• Uncategorized
  • 0

|| অণুগল্প ১-বৈশাখে || বিশেষ সংখ্যায় জাহ্নবী

মানত

“তরতাজা ছাওয়ালগুলা কেমন মইর‍্যা গেল বৌদি গো” – মালতীর এই আন্তরিক দুঃখের বহিঃপ্রকাশে বৌদি অর্থাৎ মায়ার মা “ইশশশ কী যে হচ্ছে চারপাশে” বলে ক্ষান্ত দিলেও কেউ খেয়াল করেনি কলেজপড়ুয়া মায়ার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিলো।

মায়া তড়িঘড়ি বলে ওঠে “কোন তিনটে ছেলে গো মাসি? পাড়ার? কি হয়েছিলো?”

সাতেপাঁচে না থাকা মায়ার এহেন কৌতূহল দেখে মায়ার মা ভ্রুকুঞ্চন সহযোগে মায়ার দিকে তাকালে মালতী মাসির থেকে তার প্রশ্নের উত্তর শোনার আগেই মায়ার আবারও বুকের ভীতর হিম হয়ে আসে।
কাল অতো রাতে বন্ধুর বাড়ি থেকে ফিরে আসার সময়ে সাতঝিলের মাঠের পাশের রাস্তায় যা হল, বাড়িতে বলে দিলেই হত বোধহয়। ওই তিনটে ছেলে যেভাবে প্রথমে পথ আটকে সন্তর্পণে এগোচ্ছিলো মায়ার দিকে, যে ও ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছিল। তবু শেষ মুহূর্তে পাড়ার বল্লি’কে চিনতে পেরেছিল।
এই বল্লি আর বন্ধুবান্ধবের জন্য পাড়ার মেয়েগুলোর শান্তি নেই। দিনদিন এদের জন্য রাস্তায় বেরনো বন্ধ হতে চলেছে। এমনিতেই মায়াদের বাড়িটা বড় রাস্তা থেকে বেশ ভিতরের দিকে।
কিন্তু মা’কে একথা বলতে পারতো না মায়া। এই কথা মা’কে জানালে, কলেজে পড়ার সুবাদে এদিক ওদিক যাওয়ার যেটুকু অনুমতি পায়, তাও বন্ধ হয়ে যাবে।
আসলে মায়া তার ঠাকুমার কাছে গল্প শুনেছে তাঁর মা বাবার বিয়ের পর আঠেরো বছর পেরিয়ে গিয়েছিলো মায়াকে পৃথিবীতে আনতে। ওর আগে নাকি দুজন সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েই ইহলোক ত্যাগ করেছিলো। সন্তানের আশায় তার মা প্রায় উন্মাদিনী হয়ে কোন এক সাধুর সংস্পর্শে আসে এবং সেই সাধু তার জন্মের আগেই মা’কে বলেছিল, “এবার তোর সন্তান যদি বেঁচে যায়, জেনে রাখিস, ও একা আসেনি এই পৃথিবীতে।“
এরপর প্রসবকালীন সময়ে তার মায়ের তীব্র শরীর খারাপ হয়। মায়াকে ওর মামাবাড়ির পাড়ার দুর্গাকুঠিতে মানত করে বাঁচিয়েছিল তার বাবা। নামও তাই রেখেছে মহামায়া চ্যাটার্জি। তাই মায়ার উপর মা বাবার অধিকারবোধ থেকে শুরু করে নজরদারি সবটাই বড় প্রবল। তবে সাধুর কথা অনুযায়ী তার মা বাবা যমজ সন্তান আশা করেছিলো ঠিকই। কিন্তু সুস্থ সবল মায়াকে পেয়ে সাধুর সেই কথাকে নিছকই ভণ্ডামি ধরে নিয়েছিল চ্যাটার্জি দম্পতি।
মালতী মাসি বলে উঠলো, “বল্লি আর ওর দুইখান বন্ধু মরসে রে… শরিলে আর কিসসু ছিল না গো… ধর মুণ্ড আলাদা হইয়া গেসে গিয়া… ট্রেনে কাটা পরসে নাকি… সাতঝিলের মাঠের পাশ থিক্যা তিনটেরেই পাওয়া গেসে … চক্ষে দ্যাখা যায়না গো দিদিমনি…”
মায়া আবারও বলে ওঠে, “ট্রেনে? স্টেশন তো অনেক দূর! ট্রেনে কি করে কাটা পড়বে? পোস্টমর্টেম হবে না?”
এবার মা আর মালতী মাসি দুজনেই হতচকিত হয়ে মায়ার দিকে তাকায়। সারাদিন বইতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা আর একটি দুটি বন্ধুর সাথে ওঠাবসা করা মায়ার এই বস্তির ছেলেগুলো খুন হওয়ার পর তাদের পোস্টমর্টেম হবে কিনা – এই জাতীয় পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ জেনে কি লাভ, সেই হিসেব মিলাতে পারেনি কেউই।
শুধু মায়া জানে যে ওকে আবারও খুঁজে বের করতে হবে, খুন হয়ে যাওয়া ছেলে তিনটের ঘাড়ে বন্যজন্তুর দাঁতের দাগ পাওয়া গেছে কিনা!
কারণ মায়া মামাবাড়ি গিয়ে বিকেলে খেলতে খেলতে একবার হালদারদের বাগানে হারিয়ে গিয়েছিলো সন্ধ্যে নামার মুখে। মায়া বাড়ি আসার রাস্তা খুঁজে না পেয়ে কাঁদতে শুরু করেছিলো যখন, তখন জঙ্গলের মধ্যে খসখস আওয়াজ পেয়ে বুঝতে পেরেছিল, খাওয়ার সময়ে বায়নাক্কা করলে বাবা যে হালদারদের বাগানের শেয়ালের ভয় দেখায়, সেই শেয়ালগুলোই বেরিয়ে আসছে মায়াকে লক্ষ্য করে। আর কিছু মনে ছিল না ওর। জ্ঞান ফিরেছিল মায়ের কোলে। পরে শুনেছিল, মায়াকে খুঁজে নিয়ে আসার সময়ে হালদারদের বাগানে তিন চারটে শেয়ালকে খুবলে নেওয়া অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিলো।
কারণ সেই ছোটবেলায় এক নির্জন দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পথে মায়ার ফ্রকের ভীতর হাত ঢুকিয়ে আদর করে দেওয়া কাকুটা যখন মারা গেছিল পুকুরে ডুবে,পরদিন ধরাধরি করে ওর লাশটা পুকুর থেকে তোলার সময়ে মায়া দেখেছিল কাকুর ঘাড়ে চারটে গভীর গর্ত। ঠিক যেন কোন বন্য প্রাণী দাঁতে করে ঘাড় ধরে নিয়ে এসে পুকুরে ফেলেছে।
কারণ মায়া যখন কিশোরী, একবার স্কুলের পথে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে সেবার খেয়াল করেনি এক্কেবারে কাছে এসে গিয়েছিলো দুরন্ত গতিতে ছুটে আসা ট্রাকটা। সেবারও ও ভীষণ এক ধাক্কায় রাস্তার এক ধারে ছিটকে এসে পড়েছিলো। না… মায়ার গায়ে অল্প ছড়ে যাওয়া ছাড়া আর একটা আঁচরও লাগেনি; শুধু মায়া উঠে জামা কাপড় ঝারার সময়ে খেয়াল করেছিলো, জামায় হলুদ হলুদ পশম। দেখেই বোঝা যায়, কোন চারপেয়ের। কিন্তু আশেপাশে তো কোন কুকুর, বেড়ালও নেই…
তবে মায়া যখন মাধ্যমিকের পর চিড়িয়াখানা ঘুরতে গেলো, সেবার পাখির খাঁচা থেকে বেরিয়ে বন্যজন্তুর খাঁচার সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সময়ে ঠিক ওইরকম পশম দেখতে পেয়ে মায়া মনে পড়ে গিয়েছিলো কয়েক বছর আগের সেই দুর্ঘটনার কথা। ফিরতি পথে মায়ার ধুম জ্বর। দুদিন লেগেছিল জ্বরের ঘোর কাটতে।
তবে তারপর থেকে সে বোঝে ঠাকুমার কাছে শোনা সেই সাধুর কথা মিথ্যা ছিল না। মহামায়া সত্যিই এই পৃথিবীতে সেদিন একা ভূমিষ্ঠ হয়নি। আশৈশবের ঘটনা পরম্পরায় সে বুঝে গিয়েছে, তার চলার পথে যা কিছু বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে, তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে তার পিছনে ছায়ার মতো এক অস্তিত্ব তাকে অনুসরন করবে আজীবন। মহামায়ার যাপনটুকু সুরক্ষিত করতে, তার আশেপাশে যে উপস্থিতি নিঃশব্দ পদসঞ্চারে ঘুরে বেড়ায়, সে আর কেই বা হয় পশুরাজ ছাড়া?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।