিয়ম মাফিক। ওই যে ঠাকুরের কথা অনুযায়ী শেষ পাতে দই পড়লে কাজ বাড়ির চিৎকার চেঁচামেচি থিতিয়ে পড়ে। তখন সবাই রসনার বসে। বাড়িতে গঙ্গাজল এনে দেখেছি, মাটি থিতিয়ে গেলে জল কেমন কাকচক্ষু হয়ে ওঠে। জলের মাঝে তিরতির করে কাঁপতে থাকে আমাদের ছবি। আর্শি নগরের পড়শি তখন ভালোবাসায় মশগুল, অবস্থা নর্শিশাসের মতো। সে বেচারি নিজেরই রূপে এমন মন মজালো যে, মৃত্যুর আগে তার মুক্তি হলো না। কাজ নেই বাপু অমন অলুক্ষণে ভালোবাসায়। কিন্তু আবার নড়ে উঠল মাথার পোকা। উপনিষদ বলেছে যে প্রিয়র কারণে প্রিয়, প্রিয় নয়। তারমধ্যে নাকি আমরা নিজেদের বসাই আর তাই এতো ভালোবাসা, মাখামাখি। চালে ডালে, কড়ায় গন্ডায়, তেলে ঝলে প্রবহমান যে প্রাণ, তার সবটুকুই আমাকে ঘিরে। আচ্ছা এই আমি টা কে? কেনই বা এর এতো বাড়বাড়ন্ত? ওই যে একটা বিস্কুটের বিজ্ঞাপনে শুনেছিলাম বলছে, আমি খেলে আমার ছায়া তারও খাওয়া চাই। এ যেনো আমি গেলে আমার আমি তারও যাওয়া চাই। যাই হোক যে কথায় ছিলাম, শ্রীদামের কথায়। তো বেলা বাড়লে সেও এসে বসে বাঁশের মাচায়, আমার পাশে, হাতে নিয়ে মুড়ি বাতাসের ঠোঙা। ওর এই একক আয়োজনের যৌথ নিবেদনে আমি একটি সর্বব্যাপী চরিত্র। চিনির অরক্ষিত দানায় যেমন পিঁপড়ের অধিকার তেমনই এই মুড়ি বাতাসায় আমারও প্রায় জন্মগত না হলেও আড্ডাগত অধিকার। যৌথ খিদের নিরাময়ের পর আবশ্যিক ভাবে এসে পড়ে কিছু যৌথ আলাপ। এ সময়টা আমাদের একান্ত নিজস্ব। আমি কথার ওপর কথা রাখি, শ্রীদাম মনের ওপর কান রেখে শোনে এক তরফা সেই প্রতিবেদন। মাঝে মাঝে এসে রস ভঙ্গ করে যায় কোনো অশিষ্ট ক্রেতা। আমি ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলতে থাকি কবিতার দুটি লাইনের মাঝে। বডি এবং মাথা দুইই তখন লাইনের মাঝে। দুর্ঘটনার প্রবল আশঙ্কা থাকা স্বত্বেও শ্রীদাম একমনে মাপতে থাকে দু টাকার চিনি, এক টাকার নুন, পাঁচ টাকার তেল আরো কতো কি! আমার মনও তখন দ্বিখণ্ডিত। দাড়ি থেকে ঝুলতে থাকা দুটি পাল্লার মতো। যারা একসাথে কখনো মাটি ছুঁয়ে থাকতে পারেনি।
মাটির কথায় মনে পড়ল, শ্রীদামের একটা কথা। একদিন অনুযোগ করে বলেছিল, আচ্ছা ঘোষ দা, তুমি তো রোজই আমার দোকানে আসো, অনেকক্ষণ থাকো। তা কোনোদিন এই চাল ডাল, তেল নুন, হিং ফোড়নের কথা লেখো না তো! আর যা লেখো, আমাকে শোনাও, যদিও খুব মন দিয়ে শুনিনা, তবু যেটুকু শুনি তা কেবলই মাথার ওপর দিয়ে যায়, বুকের মাঝে সেঁধোয় না কখনো। কি যে বলি এমন অনুযোগের উত্তরে! রোজই এসে বসি ওর দোকানের বেঞ্চিতে। আসা যাওয়া দেখি, খবরের কাগজ পড়ি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিন্তু আদতে যা দেখার ছিল মন বাড়িয়ে চোখ পেতে তা রোজই রয়ে যায় চোখের বাইরে। কবিতার দুটি অক্ষরে মাঝে যেটুকু ফাঁক তারই ভিতর হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে অর্থের মৌতাত আর দুটো লাইনের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে যে নীরব দূরত্ব তারই মাঝে আমাদের চিরকালীন দৃশ্যপট প্রবহমান। তার এপাড়ে আমি আর ওপাড়ে আমারই ছায়া হয়ে বসে আছে শ্রীদাম আর এর ওপর একটা নড়বড়ে সাঁকো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শব্দের অক্ষর জন্ম অথবা অক্ষরের শব্দবোধ। হঠাৎ দেখি চাল মাপতে মাপতে শ্রীদাম গান ধরেছে, হরি দিন তো গেলো, সন্ধ্যা হলো, পার করো আমারে। ওর কঠিন দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে বেশ ক’দানা চাল ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে। আচ্ছা ওদের গতি কি হবে, কে করবে পার? প্রশ্ন অনেক, উত্তর সীমিত। উত্তর দেবার মানুষজন আরো সীমিত। তখন ভাবি এই আকালের বাজারে সব উত্তর নাই বা পেলাম! তার চেয়ে পরের কবিতায় যাওয়া যাক। শ্রীদাম একটা বিড়ি ধরিয়ে সুখ টান দিচ্ছে!